ইমাম
হাসান (আ.) এর অসংখ্য স্ত্রী গ্রহণের অপবাদের জবাব
আনোয়ারুল কবির
সারাংশ: নিঃসন্দেহে ইমাম হাসানের বিয়ে ও তালাকের ব্যাপারে যে বড় এক সংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে তা স্বয়ং পাঠকের মনে এ প্রশ্নের সৃষ্টি করে যে, তবে কি তালাক মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কর্ম বলে বিবেচিত নয় যা আল্লাহর আরশকে প্রকম্পিত করে। এরূপ এক অপছন্দনীয় কর্ম কিভাবে বেহেশতের যুবকদের নেতা থেকে বারবার ঘটতে পারে। তবে কী তিনি আল্লাহর আরশ প্রকম্পিত হওয়ার কোন পরওয়াই করতেন না।
ট্যাগ: ইমাম হাসান, বহু স্ত্রী গ্রহণ, অধিক তালাক দান, কোরআন, ইতিহাস বিকৃতি,
মূল প্রবন্ধ: ইসলামের শত্রু বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাস মহানবির পবিত্র আহলে বাইত বিশেষত ইমাম হাসানের চরিত্র হরণের উদ্দেশে তাঁর ওপর বিভিন্নরূপ অপবাদ আরোপ করেছে। তাদের শাসনকালে যে সকল ইতিহাস ও হাদিসগ্রন্থ সঙ্কলিত হয়েছে তাতে এমনকিছু আপত্তিকর ও সত্যের অপলাপ বিষয় বর্ণিত হয়েছে যার কোন ভিত্তি নেই। এরূপ একটি বিষয় হল ইমাম হাসানের পুনঃপুনঃ নতুন স্ত্রী গ্রহণ ও তালাক দানের বিষয়। যেমন, ঐতিহাসিক বালাজুরি উল্লেখ করেছে: আবু সালেহ বর্ণনা করেছে যে, হযরত আলী বলেছেন: হাসান এত বেশি বিয়ে করে ও তালাক দেয় যে, আমি ভয় পাচ্ছি এটা আমাদের সাথে অন্যদের সাথে শত্রুতার কারণ হবে। (অনসাবুল আশরাফ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫)
তেমনি সুয়ুতি আলী থেকে বর্ণনা করেছে: হাসান এত বেশি বিয়ে করে ও তালাক দেয় যে, আমি ভয় পাচ্ছি এর ফলে বিভিন্ন গোত্র ও বংশের লোকদের পক্ষ থেকে আমাদের সাথে শত্রুতা বৃদ্ধি পাবে। (তারিখুল খোলাফা, পৃ.১৯১) ইবনে হাজার বর্ণনা করেছে হাসানের ৯০জন স্ত্রী ছিল। (আসসাওয়ায়েকুল মুহরিকা, পৃ.১৩৯) আবু তালেব মাক্কি তাঁর ৩০০জন স্ত্রী ছিল বলে উল্লেখ করেছে।(মানাকিবু আলে আবি তালিব, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩০) আবুল হাসান মাদায়েনী তাঁর স্ত্রীদের সংখ্যা ৭০জন ছিল বলেছে।
এ বর্ণনাগুলো ইমাম হাসানের মহান মর্যাদার সাথে অসামঞ্জস্যশীল
পবিত্র কোরআন, সুন্নাত, ইমাম হাসানের জীবনচরিত এবং তাঁর বিষয়ে হযরত আলী ও ইমাম হোসাইনের বক্তব্য ও আচরণ থেকে তাঁর যে মহান চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় তা তাঁর নামে যা প্রচারিত হয়েছে তাকে সর্বৈবভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। নিম্নে আমরা নমূনাস্বরূপ এরূপ কিছু বর্ণনা উল্লেখ করছি:
১. পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৩৩নং আয়াতের এ অংশটি- আল্লাহ কেবল চান যে, হে আহলে বাইত! তোমাদের হতে সর্ব প্রকারের কলুষ দূরে রাখতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে- ইমাম হাসানসহ মহানবির (সা.) আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্যদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।(তাফসীরে দুররুল মানসূর, ৫ম খ-, পৃ. ১৯৬; আসসাওয়ায়েকুল মুহরিকা, পৃ.১৪৩; সুনানে বায়হাকি, ২য় খ-, পৃ.১৪৯) এ আয়াত থেকে ইমাম হাসানের মহান ও পুতপবিত্র চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। আর কেনই তা তিনি এমন হবেন না যখন তিনি পবিত্র কোরানের ঘোষণায় মহান চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি (সূরা কালাম:৪) অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলের সন্তান ও তাঁর দ্বারা প্রশিক্ষিত।
২. সূরা শূরার ২৩নং আয়াতেরও তিনি অন্তর্ভুক্ত যেখানে মহান আল্লাহ তাঁর নবির আহলে বাইতের সদস্যদের -অর্থাৎ হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান ও হোসাইন- প্রতি ভালবাসা পোষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীরে দুররুল মানসূর, ৭ম খ-, পৃ. ৭) নিঃসন্দেহে উত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়ার কারণেই আল্লাহ ইমাম হাসানকে ভালবাসার নির্দেশ দিয়েছেন।
৩. রাসূল (সা.) বলেছেন: «أَلْحَسَنُ وَ اْلْحُسَيْنُ سَيِّدا شَبَابِ أَهْلِ اْلْجَنَّةِ» "হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের নেতা।” (আহমাদ ইবনে হাম্বাল, মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খ-, পৃ.২; হাকিম নিশাবুরি, আলমুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন, ৩য় খ-, পৃ,১৬৭; সুয়ুতী, তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৮৯) নিঃসন্দেহে ইমাম হাসানের বিয়ে ও তালাকের ব্যাপারে যে বড় এক সংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে তা স্বয়ং পাঠকের মনে এ প্রশ্নের সৃষ্টি করে যে, তবে কি তালাক মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কর্ম বলে বিবেচিত নয় যা আল্লাহর আরশকে প্রকম্পিত করে। এরূপ এক অপছন্দনীয় কর্ম কিভাবে বেহেশতের যুবকদের নেতা থেকে বারবার ঘটতে পারে। তবে কী তিনি আল্লাহর আরশ প্রকম্পিত হওয়ার কোন পরওয়াই করতেন না। তিনি যদি এমন চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকেন তবে কিভাবে তিনি বেহেশতের যুবকদের নেতা হলেন?
৪. মহানবি (সা.) ইমাম হাসানকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি তাকে কাঁধে নিয়ে দোয়া করে বলতেন: "হে প্রভু, আমি তাকে ভালবাসি। তুমিও তাকে ভালবাস।” (তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৮৮)
৫. ইবনে কাছির বলেছেন: হযরত আলী তাঁর সন্তান হাসানকে খুবই সম্মান করতেন। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খ-, পৃ.৩৭)
৬. ইমাম হোসাইন তাঁর ভাই ইমাম হাসানের প্রতি এতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, তাঁর উপস্থিতিতে কখনও কথা বলতেন না। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খ-, পৃ.৩৭)
৭. ইমাম হাসান মদীনায় এতটা সম্মানিত ছিলেন যে, তিনি শাহাদাত বরণ করলে তাঁর জানাযায় মদিনা ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ মদিনায় সমবেত হন। (ইবনে আসাকির, ৮ম খ-, পৃ. ২২৮) তাঁর জানাযায় এত অধিক লোক আসে যে, জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে সুই ফেললেও তা মাটিতে পড়ত না। (আলইছাবাহ ফি মারিফাতিস সাহাবাহ, ১ম খ-, পৃ. ৩৩০।
৮. ইমাম হাসান পদব্রজে আবার কখনো নগ্নপদে পঁচিশ বার আল্লাহর ঘর যিয়ারত (হজ) করেন। (তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৯০)
৯. মারওয়ান বিন হাকাম, যে ব্যক্তি ইমামকে বিরক্ত ও কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে কোন কিছুই বাকী রাখেনি ইমাম হাসান (আ.)-এর ইন্তেকালের সময় তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করে। হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন: আমার ভাইয়ের জীবদ্দশায় তাঁর সাথে আপনি যা মন চেয়েছে তাই করেছেন আর এখন তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করেছেন এবং কাঁদছেন? মারওয়ান উত্তর দেয়, "যা কিছু করেছি তা এমন এক মহান ব্যক্তির সঙ্গে করেছি যার সহনশীলতা এই পাহাড়ের (মদীনার পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে) চেয়েও অনেক বেশি ছিল।”(তারিখুল খুলাফা, পৃ. ১৯১)
১০. আবু তালেব মাক্কি যে ইমাম হাসানের স্ত্রীর সংখ্যা ২৫০জন বলেছেন এবং আবুল হাসান মাদায়েনী ও মুহাম্মাদ ইবনে উমর ওয়াকেদি ৭০জনের কথা বলেছেন, তারা কেন শুধু তাঁর ৮জন স্ত্রীর নাম উল্লেখ করেছেন। তারা তাঁর সন্তানের সংখ্যাও ৭জন থেকে ৩১জন হতে পারে বলেছেন। তবে কি তাঁর এত সংখ্যক স্ত্রীর অধিকাংশই বন্ধ্যা ছিলেন? নাকি তিনি তাদের ব্যয় বহন করা থেকে বিরত থাকতেন বিধায় তাঁরা সন্তান গ্রহণে অনাগ্রহী ছিলেন?
বর্ণনাগুলির পর্যালোচনা
বর্ণনাগুলোর সনদ ও সূত্রগত পর্যালোচনা
১. অধিকাংশ ঐতিহাসিক এ বর্ণনাগুলো কোন সনদ ও বর্ণনাকারীদের ধারার উল্লেখ ছাড়াই বিচ্ছিন্নসূত্রে বর্ণনা করেছে। যেমন, ইবনে আসাকির বর্ণনাকারীদের ধারার উল্লেখ ছাড়াই সরাসরি বলেছেন: মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন এরূপ বর্ণনা করেছেন, এ সম্পর্কে মিরখান্দ শাফেয়ী লিখেছেন: এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, হাসান ইবনে আলী…(রওজাতুস সাফা, ৩য় খণ্ড, পৃ.২০) সূয়ুতী কোনরূপ সূত্র উল্লেখ ছাড়াই বলেছেন: হাসান ইবনে আলী বারবার বিয়ে করতেন (তারিখুল খোলাফা, পৃ. ১৯১); আবু তালেব মাক্কিও বলেছেন: হাসান পুনঃপুনঃ বিয়ে করতেন…; সিবতে ইবনে জাওযি বলেছেন: এক বর্ণনায় এসেছে হাসান…(তাযকিরাতুল খাওয়াছ, পৃ.১২১); আবুল হাসান মাদায়েনী এভাবে বলেছেন: হাসান অধিক বিয়ে করতেন।
এ বর্ণনাগুলো থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, তারা সকলে কোনরূপ সূত্র উল্লেখ ছাড়াই বিষয়টিকে মুরসাল বা বিচ্ছিন্ন ও কর্তিতরূপে তাদের গ্রন্থ এনেছেন। তাই এ বর্ণনাগুলো মূল্যহীন বলে গণ্য।
২. উপরিউক্ত বর্ণনাগুলো ও এসম্পর্কিত অন্য সকল বর্ণনা মূলত তিনজন ঐতিহাসিকের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। আর তারা হল আবুল হাসান মাদায়েনী, আবু তালেব মাক্কি ও মুহাম্মাদ ইবনে উমর ওয়াকেদি এবং তারাও এ বিষয়টি সনদ ও সূত্র ছাড়াই উল্লেখ করেছেন। রিজালশাস্ত্রবিদরা বর্ণনার ক্ষেত্রে এ তিন ঐতিহাসিকের দুর্বল হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। যাহাবি (মিযানুল ইতিদাল, ৩য় খণ্ড, পৃ.১০৭), ইবনে হাজার আসকালানী (লিসানুল মিযান, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৮৬), ইবনুল জাওযী(আলমুন্তাযাম, ৭ম খণ্ড, পৃ.১৮৯), ঈমাদ হাম্বালী(শাযারাতুয যাহাব, ৩য় খণ্ড, পৃ.১২০); রাযি(আলজারহ ওয়াত তা’দিল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২১); ইবনুল আছির জাযারী(আল কামিল ফিত তারিখ, ৯ম খণ্ড, পৃ.৪৪), যারকুলি (আলআ’লাম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৬০) প্রমুখ রিজাল ও হাদিশাস্ত্রবিদরা ঐ তিন ঐতিহাসিককে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন।
৩. ঐ তিন ঐতিহাসিকও যে ব্যক্তিদের থেকে বর্ণনা করেছেন তারা হয় বনি উমাইয়ার গোঁড়া সমর্থক অথবা দুর্বল, অজ্ঞাত ও অপ্রসিদ্ধ। যেমন, ঐতিহাসিক মাদায়েনী তার গ্রন্থে ইমাম হাসানের বিয়ের বিষয়টি আওয়ানাহ থেকে বর্ণনা করেছে যে বনি উমাইয়ার পক্ষে হাদিস জাল করত। (লিসানুল মিযান, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৮৬) এ হাদিসের অন্যান্য বর্ণনাকারী যেমন জাফর ইবনে হেলাল, আসেম ইবনে সুলায়মান আহওয়াল ও ইবনে উসমানকে যাহাবি দুর্বল বা অপরিচিত রাবি বলেছেন((মিযানুল ইতিদাল, ১ম খণ্ড, পৃ.৪৩০; ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৫০; ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৯৮)
রিজালশাস্ত্রবিদ ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন, মাদানিদের থেকে বর্ণিত ওয়াকেদির সকল বর্ণনাতেই অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীদের উপস্থিতি রয়েছে বলেছেন।(তাযকিরাতুল হুফফায, ১ম খণ্ড, পৃ.৩৮৪)
হাশেম মারূফ আলহাসানী লিখেছেন:ঐতিহাসিক মাদানী বনি আব্বাসের সমসাময়িক এবং সে মিথ্যাবাদি ও হাদিস জালকারী। যাহাবি তার মিযানুল ইতিদাল গ্রন্থ-এ বলেছেন: মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ তার সহীহ (মুসলিম) গ্রন্থে মাদায়েনী থেকে হাদিস গ্রহণ করেন নি,ইবনে আদী তাকে দুর্বল বলেছেন। ইবনু হাজার আসকালানী বলেছে,‘সে (মাদায়েনী) উমাইয়া বংশের আবদুর রহমান ইবনে সামারাহ ইবনে হাবিবের দাসদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার অধিকাংশ বর্ণনা সূত্রহীন অথবা বর্ণনাকারীদের ধারায় বিচ্ছিন্নতার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।’ এ ত্রুটিগুলো প্রমাণ করে যে, ইমাম হাসানের বহুসংখ্যক স্ত্রী থাকার বর্ণনাগুলো তাঁর শত্রুদের দ্বারা জালকৃত। আর তাই কোনক্রমেই তা সঠিক হতে পারে না।