bayyinaat

Published time: 05 ,March ,2017      19:47:12
প্রবন্ধ
ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন বর্তমান বিশ্বের ইসলামী পুনর্জাগরণের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ২২৫ কি.মি. দক্ষিণে খোমেইন শহরে ১৯০১ সালের ২৩ অক্টোবর এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুস্তাফা মুসাভী একজন বিশিষ্ট মুজতাহিদ ছিলেন...
সংবাদ: 11

ইমাম খোমেইনী

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন বর্তমান বিশ্বের ইসলামী পুনর্জাগরণের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি এমন এক সফল বিপ্লবের নায়ক যে বিপ্লবের ঢেউ লেগেছিল সারা বিশ্বে। এ বিপ্লব সারা বিশ্বের মুমিনদের কাছে সত্যিকার ইসলামকে তুলে ধরে। দলে দলে মানুষ সত্য পথের সন্ধান পেয়ে এর ছায়ায় আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক মুমিন ব্যক্তি এ বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেরা যেমন সত্যকে গ্রহণ করেছেন তেমনি এদেশের মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শন করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ২২৫ কি.মি. দক্ষিণে খোমেইন শহরে ১৯০১ সালের ২৩ অক্টোবর (১৩২০ হিজরীর ২০ জমাদিউস সানি) এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুস্তাফা মুসাভী একজন বিশিষ্ট মুজতাহিদ ছিলেন। ভূ-স্বামীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার কারণে তাঁকে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইমাম খোমেইনীর প্রপিতামহ সাইয়্যেদ আলী দীন শাহ কাশ্মীরের একজন বিশিষ্ট আলেম ছিলেন। তাঁর মাতামহ আয়াতুল্লাহ্ মির্জা আহমদ ছিলেন একজন বিখ্যাত মুজতাহিদ।

ইমামের শিশুকালেই তাঁর পিতা শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান। তিনি তাঁর ফুপু ও বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন। তাঁর বড় ভাই আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ মুর্তাজাও একজন প্রাজ্ঞ ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন।

ইমাম খোমেইনী ছোটবেলা থেকেই প্রখর বুদ্ধিমান ও মেধাবী ছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে সম্পূর্ণ কোরআন পড়া শেষ করে আরবী সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। এরপর বড় ভাইয়ের কাছে তিনি যুক্তিবিদ্যা, আরবী ব্যাকরণ শিক্ষালাভ করেন।

১৯ বছর বয়সে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য আরাকে গমন করেন। সেখানে আয়াতুল্লাহ্ গোলপায়গানীর কাছে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর পর আয়াতুল্লাহ্ হায়েরীর সাথে কোমে চলে আসেন। সেখানে ১৫ বছর তিনি আয়াতুল্লাহ্ হায়েরীর দারসে খারেযে যোগ দেন। তখন তিনি নিজেও বিভিন্ন বিষয়, যেমন আইনশাস্ত্র, ইরফান, দর্শন ইত্যাদি শিক্ষাদান করতেন।

আয়াতুল্লাহ্ হায়েরীর ইন্তেকালের পর কোমে আসেন আয়াতুল্লাহ্ বরুজারদী। ইমাম তাঁর ক্লাসে যোগ দিতেন। তিনি আয়াতুল্লাহ্ আলী আকবর ইয়াযদীর কাছে জ্যোতির্বিদ্যা এবং মরহুম শায়খ মুহাম্মদ আলী শাহবাদীর কাছে দর্শন ও রহস্যজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেন। এভাবে অল্প সময়েই মধ্যেই তিনি ধর্মতত্ত্ব, ইসলামী আইন, হাদীস ও তাফসীর শাস্ত্র, রহস্যজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে একজন আসামান্য পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। এর পাশাপাশি বিশ্বে প্রচলিত অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানেও তিনি বেশ পারদর্শিতা অর্জন করেন।

তিনি এসবের পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেন। রিয়াজত, মুশাহাদা, মোরাকাবাতের মাধ্যমে তিনি তাযকীয়ায়ে নাফসের উঁচু স্তরে পৌঁছে যান। তিনি ২৭ বছর বয়সে দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি উসূল ফিকাহশাস্ত্র, দোয়া হাদীসের ব্যাখ্যা, আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, রাজনীতি, আইন সমাজ,  নামাজের হকিকত রহস্য ইত্যাদি বিষয়ে চল্লিশের অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন

অন্যান্য আলেমদের তুলনায় তাঁর সফলতা

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর সফলতার কারণ ছিল ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের পূর্বে ফকীহ-মুজতাহিদের কর্তব্য সম্পর্কে তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা। এ বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬৩ সালের পূর্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ না হওয়ার পেছনে প্রকৃত কারণ ছিল এটাই। কেননা এ সময় তিনি আলেম সমাজের মধ্যে এক চিন্তাগত নীরব বিপ্লব সাধন করছিলেন।

ধর্মতত্ত্ববিদদের ধারণা ছিল ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে ফকীহ-আলেমগণ সমাজের ছোট-খাট সংস্কার করতে পারেন; অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। তাঁদের কাজ হলো বড় জোর ধর্মীয় ফতোয়া ও সংগ্রামের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীকে কিছুটা সংযমী করা, দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা- এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু ইমাম খোমেইনী (রহ.) বুঝিয়ে দেন : ইমাম মাহদী (আ.) বিশ্ব-বিপ্লবের নায়ক হবেন, সন্দেহ নেই; কিন্তু তাঁর সর্বাত্মক বিপ্লবের পূর্বে দেশে দেশে ফকীহ আলেমদের উচিত তাঁর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং কোরআনের আইন জারীর চেষ্টা করা।

তাঁর কথা ছিল সাম্রাজ্যবাদীরা এ ভুল ধারণা আমাদের মধ্যে ছড়িয়েছে যে, ইসলামে সরকার গঠনের বাধ্য-বাধকতা নেই। ইসলামের বিধান তো রয়েছে, সরকার না হলেও ইসলামী শরিয়ত চলতে থাকবে। তাই ইসলামী হুকুমত কায়েমের প্রয়োজন নেই।

তিনি বলেন, "নবী (সা.) যে রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন তাঁর পর তাকে অব্যাহতভাবে চালিয়ে নেয়ার জন্য খলীফার পদ নির্দিষ্ট করেছেন। খলীফার কাজ কি শুধু আইন বর্ণনা-বিশ্লেষণ ও প্রচার করার জন্য? তাহলে তো খলীফার দরকার নেই। খলীফার পদ আইন কার্যকর করা। কার্যকর নির্বাহী ব্যবস্থা না থাকলে আইন কার্যকর হতে পারে না। আইন কার্যকর করার জন্য নির্বাহী কর্তৃত্ব একান্ত আবশ্যক।”

তিনি বলেন, "রাজনীতি ও ধর্ম আলাদা নয়। রাসূলের সময় কি তা ছিল? খোলাফায়ে রাশেদীন বা ইমাম আলী (আ.)-এর সময় কি তা ছিল?

আসলে সাম্রাজ্যবাদীরা চেয়েছে মানুষের জীবন থেকে ইসলামকে নির্বাসিত করতে, বাস্তব জীবনে দীন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধকে নিঃশেষ করতে এবং ফলশ্রুতিতে জনগণের সাথে আলেমদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। কেননা আলেমরাই ইসলামের প্রকৃত বিপ্লবী রূপের সাথে পরিচিত এবং তারাই জনগণকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত রাখতে সর্বদা চেষ্টা করে যাচ্ছে। ধর্ম-রাজনীতি পৃথক হলে জনগণের উপর আলেমদের প্রভাব কমত, সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বাড়ত, আর তারা ধন-সম্পদ লুটে নিতে পারত।

তিনি বলেন, "শুধু নামায, রোযা, যিকির নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা পরিত্যাগ করলে তারা কখনই আমাদের সাথে বিবাদ বাধাতে আসবে না। সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ না করে শুধু জ্ঞান শিক্ষাদান, আইন-কানুন পাঠ করলে তাদের সাথে সংঘর্ষের কোন আশংকা থাকবে না। নামায নিয়ে তো ওদের মাথা ব্যথা নেই। ওরা চায় খনিজ সম্পদ।”

তিনি বলেন, "গোটা জগৎটাই তো রাজনৈতিক। এখানে রাজনীতি না করলে টিকে থাকাই তো সম্ভব নয়।”

ইমাম বলেন, "ইমাম মাহদী (আ.)-এর অবর্তমানে আইন সংক্রান্ত জ্ঞান এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষকেই শাসক নিয়োগ করতে হবে। এরকম প্রচুর আলেম পাওয়া যাবে। এরা সকলে এক হয়ে কাজের সংকল্প করলে একটি তুলনাহীন বিশ্বজনীন ন্যায়বাদী রাষ্ট্র কায়েম করা খুব সহজেই সম্ভব হবে।”

সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদী শক্তিসমূহের স্বরূপ উদ্ঘাটন

ইসলামপন্থী দল ও আন্দোলনগুলোর নেতারা মনে করতেন নাস্তিক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে অস্তিক মার্কিনীরা ভালো এবং তাদের দিক থেকে ইসলামের উপর আঘাত আসবে দেরীতে বা নাস্তিকদের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন লাভ করা যাবে।

কিন্তু ইমাম খোমেইনী বুঝেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত মোটেই শক্তিশালী নয়; বরং অতি শীঘ্রই কমিউনিজমের পতন ঘটবে। আর এ জন্যই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শয়তানে বোযোর্গ’ বা ‘বড় শয়তান’ আখ্যা দিয়েছিলেন। একই সাথে তিনি জানতেন যে, সাম্রাজ্যবাদের অভিজ্ঞতার আলোকে সব সময়ই গ্রেট বৃটেন মার্কিনীদের পদলেহী হয়ে থেকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে যাবে। এজন্যই তিনি গ্রেট বৃটেনকে ‘শয়তানে পীর’ বা ‘বুড়ো শয়তান’ নামে অভিহিত করেছিলেন।

রাজনৈতিক দর্শন

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর চেষ্টার লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন এবং রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যকার তথাকথিত ব্যবধান ঘুচানো। তিনি এমন এক সময় এ দর্শন ব্যক্ত করেছিলেন যখন সারা বিশ্বে প্রচার চালানো হচ্ছিল যে, ধর্মীয় রাষ্ট্রের যুগ শেষ হয়ে গেছে এবং তা মধ্যযুগীয় একটি দর্শন ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু ইমাম খোমেইনী এ ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত করে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম করেন যা এখনও বিদ্যমান।

মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দ্য সৃষ্টি

মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির মনোভাব সৃষ্টি করার জন্য ইমাম মুসলমানদের ঐক্যের উপর জোর দিতেন। রাসূলের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে যেন মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হয় সেজন্য তিনি ১২ থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল ‘ঐক্য সপ্তাহ’ পালনের আহ্বান জানান।

ইসরাইল কর্তৃক দখলকৃত মসজিদুল আকসাকে মুক্ত করার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে যেন মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠে সেজন্য তিনি রমযান মাসের শেষ শুক্রবার ‘আল কুদ্স’ দিবস পালন করার আহ্বান জানান।

পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন

এখন আমি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু কথা বলব যা থেকে আমাদের জন্য অনেক কিছুই শিক্ষণীয় আছে।

ইমাম খোমেইনী খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তাঁর ঘরে একটি টেলিভিশন, একটি রেডিও, একটি পড়ার বই এবং অনেক বই-পুস্তক ছিল। কোন বিলাস সামগ্রী তাঁর বাড়িতে ছিল না।

তিনি তাঁর স্ত্রী-পুত্র-পরিজনদের খুব ভালোবাসতেন। স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। একই সাথে খাবার খেতেন। স্ত্রীর জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতেন। স্ত্রীকে পছন্দমতো জিনিস কেনার, বান্ধবী ও পরিচিতজনদের সাথে মেলামেশা করার ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। শুধু এতটুকু বলেছিলেন যেন তিনি ধর্মের অনুশাসন মেনে চলেন। অসুস্থাবস্থায় অথবা কোন জায়গায় সফরে যাওয়ার সময় স্ত্রীর নিকট হতে ক্ষমা চাইতেন এবং তিনি সন্তুষ্ট আছেন কিনা জানতে চাইতেন।

স্ত্রীকে উত্তম আসনে বসাতেন। ঘরে থাকা অবস্থায় বাসনপত্র, কাপড়-চোপড় নিজে ধুতেন। তাই যখন তিনি ঘরের বাইরে থাকতেন তখন তাঁর স্ত্রী ধোয়ার কাজ সেরে ফেলতেন।

তাঁর এক মেয়ে একবার তাঁকে স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি আমার জন্য যতটুকু আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন এবং যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা অন্য কেউ করতে পারেনি। তুমি যদি এ মহিলার মতো হয়ে থাক তাহলে তোমার জীবনসঙ্গীও তোমাকে এভাবেই ভালোবাসবে।

তিনি সন্তানদের প্রতি খুবই স্নেহশীল ছিলেন। মাঝে মাঝে সন্তানদের অগোচরে রান্নাঘরে ঢুকে চা বানিয়ে আনতেন যা দেখে তাঁর সন্তানরা লজ্জা পেতেন। ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীদের সাথে গল্প করতেন। পরিবারের সদস্যদের সমস্যা শুনে সেগুলোর সমাধানের ব্যবস্থা করতেন।

তিনি নিজের কাজ নিজেই করতেন এবং যতদূর সম্ভব অন্যদের সাহায্য নিতেন না। কখনো কলম বা অন্য কোন জিনিস উপর তলা হতে আনতে হলে তিনি নিজেই গিয়ে তা নিয়ে আসতেন। কাউকে তা আনার জন্য হুকুম করতেন না।

গৃহের খাদেমদের প্রতিও তিনি একই আচরণ করতেন যা তিনি নিজ সন্তানদের সাথে করতেন। খাদেমদের কাজে সাহায্য করতেন। কোন কাজকেই তিনি ছোট মনে করতেন না।

একবার ইমাম তাঁর আরো কতিপয় সঙ্গী-সাথীসহ মাসহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করতে যান। সেখানে তাঁরা একটি হোটেলে অবস্থান করেন। ইমাম মাযার যিয়ারত করে তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে আসেন। তাঁর সঙ্গী-সাথীরা একটু অবাক হন যে, ইমাম মাযার যিয়ারত এত সংক্ষিপ্ত করলেন কেন। কিন্তু যখন তাঁরা হোটেলে ফিরে আসেন তখন বুঝতে পারেন ইমাম বাথরুমগুলো পরিষ্কার করার জন্যই তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিলেন।

ইমাম মাঝে মাঝেই লোকজনের সঙ্গে রসিকতা করতেন। ইমামের রসিকতায় লোকজন আনন্দিত হতো। কিন্তু ইমাম তাঁর গাম্ভীর্য বজায় রেখে সর্বাবস্থায়ই শান্ত থাকতেন।

অপচয়ের ব্যাপারে খুবই সাবধান ছিলেন। অতিরিক্ত বাতি জ্বালানো থাকলে তিনি নিজেই গিয়ে সেগুলো নিভিয়ে দিতেন।

ইমাম খোমেইনী ও ইসলামী বিপ্লব

১৯৬৫ সালের অক্টোবরে তুরস্ক সরকার তাঁকে ইরাকের নাজাফে প্রেরণ করে। সেখানে তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। তিনি সেখান থেকে তাঁর বাণী ইরানে প্রেরণ করতেন এবং আলেমরা তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতেন।

ইমাম খোমেইনীকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোস্তফা খোমেইনীকে ১৯৭৭ সালের ২৩ অক্টোবর বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।

১৯৭৮ সালের ৭ জানুয়ারী ইমাম খোমেইনীর মর্যাদা নষ্ট করে পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ইমামকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং তিনি বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থার দালাল বলে উল্লেখ করা হয়।

এর প্রতিবাদে কোমে বিক্ষোভ হয় এবং ২০০ লোক শাহাদাত বরণ করেন। কোমের শহীদদের স্মরণে তাবরীজে বিক্ষোভ হয়। এতে ৫০০ জন শহীদ হন। এরপর ইরানের প্রতিটি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। শত শত লোক শহীদ হন।

১৯৭৮ সালের মুহর্‌রম মাসে লাখ লাখ মানুষ তেহরানের রাস্তায় নেমে আসে। নিরস্ত্র জনতা কাফনের কাপড় পড়ে মেশিনগান সজ্জিত সেনাবাহিনীর সামনে ছুটে যেতে থাকে। ৮ সেপ্টেম্বর ৫০০০ লোক শাহাদাত বরণ করেন।

অক্টোবর মাসে ইমামকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও ইমাম কোন মুসলিম দেশে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কোন মুসলিম দেশ ইমামকে গ্রহণ করতে রাজী হয়নি। তাই তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান।

সেখান থেকে ইমামের বাণী রেকর্ড করে ইরানে প্রেরণ করা হতো। তেহরানের বহু লোক ফোনে সরাসরি তাঁর কথা রেকর্ড করে রাখতেন। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তাঁদের ছাত্রদের মাধ্যমে গ্রাম-গ্রামান্তরে তা পৌঁছে দিতেন।

১৯৭৮ সালের ৪ নভেম্বর তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ইমামকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে মিছিল করে। শাহের বাহিনী এ মিছিলের উপর গুলি করলে ৬৫ জন ছাত্র শহীদ হয়।

এরপর মুহর্‌রম ৯ ও ১০ তারিখ (১৯৭৯) পুনরায় বিক্ষোভ হয়। ইমাম তাঁর প্রেরিত বাণীতে বলেন: ‘মুহর্‌রম হলো তরবারির উপর রক্তের বিজয়ের মাস’

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সারা দেশে কার্ফু ঘোষণা করা হয়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে যে, কার্ফু মানা হবে না। তাই তা প্রত্যাহার করা হয়। প্রায় ৫০ লক্ষ লোক মিছিল করে উত্তর তেহরানের দিকে ধাবিত হয়। তারা শাসকদের ভবনগুলোতে তালা লাগিয়ে দেয়। শাহ বুঝতে পারে আর টিকে থাকা সম্ভব নয়। সে কট্টর ধর্মবিরোধী নেতা শাপুর বখতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে। সে শাহকে নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়। শাহ পালিয়ে যাবার সময় বলে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু দিন বেড়িয়ে আসি।

শাহ আমেরিকায় কিছুদিন অবস্থান করে। আমেরিকার সরকার তার নিরাপত্তার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে। সে মিশরে আনোয়ার সাদাতের আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই মারা যায়।

ইমামকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণ বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। কিন্তু শাপুর বখতিয়ার এ দাবিকে উপেক্ষা করে। ইমাম বখতিয়ারের অনুমতি ছাড়াই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। বিমান বন্দরে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। ইমামকে এ ব্যাপারে অবহিত করার পরও তিনি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ফ্লাইটে দেশে ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

শাপুর বখতিয়ার বিমান বন্দর বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও বিমান বন্দরের কর্মচারীরা তা উপেক্ষা করে ইমামের বিমান অবতরণের ব্যবস্থা করে দেয়। এভাবে ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ইমাম বিজয়ীর বেশে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রায় ৬০ লক্ষ লোক তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়।

এর দশদিন পরই বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষ বর্ষে এক অবিস্মরণীয় বিপ্লব সংঘটিত হয় যা সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদীদের হাতকে চিরতরের জন্য ইরানের ভূমি থেকে কর্তন করে। এ বিপ্লব পাশ্চাত্যের আগ্রাসী শক্তির টনক নড়িয়ে দেয়। নানাভাবে তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

ফলে বিপ্লবের পরপরই খুব কম সময়ের মধ্যেই আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মোতাহ্‌হারী, আয়াতুল্লাহ্ তালেকানী, আয়াতুল্লাহ্ বেহেশতীসহ বিপ্লবের প্রথম কাতারের ৭৩ জন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে শহীদ করা হয়। বোমা বিস্ফোরণে শহীদ করা হয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী ড. জাভেদ বাহোনারকে। আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ীকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়। অবশেষে তারা সাদ্দাম নামক এক রক্তপিপাসু শাসককে ইরান আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করে এবং সকল ধরনের মারণাস্ত্র ও সামরিক সাহায্য দিয়ে আট বছর ধরে ইমাম খোমেনীর বিপ্লবী সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। কিন্তু যে বিপ্লব ধ্বংসের জন্য এত প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবাণীতে আজও তা টিকে আছে এবং ইমাম মাহদী (আ.)-এর হাতে এ বিপ্লবের পতাকা তুলে দেয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে ইনশাল্লাহ্। আমরা তাঁর আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে আজকের এই আলোচনা শেষ করছি।

 

মূল: মো. আশিফুর রহমান

 সম্পাদন: আবুল কাসেম