bayyinaat

Published time: 01 ,November ,2018      17:38:18
কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে কবর জিয়ারত করার বৈধতা
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত বিবরণ হতে আল্লাহ্র ওলীদের কবর জিয়ারত বৈধ ও মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। মহানবী (সা.) কবর জিয়ারতের কেবল নির্দেশই দান করেন নি, বরং তিনি নিজেও কবর জিয়ারতে যেতেন যাতে করে এ বিষয়টি জায়েয ও মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়। আমরা তাই কবর জিয়ারতের বৈধতার বিষয়টি এখানে এরূপ কয়েকটি আয়াতের প্রতি ইশারা ও হাদীস এবং মহানবীর অনুসৃত কর্ম (সীরাত) উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই পর্যালোচনা করব ।
সংবাদ: 103
হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (আ.) ও কবর জিয়ারত : হাকিম নিশাবুরী তাঁর নিজস্ব সনদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি মহানবীর জীবদ্দশায় প্রতি শুক্রবার হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (ওহুদের যুদ্ধে শহীদ রাসূলের চাচা) কবর জিয়ারতে যেতেন। সেখানে নামাজ পড়তেন এবং ক্রন্দন করতেন।

                                     কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে কবর জিয়ারত করার বৈধতা

সারাংশঃ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত বিবরণ হতে আল্লাহ্র ওলীদের কবর জিয়ারত বৈধ ও মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। মহানবী (সা.) কবর জিয়ারতের কেবল নির্দেশই দান করেন নি, বরং তিনি নিজেও কবর জিয়ারতে যেতেন যাতে করে এ বিষয়টি জায়েয ও মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টি ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়। আমরা তাই কবর জিয়ারতের বৈধতার বিষয়টি এখানে এরূপ কয়েকটি আয়াতের প্রতি ইশারা ও হাদীস এবং মহানবীর অনুসৃত কর্ম (সীরাত) উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই পর্যালোচনা করব ।

ট্যাগ: কবর জিয়ারত, কুরআন, হাদীস, মহানবী (সা.)-এর সিরাত, সাহাবী ও তাবেয়ীদের সিরাত

পবিত্র কোরআন ও কবর জিয়ারত

১। মহান আল্লাহ্ মহানবীকে মুনাফিকদের কবরের নিকট দণ্ডায়মান হতে নিষেধ করে বলেছেন : وَ لا تقم علی قبره "আপনি তাদের (মুনাফিকদের) কবরের নিকট দণ্ডায়মান হবেন না।

উপরিউক্ত আয়াতটিতে মুনাফিকদের ব্যক্তিত্ব ও মূল্যহীনতার দিকে লক্ষ্য করে তাদের মৃত্যুর পর দাফনের মুহূর্তে অথবা পরবর্তীকালে তাদের কবরের নিকট জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দাঁড়াতে নিষেধ করা হয়েছে।বাইদ্বাভী তাঁর আনওয়ারুত্ তানযীল[i] গ্রন্থে এবং আলূসী তাঁর রুহুল মায়ানী[ii] তাফসীরে উপরিউক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেছেন তাদের কবরের নিকট দাঁড়ানোর অর্থ দাফনের সময় অথবা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। মুনাফিক ও কাফিরের কবরের নিকট জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ হওয়া হতে বোঝা যায় মুমিন ও মুসলমানের কবরের নিকট দাঁড়ানো ও তাদের জিয়ারত করা বৈধ এবং এতে কোন অসুবিধা নেই।

২। মহান আল্লাহ্ আসহাবে কাহাফের বিষয়ে ও তাঁদের প্রতি মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ধরণ কী হওয়া উচিত তা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব হয়েছে তার উল্লেখ করে বলেছেন,

إذ یتنازعون بینهم امرهم فقالوا ابنوا علیهم بنیاناً ربّهم أعلم بهم قال الذین غلبوا علی امرهم لتتخذنَّ علیهم مسجداً

"যখন তারা নিজেদের মধ্যে তাদের (সম্মান প্রদর্শনের) বিষয়ে পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হল এবং তারা (একদল) বলেছিল : তাদের (কবরের) উপর সৌধ নির্মাণ করব। তাদের প্রতিপালক তাদের বিষয়ে অধিক অবগত। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল তারা বলল : আমরা অবশ্যই তাদের উপর (কবরস্থানে) মসজিদ নির্মাণ করব।”(সূরা কাহফ : ২১)

মুফাস্সিরগণ বলেছেন, ‘অনেকের মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাব হতে বোঝা যায় তারা মুসলমান ও একত্ববাদী ছিল। তাদের মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাবও এ লক্ষ্যে ছিল যে, সবসময় যেন লোকজন সেখানে যায় এবং তাদের (আসহাবে কাহফ)  মাজারও জিয়ারতের স্থানে পরিণত হয়।

কবর জিয়ারত সম্পর্কিত হাদীসসমূহ

ক) হাদীসসমূহে কবর জিয়ারতের বৈধতার দলিল :  ইসলামী শরীয়তে কবর জিয়ারত বৈধ হওয়ার বিষয়টিতে তিনটি পর্যায় লক্ষণীয়।

প্রথম পর্যায় : এ পর্যায়ে পূর্ববর্তী শরিয়তের বৈধতার বিষয়টিই বহাল ছিল।

দ্বিতীয় পর্যায় :ইসলামের প্রাথমিক যুগে কোন কোন গোষ্ঠী বিশেষত আহলে কিতাবের অনুসারীদের র্শিক বা অংশীবাদমিশ্রিত বিশ্বাস যা তারা তাদের মৃত ঐশী ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে পোষণ করত (যেমন কবরের উপর সিজদা করা) রোধ করার লক্ষ্যে তৎকালীন সময়ের জন্য তা নিষিদ্ধ করা হয়।

তৃতীয় পর্যায় :এই পর্যায়ে পুনরায় কবর জিয়ারতকে বৈধ (জায়েয) করা হয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য কবর জিয়ারতকে নিষিদ্ধ করেছি, কিন্তু এখন হতে তা তোমাদের জন্য বৈধ করা হল তবে  জিয়ারতের সময় এমন কথা বলো না যাতে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হন।[iii]

 

খ) মহানবী (সা.)-এর সিরাত বা অনুসৃত কর্মপদ্ধতিতে কবর জিয়ারত :

১। বুরাইদা আসলামী মহানবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন : আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। কিšআমাকে আমার মাতার কবর জিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তোমরা তোমাদের মৃতদের কবর জিয়ারত কর। কারণ তা তোমাদের আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।[iv]

২। হাকিম নিশাবুরী বুরাইদাহ হতে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী সহস্র ফেরেশতাসহ তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করেন। সেদিনের ন্যায় এত অধিক ক্রন্দন করতে আমি তাঁকে কখনোই দেখি নি।[v]

আবু হুরাইরা বলেছেন, ‘মহানবী (সা.) তাঁর মাতার কবর জিয়ারত করার সময় এতটা ক্রন্দন করেছিলেন যে, অন্যরা তাঁর কান্নায় প্রভাবিত হয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল।[vi]

৩। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ বলেছেন, ‘আমরা রাসুলের সাথে শহীদদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা হতে বের হলাম। যখন আমরা হাররে ওয়াকিমনামক ¯ানে পৌঁছালাম কয়েকটি কবর লক্ষ্য করে তাঁকে বললাম : হে আল্লাহ্র নবী! এগুলো কি আমাদের মুসলিম ভ্রাতাদের কবর? তিনি বললেন : এ কবরগুলো আমার সাহাবীদের। যখন আমরা শহীদদের কবরের নিকট পৌঁছালাম তিনি বললেন : এ কবরগুলো আমাদের ভ্রাতৃবর্গের।[vii]

৪। মুসলিম হযরত আয়েশা হতে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) শেষ রাত্রে জান্নাতুল বাকীর গোরস্তানে যেয়ে এভাবে সালাম করতেন আস্ সালামু আলা দারে কাওমি মুমিনীন।[viii]

৫। ইবনে আবি শাইবাহ বলেছেন, ‘মহানবী (সা.) প্রতি বছরের শুরুতে ওহুদের শহীদদের কবরের নিকটে গিয়ে এভাবে সালাম দিতেন, ‘আস্সালামু আলাইকুম বিমা সাবারতুম ফানিমা উকবাদ্দার।

গ) পূর্ববর্তীগণের জীবন ও কর্মধারায় কবর জিয়ারত : সাহাবী, তাবেয়ী ও ইসলামী উম্মাহ্র আলেমগণের জীবন ও কর্মধারায় আমরা কবর জিয়ারতের প্রচলন লক্ষ্য করি। এখানে আমরা এরূপ ব্যক্তিবর্গের এরূপ কর্মের নমুনা পেশ করছি।

১। হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (আ.) ও কবর জিয়ারত : হাকিম নিশাবুরী তাঁর নিজস্ব সনদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি মহানবীর জীবদ্দশায় প্রতি শুক্রবার হযরত হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবের (ওহুদের যুদ্ধে শহীদ রাসূলের চাচা) কবর জিয়ারতে যেতেন। সেখানে নামাজ পড়তেন এবং ক্রন্দন করতেন।[ix]

২। খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব এবং কবর জিয়ারত : মুহিবুদ্দিন তাবারী বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর কয়েকজন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে হজ্জ্বে যাওয়ার সময় পথে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি তার কাছে সাহায্য চাইল। তিনি হজ্জ্ব হতে ফেরার সময় ঐ স্থানে পৌঁছে উপরিউক্ত ব্যক্তির খোঁজ খবর জানতে চাইলেন। তাকে বলা হলো সে মৃত্যুবরণ করেছে। এ কথা শুনে তিনি দ্রæত তার কবরের নিকট যেয়ে নামাজ পড়লেন ও সেখানে বসে ক্রন্দন করলেন।[x]

৩। হযরত আয়েশা ও কবর জিয়ারত : ইবনে আবি মালিকা বলেছেন : একদিন হযরত আয়েশা  কবর¯স্থানে প্রবেশ করলেন আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম : কেন কবর’স্থানে প্রবেশ করছেন? তিনি বললেন : আমার ভাই আবদুর রহমানের কবর জিয়ারত করতে। আমি বললাম : মহানবী (সা.) কি কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেন নি? তিনি বললেন : তিনি নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু পরে অনুমতি দিয়েছেন।[xi]

হযরত আলী (আ.) ও কবর জিয়ারত : খাব্বাব ইবনে র্আত প্রাথমিক মুসলমানদের একজন তিনি কুফায় বসবাসকালীন সময়ে গুরুতর অসু¯তার কারণে হযরত আলীর সঙ্গে সিফ্ফিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। যখন ইমাম আলী (আ.) সিফ্ফিন হতে ফিরে এসে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনলেন তখন তাঁর কবরের নিকট গিয়ে জিয়ারত করলেন।[xii]

৫। মুহাম্মদ ইবনে হানাফীয়াহ ও কবর জিয়ারত: ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) শাহাদাত বরণের পর মুহাম্মদ ইবনে হানাফীয়াহ তাঁর কবরের নিকট পৌঁছলে তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে আসল। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলে তিনি ইমাম হাসানের প্রশংসা করতে লাগলেন।[xiii]

৬। আবু খাল্লাল ও কবর জিয়ারত : স্বীয়যুগে হাম্বলী ফিকাহ্র ইমাম আবু খাল্লাল বলেছেন, ‘যখনই আমি কোন সমস্যায় পড়তাম হযরত মূসা ইবনে জাফরের (আ.) নিয়ত করতাম এবং তাঁর উসিলায় আল্লাহ্র নিকট চাইতাম। আল্লাহ্র ইছায় আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।[xiv]

৭। ইবনে খোজাইমা ও কবর জিয়ারত : আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুয়াম্মাল বলেছেন : আহলে হাদীসের ইমাম আবি বাকর ইবনে খোজাইমা, ইবনে আলী সাকতী ও স্বনামধন্য কয়েকজন আলেমের সঙ্গে হযরত আলী ইবনে মূসা র্আ রেজার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। লক্ষ্য করলাম ইবনে খোজাইমা এমনভাবে আলী ইবনে মূসার কবরের প্রতি সম্মান ও বিনয় প্রদর্শন করলেন যে, আমরা হতভম্ব হলাম।[xv] 

অতএব উপরুক্ত আলোচনায় আমরা এটায় উপসংহার হিসাবে বলতে পারি যে ,ইসলাম  কবর জিয়ারত করা বৈধতা দিয়েছে। এমনকি রাসূল (সা:) জীবনার্দশে দেখা গিয়েছে যে , তিনি জিয়ারত করতেন  এবং জিয়ারত করার নির্দেশ দিয়েছেন ।  

 

 

 তথ্যসূত্র

 

 

 



[i] . আনওয়ারুত তানযীল, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১৬।

[ii] . রুহুল মায়ানী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ১৫৫।

[iii] আল মোজামুল কাবির, তাবরানী, ১১তম খণ্ড, পৃ. ২০২, হাদীস নং ১১৬৫৩।

[iv] সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৬৬, হাদীস নং ১০৭, কিতাবুল জানায়িয।

[v] মুসতাদরাকে হাকিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩১, হাদীস নং ১৩৮৯।

[vi] প্রাগুক্ত, হাদীস নং ১৩৯০।

[vii] সুনানে ইবনে দাউদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৮, হাদীস নং ৩৫৭, কিতাবুল মানাসিক, জিয়ারতে কবর অধ্যায়।

[viii] সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৬৩, হাদীস নং ১০২, কিতাবুল জানায়িয।

[ix] মুসতাদরাকে হাকিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩৩, হাদীস নং ১৩৯৬।   

[x] মুসতাদরাকে হাকিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩৩, হাদীস নং ১৩৯৬।

[xi] আর রিয়াদুন নাদ্বরাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩০।

[xii] মুসতাদরাকে হাকিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩২, হাদীস নং ১৩৯২।

[xiii] উসদুল গাবাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪৩।

[xiv] আকদুল ফারিদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩।

[xv] তাহজীবুত তাহজীব, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৯।

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: