bayyinaat

Published time: 26 ,November ,2018      23:12:51
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে খেজুর গাছের পরাগায়নের হাদিস (১)
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে খেজুর গাছের পরাগায়নের হাদিস (১) সারাংশ: অকাট্য ও মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহ, নির্ভরযোগ্য হাদিসসমূহ ও ঐতিহাসিক যুক্তির বিপরীতে এমন কোন হাদিস যা রাসূল থেকে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত তার বিষয়বস্তুর কোন মূল্য নেই। খেজুর গাছের পরাগায়নের হাদিস এমনই এক প্রত্যাখ্যানযোগ্য হাদিস।
সংবাদ: 132

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে খেজুর গাছের পরাগায়নের হাদিস (১)

লেখক: আবুল কাসেম     

                                                     سُبْحَانَ الَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُونَ

সারাংশ: অকাট্য ও মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহ, নির্ভরযোগ্য হাদিসসমূহ ও ঐতিহাসিক যুক্তির বিপরীতে এমন কোন হাদিস যা রাসূল থেকে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত তার বিষয়বস্তুর কোন মূল্য নেই। খেজুর গাছের পরাগায়নের হাদিস এমনই এক প্রত্যাখ্যানযোগ্য হাদিস।

ট্যাগ: খেজুর গাছের পরাগায়নের হাদিস, মহানবী (সা.)-এর নিষ্পাপতা ও নির্ভুলতা, পবিত্র কোরআন, হাদিসগত দলিল, বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল

ইসলামে মহানবী (সা.)-এর নিষ্পাপতা ও নির্ভুলতার বিষয়টি ইসলামের শিক্ষা ও বাণীর ওপর ব্যাপক ও গভীর প্রভাব রাখে। ইসলামের অনুসারীদের একাংশ মহানবী (সা.)-এর নিরঙ্কুশ নির্ভুলতায় বিশ্বাসী এবং তাঁর এ নির্ভুলতার বিষয়টিকে নিছক শরীয়তের বিধিবিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করে না। এক্ষেত্রে মুসলমানদের বড় অংশটি কোন কোন হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত একটি হাদিসের (খেজুরের পরাগায়ন সম্পর্কে রাসূলের অজ্ঞতা) ভিত্তিতে মহানবীর নির্ভুলতার বিষয়টিকে ও এর ফলশ্রুতিতে পার্থিব বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তের সঠিকতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে এবং তাঁর জ্ঞান ও শিক্ষার মধ্যে ভুলের সম্ভাবনাকে অপরিহার্য জ্ঞান করেছে। এ প্রবন্ধে আমরা পবিত্র কোরআন, হাদিস, ইতিহাসগত এবং বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতে রেওয়ায়েতটির পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে রাসূল (সা.)-এর শিক্ষায় ভুলের সম্ভাবনার বিষয়টিকে যাচাই এবং তাঁর বাণী ও কর্মের নির্ভুলতার সীমা নির্ধারণ করব।

খেজুর গাছের পরাগায়নের হাদিস

এ হাদিসটি যা حديث تأبير النخل বা حديث تلقيح النخل নামে প্রসিদ্ধ, আহলে সুন্নাতের বেশকিছু হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যাতে বলা হয়েছে যে, মহানবী (সা.) মদীনায় প্রবেশ করে দেখলেন মদীনাবাসীরা পুরুষ খেজুর গাছের ফুলের গুচ্ছকে স্ত্রী গাছের ফুলের ওপর ঝাঁকায় যাতে এর রেণুগুলো স্ত্রী গাছের ফুলগুলোকে পরাগায়িত করে। এটা দেখে তিনি তাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন এটা তারা না করে বরং বাতাসের মাধ্যমেই যেন পরাগায়ন সংঘটিত হতে দেয়। তখন বাগানমালিকরা তাঁর পরামর্শ মতো তা থেকে বিরত থাকল। কিছুদিন পর তারা দেখল গাছগুলোতে কোন খেজুর ধরে নি। ফলে তারা অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়ে তাঁর নিকট অভিযোগ করল। তিনি এতে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন : ‘আমি পার্থিব বিষয়ে তোমাদের থেকে অধিক কিছু জানি না। যদি আমি পার্থিব বিষয়ে তাদের এমন পরামর্শ দেই যা তাদের উপকার সাধন করে তবে তারা যেন তা করে। কারণ, ঐ সম্পর্কে আমার এটা নিছক ধারণাপ্রসূত। তাই তা গুরুত্বের সাথে নিও না। কিন্তু যদি কোন কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে বলি তবে সে অনুযায়ী কাজ করো। কেননা, আমি আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করি না।’ (আহমাদ ইবনে হাম্বাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬২, হাদিস ১৪১২)

মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ হাদিসটিকে কিছুটা পার্থক্যসহ এভাবে বর্ণনা করেছেন: রাসূল (সা.) একদল লোকের মুখোমুখি হলেন যারা খেজুর গাছকে পরাগায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করত। তিনি তাঁর দৃষ্টিতে এ কাজটি অর্থহীন বলে তাদের জানাতে বললেন। তারা এটা জেনে এ কাজ থেকে বিরত থাকল। তারপর মহানবী (সা.) তাদের খবর দিলেন যে, যদি ঐকাজ উপকারী হয়, তবে তারা তা করতে পারে। কারণ, এ সম্পর্কে তাঁর মতটি একটি সম্ভাব্য ধারণামাত্র। হয়তো এতে ভুলের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সংবাদ দেন, তা অনুসরণ করা ফরয ও অপরিহার্য। (দ্রষ্টব্য: সহীহ মুসলিম, ৭ম খণ্ড, কিতাবুল ফাযাইল, বাবু উজুবিল ইমতিছাল, পৃ. ৯৭, হাদিস ৪৩৫৭)

এ হাদিসটিতে নবীর কথা অনুযায়ী খেজুর গাছে পরাগায়ন না করার পরিণতিতে কী ঘটেছে তা বলা হয় নি। কিন্তু ইবনে মাজাহ যে হাদিসটি হযরত আয়েশা থেকে বর্ণনা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, যখন লোকেরা রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ মতো পরাগায়নের কাজ থেকে বিরত থাকল তখন সব খেজুর গাছের ফল নষ্ট হয়ে গেল। তখন তিনি (সা.) বললেন : ‘আমি যদি পার্থিব কোন বিষয়ে তোমাদেরকে কিছু বলি সেক্ষেত্রে তোমাদের স্বাধীনতা রয়েছে (তোমরা তা গ্রহণ বা পরিত্যাগ করতে পার) আর যদি দ্বীনের কোন বিষয়ে বলি, তবে তার দায়িত্বভার আমার ওপর বর্তাবে।’ (ইবনে মাজাহ কাযভিনী, ২য় খণ্ড, বাবু তালকিহুন্নাখ্ল, হাদিস ২৪৬১, পৃ. ৮২৫)

হাদিসটির ওপর একটি পর্যালোচনা

এ হাদিসটিকে নবী করিম (সা.)-এর সুন্নাতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করা যায়। কারণ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, বিচারগত ও সামরিকসহ সকল বিভাগে তাঁর সিদ্ধান্ত ও মীমাংসাকে অনির্ভরযোগ্য ও প্রশ্নের সম্মুখীন এবং ঐ সকল ক্ষেত্রে তাঁর বাণী ও কর্মকে অগ্রহণীয় করে ফেলে। এ হাদিস মূলত ইসলামকে আখেরাত ও নৈতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসের পথকে সুগম করে। ফলে খ্রিস্টীয় ঐ চিন্তাধারাকে সমর্থন দেয়া হয় যাতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কাজকে আল্লাহর হাতে সমর্পণ কর আর স¤্রাটের কাজকে স¤্রাটের হাতে ছেড়ে দাও।

আহলে সুন্নাতের আলেমরা এ হাদিসগুলোকে দলিল হিসাবে গ্রহণ করে ধর্মীয় বিধানের ক্ষেত্রে মুজতাহিদদের ব্যক্তিমত ও ইসতিহসান বা পছন্দজনিত সিদ্ধান্ত অবৈধ হলেও পার্থিব বিষয়ে সেগুলো বৈধ বলে ফতওয়া দিয়েছেন। যেমন, নাভাভী এ বিষয়ে মন্তব্য করে বলেছেন : ‘আলেমরা মহানবী (সা.)-এর কথার من رأیی -‘আমার নিজস্ব মত থেকে’ অংশের অর্থ দুনিয়া ও পার্থিব জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে, শরীয়তের বিধিবিধানের ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে তিনি তাঁর ইজতিহাদের ভিত্তিতে শরীয়তের বিষয়ে কিছু বলেন তা অবশ্যই পালনীয়। খেজুরের পরাগায়নের বিষয়টি শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত কোন কিছু নয়।’ (নাভাভী, শারহে সহিহ মুসলিম, ১১তম খণ্ড, পৃ. ১১৬)

তাঁর এ বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় আমাদের হস্তগত হয়:

১.     যে সকল বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর বাণী ও কর্মের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিক্ষার সরাসরি সম্পর্ক নেই সেক্ষেত্রে তিনি ভুলের ঊর্ধ্বে নন এবং তা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক নয়।

২.     তাঁর মতে পার্থিব বিষয়সমূহ অভিজ্ঞতালব্ধ একটি বিষয়, আর যেহেতু রাসূল (সা.)-এর এর দায়িত্ব ছিল আল্লাহর মারেফাত ও শরীয়তের বিধান সম্পর্কে জানা সেহেতু তিনি পার্থিব বিষয়ে ততটা আগ্রহী ছিলেন না এবং এক্ষেত্রে কোন অভিজ্ঞতা অর্জনেও সক্ষম হন নি।

আমরা এখন পবিত্র কোরআন, হাদিসশাস্ত্র, বুদ্ধিবৃত্তি ও ইতিহাসের আলোকে হাদিসটি নিয়ে পর্যালোচনা করব।

পবিত্র কোরআনের মানদণ্ডে খেজুরের পরাগায়নের হাদিস

পবিত্র কোরআন হলো ফুরকান ও সকল বিষয়ের সত্যাসত্য যাচাইয়ের ঐশী ও সর্বোৎকৃষ্ট মানদ- এ হাদিসটিকে যদি আমরা পবিত্র কোরআনের সামনে উপস্থাপন করি তাহলে দেখব যে, এ হাদিসের বিষয়বস্তুকে কোরআন সমর্থন করে না। কারণ, প্রথমত, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা‘আলা সূরা রা’দের ৩ এবং সূরা ইয়াসিনের ৩৬ নং আয়াতে সকল ফল ও ফসলের পুং ও স্ত্রী ফুল অথবা পুং ও স্ত্রী বৃক্ষ রয়েছে বলে তাঁর নবীকে অবহিত করেছেন।  সুতরাং কিভাবে বলা যায় যে, তিনি খেজুর গাছের পুং ও স্ত্রী বৃক্ষ আছে তা জানতেন না ও সেগুলোকে চিনতেন না এবং তাদের ফুলের কার্যকারিতা সম্পর্কেও জ্ঞান রাখতেন না।

দ্বিতীয়ত, শুধু এ হাদিসের ভিত্তিতে (যদিও তা বিভিন্নসূত্রে বর্ণিত, কিন্তু ক্ষেত্র ও বিষয়বস্তু একটি) রাসূল (সা.)-এর বাণী ও কর্মকে পার্থিব ও অপার্থিব এবং ঐশী ও ইজতিহাদি এ দুই ভাগে ভাগ করা অন্যায় ও অযৌক্তিক। কেননা, এর সপক্ষে কোরআনের একটি দলিলও বিদ্যমান নেই। বরং পার্থিব ও অপার্থিব সকল বিষয়েই তিনি যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং সকল মুসলমান তা মেনে চলতে বাধ্য তার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেছেন : ‘এবং কোন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর এ অধিকার নেই যে, যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়সালা দান করেন তখন তারা তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; এবং যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে নিঃসন্দেহে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত হয়েছে।’ (সূরা আহযাব : ৩৬)

এর বিপরীতে তিনি যে সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ কোন বিষয়েই মুসলমানদের কথা ও পরামর্শ অনুযায়ী চলতে বাধ্য নন, তার ওপর গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

তোমরা জেনে রাখ, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছে; যদি সে অনেক বিষয়ে তোমাদের কথা মেনে চলে, তবে অবশ্যই তোমরা কষ্টে পড়বে।’ (সূরা হুজুরাত: ৭)

উল্লেখ্য যে, এ আয়াতটি কোন কোন সাহাবী তাঁদের পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করার জন্য তাঁর ওপর পীড়াপীড়ি করতে থাকলে অবতীর্ণ হয়। তাই এখানে মুসলমানদের উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, মহানবী (সা.) যে কোন কাজের জন্য তাদের পরামর্শ চাইতে পারেন। তবে একথা মনে করা ঠিক হবে না যে, তাদের দেয়া উপদেশ ও পরামর্শগুলো গ্রহণ করা ও বাস্তবায়ন করা তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক। তিনি তো আল্লাহর দ্বারা পরিচালিত দিব্য-দৃষ্টির অধিকারী এবং কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব তাঁরই। সকল ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ও প্রশ্নাতীত। এখানে মনে রাখা আবশ্যক, রাসূল (সা.) শরীয়তের ইবাদত সম্পর্কিত বিষয়ে কখনই কারো সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন না। কারণ, এ বিষয় স্বয়ং আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন। তাই তিনি কেবল সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিধিবিধান কার্যকর করার পদ্ধতির বিষয়ে পরামর্শ করতেন। আর আল্লাহ এসব বিষয়েও তাঁর ওপর যেন সাহাবীরা নিজের মত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা না করেন সে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই পার্থিব বিষয়েও মুসলমানদের তাঁর নির্দেশের শতভাগ অনুগত হওয়া আবশ্যক। আর যেহেতু ইসলাম মানুষকে জীবনের পার্থিব ও অপার্থিব সবক্ষেত্রে হেদায়াত করতে চায় সেহেতু আল্লাহ কখনই তাঁর নবীকে পার্থিব বিষয়ে অজ্ঞ রাখতে পারেন না।

বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, রাসূল (সা.) পার্থিব বিভিন্ন বিষয়ে অন্য সকলের চেয়ে জ্ঞানী ছিলেন। যেমন তিনি যে মহাসমরনায়ক ছিলেন- এ বিষয়টি অনেক প্রাচ্যবিদও স্বীকার করেছেন। তাই দেখা গেছে, যুদ্ধের ময়দানে যখনই মুসলমানরা রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ ভঙ্গ করেছে তখনই পরাজয়ের শিকার হয়েছে। ওহুদের যুদ্ধে তারা আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ লঙ্ঘন করার কারণে পরাজয় বরণ করেছে। সূরা আলে ইমরানের ১৫২ আয়াতে আল্লাহ এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন:

নিঃসন্দেহে আল্লাহ (ওহুদ যুদ্ধেও) নিজ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করেছিলেন, যখন তোমরা তাঁর অনুমতিক্রমে (প্রথম আক্রমণে) তাদের নিধন করছিলে; (তাঁর এ সাহায্যের প্রতিশ্রতি ততক্ষণ বলবৎ ছিল) যতক্ষণ না তোমরা দুর্বলতা প্রদর্শন করলে এবং (রাসূলের নির্দেশের ব্যাপারে) পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হলে এবং তার অবাধ্যতা করলে।’

হুদাইবিয়ার সন্ধির ক্ষেত্রেও এ কথাটি সত্য প্রমাণিত হয়। কেননা, মহান আল্লাহ তাঁকে হুদায়বিয়ায় সন্ধি করার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু এ সন্ধির শর্তগুলো কী কী হবে তা তিনি তাঁর রাসূলকে বলে দেন নি। বরং এক্ষেত্রে রাসূল তাঁর প্রতিপক্ষের অনেক আপত্তিকর শর্তও মেনে নেন যা অনেক সাহাবীই প্রথমে মেনে নিতে পারেন নি। ফলে তাঁরা প্রতিবাদ করেন। তাঁদের দৃষ্টিতে এ শর্তগুলো চরম অবমাননাকর মনে হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর দিব্যদৃষ্টিতে এ সন্ধির সুদূরপ্রসারী বিস্ময়কর সুফল এবং এর ফলে ভবিষ্যতে কী কী ঘটতে পারে তা নিশ্চিতরূপে জানতেন। তাই তাঁদের প্রতিবাদে কোন কর্ণপাত করেন নি। আর এ ঘটনাটি মহানবী (সা.)-এর সকল বিষয়ে নির্ভুল সিদ্ধান্তের অধিকারী হওয়ার প্রমাণ বহন করে এবং তিনি যে পার্থিব ক্ষেত্রেও সবার চেয়ে জ্ঞানী ছিলেন তা প্রমাণ করে।

তৃতীয়ত, হাদিসটিতে যে রাসূলের আনুগত্যের ক্ষেত্রে ইসলামকে পার্থিব ও অপার্থিব দিকের বিভাজনে বিভক্ত করা হয়েছে তা বিষয়বস্তুগত দিক থেকেও পবিত্র কোরআন ও সুন্নাতের পরিপন্থী। কেননা, কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও রেওয়ায়েত থেকে প্রমাণিত হয় পার্থিব সকল বিষয়ে-যেমন : রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচার-আইন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অর্থনৈতিক, বৈদেশিক সম্পর্ক ও নীতি...-মহানবী (সা.)-এর সরব পদচারণা ছিল। কারণ, স্বয়ং কোরআন এ বিষয়সমূহে করণীয় দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং তাঁর নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছে যার আওতায় এগুলোও শামিল হবে। অর্থাৎ কোরআন এগুলোকে ধর্মীয় বিষয় থেকে স্বতন্ত্র ও শরীয়ত-বহির্ভূত বলে গণ্য করে নি।

চতুর্থত, মহান আল্লাহ কোন বিষয়েই-পার্থিব বা পারলৌকিক- মুমিনদের রাসূল (সা.)-এর চেয়ে অগ্রগামী হতে নিষেধ করে বলেছেন: ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সম্মুখে তোমরা (কোন বিষয়ে) অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর।’ (সূরা হুজুরাত: ১)

এ আয়াতে মুমিনদের আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তারা সকল বিষয়ে- দ্বীনকে বোঝার ক্ষেত্রে হোক বা আদেশ-নিষেধের পরিপ্রেক্ষিতে হোক- দ্বিধাহীন ও নিঃশর্তভাবে মহানবী (সা.)-এর অনুগত থাকে।  বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত ও মীমাংসা কী হবে তা পূর্ব থেকেই আঁচ করে সে অনুযায়ী কাজ না করে অথবা নিজেদের ইচ্ছাকে তাঁর ইচ্ছার ওপর স্থান না দেয়। মহানবী (সা.) পার্থিব বিষয়ে ভুলের শিকার হলে আল্লাহ মুমিনদের সকল অবস্থায় তাঁর পশ্চাতে থাকার নির্দেশ দিতেন না।

পঞ্চমত, এ হাদিসটির বিষয়বস্তুকে মেনে নিলে নবুওয়াতের মিশনই নিষ্ফল হয়ে পড়বে। কারণ, নুওয়াতের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে হেদায়াত করা। আর হেদায়াতের বিষয়টি সকল ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর নিঃশর্ত অনুসরণের ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহ বলছেন :

সুতরাং তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর সেই রাসূল উম্মী নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর যে স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর বাণীর প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং তাকে অনুসরণ কর যাতে তোমরা হেদায়াত (পথনির্দেশ) পাও।’ (সূরা আ’রাফ: ১৫৮)

এ আয়াতে রাসূলের অনুসরণের নির্দেশটি আল্লাহ ও তাঁর সকল কর্ম ও বাণীর ওপর নবীর বিশ্বাস ও আস্থার কারণে দেয়া হয়েছে। অথচ এ হাদিসে দেখা যায়, রাসূল (সা.) আল্লাহর প্রাকৃতিক সুন্নাতের (মানুষকে খেজুর গাছের পরাগায়ন ঘটাতে হবে) ওপর আস্থা রাখেন না; বরং একে ভুল গণ্য করে বলেন: ما اظن ذالک یغنی شیأ ‘আমি ধারণা করি না যে, এতে কোন লাভ আছে।’ তাহলে তিনি কিভাবে হেদায়াতের ক্ষেত্রে মানুষের বিশ্বাসের পাত্র হবেন? (জাফর সুবহানী, হি. ১৪১৯, ইলাহিয়াত আলা হুদাল কিতাব ওয়স সুন্নাহ ওয়াল আক্ল, পৃ. ১৫৪)

মোটকথা, অকাট্য ও মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহের বিপরীতে ভ্রান্তির সম্ভাবনাযুক্ত কোন হাদিসের (যা রাসূল থেকে বর্ণিত হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত) বিষয়বস্তুর কোন মূল্য নেই।

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: