bayyinaat

Published time: 06 ,December ,2018      09:00:53
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর দৃষ্টিতে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী (২)
বিগত শহীদদের পবিত্র রক্ত ঐ রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সচেতনতা বোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক নয়াসাক্ষ্য ও দৃষ্টান্ত যার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন স্বয়ং ইমাম খোমেইনী (রহ.)ও তাঁর পরে ইমাম খামেনেয়ী তা অব্যাহত এবং মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন।
সংবাদ: 163
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর দৃষ্টিতে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী (২)তৃতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ: তিনি সবসময় লেবাননে হিজবুল্লাহর বিজয়ের কথা বলতেন। কিন্তু ২০০০ সালের পূর্বে তিনি এ বিজয়ের সময় সম্পর্কে কিছু বলতেন না। তিনি কেবল হিজবুল্লাহর বিজয়ের ব্যাপারে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করতেন। পবিত্র কুরআনের ‘তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তবে তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন-এ আয়াতে মহান আল্লাহর উল্লিখিত প্রতিশ্রুতির ওপর তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তিতেই তিনি এ কথা বলতেন। ২০০০ সালে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গেলে তিনি এমন এক কথা বলেন যা আমি প্রথমবারের মত কাউকে বলতে শুনেছি।তিনি বলেন,‘আল্লাহ কারো সঙ্গে কৌতুক করেন না। আল্লাহ সবসময়ইগুরুত্বের সাথে কথা বলেন। তিনি আমাদের সত্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে,যদি আমরা তাঁকে সাহায্য করি তিনিও আমাদের সাহায্য করবেন। হিজবুল্লাহ তার প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে আল্লাহকে সাহায্য করছে ত্ইা অবশ্যই তিনিও তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন।’ খুব স্বাভাবিকভাবে এ কথাটি তিনি বলেছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘ইসরাইলের অবস্থা চোরাবালিতে আটকে পড়া ব্যক্তির ন্যায় হয়েছে যে সামনেও এগুতে পারছে না, আবার পিছিয়েও আসতে পারছে না। সে একদিকে লেবাননে নতুন করে আক্রমণ করতে পারছে না, অন্যদিকে ফিলিস্তিন থেকেও বেরিয়ে আসতে পারছে না। এখন আমরা লক্ষ্য করছি সে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কি করে।
১৯৯৯ সালের শেষের দিকে ইসরাইলে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে ইহুদ বরাক ও নেতানিয়াহু প্রতিদ্বন্দিতা করে। তাদের প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, নির্বাচনে জয়লাভ করলে লেবানন থেকে ইসরাইলী সেনা প্রত্যাহার করবে।ইহুদ বরাক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ২০০০ সালের ৭ই জুলাই এ সেনা প্রত্যাহারের তারিখ নির্ধারণ করে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস অতিক্রান্ত হচ্ছিল এবং সকলেই আশঙ্কা করছিল নির্ধারিত দিন আসলেও দখলকৃত ভূমি থেকে ইসরাইল সৈন্য প্রত্যাহার করবে না। ইহুদ বরাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং আরও কিছু রাষ্ট্রের মাধ্যমে কিছু নিরাপত্তামূলক নিশ্চয়তা কামনা করছিল অথবা লেবাননী প্রশাসন বা সিরিয়ার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল আসাদের সাথে কোন সমঝোতা ও নিরাপত্তা চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু এতে সে ব্যথ্র্ হয়। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তখন সবাই ধারণা করত যে,ইসরাইল কখনই দখলকৃত দক্ষিণ লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে না।এমনকি হিজবুল্লাহর অভ্যন্তরে আমাদের অবস্থাও লেবানন ও অত্র অঞ্চলে বিদ্যমান অন্য সকল রাজনৈতিক শক্তি হতে ভিন্ন ছিল না। আসলে তখন আমরা সবাই একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতাম।
আমরা এহেন পরিস্থিতিতে ইরান সফরে আসি এবং ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ ইমাম আল খামেনেয়ীর সাথে সাক্ষাৎ করে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা সংক্রান্ত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করি। কিন্তু আমাদের কথা শোনার পর তিনি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত ব্যক্ত করেন যা ছিল সত্যি অপ্রত্যাশিত। তিনি উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সামনে বলেছিলেন, ‘লেবাননে আপনাদের বিজয় নিঃসন্দেহে অতি সন্নিকটে। আপনারা যা আশা করছেন তার চেয়েও তা নিকটবর্তী। আপনারা এবিজয় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবেনই।’ তাঁর এ বক্তব্য ছিল সবধরনের বিশ্লেষণ, তথ্য,পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের বিপরীত। এমনকি সেসময় সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যাবলীতেও দক্ষিণ লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সংক্রান্ত ইসরাইলের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্নকরণের কোন ইঙ্গিতও বিদ্যমান ছিল না। কিন্তু তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,‘যখন আপনারা লেবাননে ফিরে যাবেন তখন এ ধরনের বিজয় ও সাফল্যের প্রেক্ষাপটে আপনাদের রাজনেতিক বক্তব্য কী হবে এবং ইসরাইলী শত্রুরা যখন সীমান্তের ওপারে পশ্চাদপসরণ করবে তখন আপনারা কেমন আচরণ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এসব বিষয়ে যেন পূর্ণ প্রস্তুতি থাকে।’
আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গিসহ ইরান সফরে গিয়েছিলাম তা থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। আর এ কারণেই ২৫শে মে ২০০০ সালে লেবানন থেকে ইসরাইলের (নিঃশর্ত) আকস্মিক সেনা প্রত্যাহারে আমরা মোটেও বিস্মিত ও হতবাক হইনি। কারণ এর ভবিষ্যদ্বাণী আমরা পূর্বেই শুনেছিলাম। আর আমরা সীমান্তবর্তী অঞ্চল, ইসরাইলের চর ও এজেন্ট এবং ঐ এলাকার অধিবাসীদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তার জন্য নিজেদেরকে ভালভাবে প্রস্তুত করতে পেরেছিলাম।
চতুর্থ সাক্ষ্য-প্রমাণ: ২০০৬ সালের জুলাই মাসের যুদ্ধ ছিল সার্বিক এক বিশ্বযুদ্ধ ছিল। কারণ পরাশক্তিবর্গ সম্মিলিতভাবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং ইসরাইল তা বাস্তবায়ন করছিল। আর কতিপয় আরব দেশও এক্ষেত্রে ইসরাইলকে সমর্থ্ন করেছিল। এ যুদ্ধের লক্ষ্যই ছিল লেবাননে প্রতিরোধ আন্দোলনের (হিজবুল্লাহর) মূলোৎপাটন। এ যুদ্ধে বিশেষ করে এর প্রথম দিনগুলোয় সবাই ইসরাইলের নৃশংস বর্বরতা প্রত্যক্ষ করেছে। এই সময়যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার বিষয়টিই অভাবনীয় ছিল সেখানে বিজয়ের কথা ভাবা তো পাগলামি ছাড়া কিছু ছিল না। কারণ, লেবানন একটা ছোট দেশ আর তখন সমগ্র বিশ্ব এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং ব্যাপক নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার সাথে এর ওপর হামলা চলছিল।
ঠিক এ সময় (যুদ্ধের প্রথম দিকে)আমাদের এক ভাই ইমাম আল খামেনেয়ীর নিকট থেকে একটি মৌখিক বাণী নিয়ে দক্ষিণ বৈরুতে আসে। উক্ত বাণীতে তিনি বলেছিলেন, ‘হে ভ্রাতৃবৃন্দ, এ যুদ্ধ হচ্ছে খন্দকের যুদ্ধ সদৃশ। খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশ গোত্র, মদীনার ইহুদীরা এবং আরও অন্যান্য আরব গোত্র পূর্ণ শক্তি সহকারে মদীনায় আক্রমণ করে ও মহানবী (সা.)ও সাহাবাদের অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং বিশ্বাসী মুসলিম উম্মাহর মূলোৎপাটন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আপনাদের এ যুদ্ধ উক্ত খন্দকের যুদ্ধের সদৃশ। ঐ যুদ্ধের ভয়াবহতা এত তীব্র হয়েছিল যে তার বিভীষিকায় অনেকের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। এ যুদ্ধেও অচিরেই আপনাদের আশেপাশে অনেকের প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে এবং আপনাদের মধ্যেও অনেকে আল্লাহ সম্পর্কে অনেক ধরনের ধারণা পোষণ করবে। তবে আপনারা সকলে আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। আমি আপনাদের বলছি আপনারা অবশ্যই বিজয়ী হবেন। এমনকি এ যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতেও আপনাদের বিজয় হবে। আমি আপনাদের আরও বেশী কিছু বলব: আপনাদের বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে যখন এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে, তখন আপনারা এমন এক শক্তিতে পরিণত হবেন যার মোকাবেলায় কোন শত্রুই যতই শক্তিশালী হোক দাঁড়াতে পারবে না।’ যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে কার পক্ষে এমন ফলাফল ও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব?
পঞ্চম সাক্ষ্য-প্রমাণ: ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলী বিশেষ করে  আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌবহর প্রেরণ এবং আফগানিস্তান দখলের পর ইরাক দখল সংক্রান্ত হুমকি ইত্যাদির পর সবাই যখন ধারণা করতে লাগল যে, গোটা মধ্যপ্রাচ্য প্রত্যক্ষ মার্কিন আধিপত্যবাদের অধীন হয়ে গেছে যা হয়তো একশ বা দুইশ বছর স্থায়ী হবে। তখন আমি এক সফরে ইরানে যাই এবং ইমাম খামেনেয়ীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর নিকট মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর মতামত জিজ্ঞেস করি। তিনি এমন কিছু বলেছিলেন যা মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।
তখন মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ, সরকার এবং রাজনৈতিক দল কিভাবে মার্কিনীদের নৈকট্য লাভ করা যায় এবং মার্কিন নীতির সাথে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় নীতির সমন্বয় সাধন করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনায় রত হয়। এমনকি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের তদানীন্তন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাও ইমাম খামেনেয়ীর কাছে এসে বলেছিলেন:‘এই নতুন পরিস্থিতিতে আমাদের উচিৎ পরিত্রাণ ও নিস্কৃতির পথ ও উপায় বের করা এবং মার্কিন প্রশাসনের সাথে সংলাপে বসা ও বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করা। কিন্তু তিনি বিদ্যমান বাস্তবতা এবং বর্তমান -ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত স্বচ্ছ কৌশলগত ধারণার ভিত্তিতে তাদের বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে উদ্বেগজনক অবস্থা বিরাজ করছে, এ বিষয়টি আমাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন: ‘সকল ভাইকে বলে দিন যে, আপনারা মোটেও উদ্বিগ্ন হবেন না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (বাড়াবাড়ির) তুঙ্গে পৌঁছে গেছে। আর এটাই হচ্ছে তার পতনের সূচনা। যখনই তারা ইরাক ও আফগানিস্তানে আসবে তখনই তারা জাহান্নামের গভীরে পতিত হবে। এটা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন এবং মধ্যপ্রাচ্যে তার পরিকল্পনা ও নীলনক্সা ব্যথ্র্ হওয়ার শুভ সূচনা মাত্র। তাই এর ভিত্তিতে আপনাদের উচিৎ উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’ তাঁর এ বক্তব্য আসলে গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
এতদসত্ত্বেও আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এটা কিভাবে সম্ভব? বাহ্যিকভাবে পরিস্থিতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত।’ তিনি বলেছিলেন, ‘যখনমধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত মার্কিন পরিকল্পনা ব্যথ্র্ হবে অথবা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অত্র এলাকায় মার্কিনীদের তাবেদার সরকার ও সংস্থাগুলো তার স্বাথ্র্ রক্ষা করতে অক্ষম হবে।এমনকি মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে একর পর এক সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে এবং নৌবহরসমূহ এনেও তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যথ্র্ হবে তখন তারা সারা বিশ্ব থেকে তাদের সকল সামরিক শক্তি ও নৌবহর আনবে। ফলে এটা আর তার শক্তি ও ক্ষমতার প্রমাণ বহন করবে না। এটাই হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার দলিল। আর দ্বিতীয়ত যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের জাতিসমূহের ব্যাপারে মার্কিন শাসক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমকর্তাদের অজ্ঞতারই পরিচায়ক। কারণ অত্র অঞ্চলের জাতিসমূহ সবধরনের জবরদখল এবং আধিপত্যবাদের বিরোধী। তাদের রয়েছে জিহাদ ও প্রতিরোধ সংগ্রামের সংস্কৃতি ও উজ্জ্বল ইতিহাস। একারণেই মার্কিনীরা যখন এখানে (মধ্যপ্রাচ্যে)আসবে তখন তারা কাদা ও চোরাবালিতে নিমজ্জিত হবে এবং হন্যে হয়ে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ খুঁজবে। আর তাই যা হবে ও ঘটবে তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।বরং এ ঘটনা হবে উদ্ধত পরাশক্তিবর্গের আধিপত্যের নাগপাশ থেকে মুসলিম উম্মাহর মুক্তি সংক্রান্ত সুমহান আশাবাদিতারই কারণ।’
এখানে, এ বক্তব্য থেকেই এ সুমহান ইমামের নেতৃত্বের এক অত্যুজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে অভিহিত হওয়া যায় যা অনেকেরই অজানা। আমি আপনাদেরকে বলতে পারি যে, বিগত দশক জুড়ে মুসলিম উম্মাহ এবং মধ্যপ্রাচ্য সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও সর্বনাশা যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্রগণ, বিশ্ব নেতৃবর্গ সকল সামরিক ও গোয়েন্দা শক্তিসহ সকল প্রচার মাধ্যম, প্রযুক্তি এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে সেই সাথে সবধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্য জবরদখলকরার উদ্দেশ্যে এখানে আগমণ করেছে। আর এটাই ‘নয়া মধ্যপ্রাচ্য’ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা। আর এ সময় ইমাম খামেনেয়ী ছিলেন সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়াবহ এ যুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক। উল্লেখ্য যে, এ যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য প্রচুর বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা,তীক্ষ্ণ জ্ঞান ও প্রচ- সাহসের প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এ মহান নেতা যে মহান ভূমিকা পালন করেছেন তার সকল দিক উন্মোচন করা সম্ভব হচ্ছে না।
সর্বশেষ সাক্ষ্য-প্রমাণ: ‘ইসরাইল প্রসঙ্গ’ দিয়ে আমি আমার বক্তব্যের ইতি টানব।
ইমাম খামেনেয়ী বিশ্বাস করেন এই ইসরাইল ধ্বংসোন্মুখ। আর এ বিষয়ে তিনি দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস পোষণ করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে,ইসরাইলের পতন ও বিলুপ্তি দূরবর্তী ও অসম্ভব কোন বিষয় নয়।বরং তিনি তা নিকটবর্তী বলেই মনে করেন। তিনি আরও বিশ্বাস করেন আরব ইসরাইল বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া কখনই কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না।
ফিলিস্তিন ও অত্র অঞ্চলে যা কিছু ঘটছে তা প্রমাণ করে যে, ৬০ বছরের বেশী সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ফিলিস্তিন জাতি প্রতিরোধ সংগ্রামের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। নির্যাতন, যাতনা ও কঠিন দুর্ভোগের পরেও এ জাতি নিরাশ হয়নি ও আন্দোলন থেকে পিছপা হয়নি। তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যর্থ নেতা ছিল ও রয়েছে। তবে যুবকদের এ প্রজন্ম যারা দুর্ভোগ সহ্য করেছে, বিপদগ্রস্ত হয়েছে এবং বিজয়লগ্ন পর্যন্ত তা সহ্য করতে প্রস্তুত রয়েছে তারা অবশ্যই বিজয়ের প্রভাত প্রত্যক্ষ করছে। এ প্রজন্ম দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে যে,আমরা এমন সব ফিলিস্তিনী প্রজন্মের মুখোমুখি যারা অধিকৃত ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তনের এক সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং এক সুমহান ও ব্যাপক উদ্দীপনা সহকারে বেঁচে রয়েছে।
ইমাম খামেনেয়ী ‘ইসরাইল প্রসঙ্গে’ যা বলেন তা আমাদের পক্ষে বেশ সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব। আমরা যখন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনী সেনাশক্তি এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃবর্গের পশ্চাদপসরণের বিষয়টির সাথে অত্র অঞ্চলে প্রতিরোধ সংগ্রামের অনুকূলে সকল পরিবর্তন, আরব-ইসরাইল শান্তি আালোচনার হতাশাজনক পরিণতি,ফিলিস্তিন ও আরব দেশগুলোর যুবকদের আত্মোৎসর্গের চেতনা ও প্রস্তুতির বিষয় বিবেচনা করব এবং এর পাশাপাশি ইসরাইলের অভ্যন্তরে দুর্বলতা, ব্যর্থতা এবং ঐতিহাসিক নেতৃত্বধারার অনুপস্থিতি ও অভাব প্রত্যক্ষ করব (যার ফলে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে হিজবুল্লাহর সাথে ও ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে গাজায় হামাসের সাথে তারা যুদ্ধে পরাজয় ঘটেছিল)তখন আমরাও ইমাম খামেনেয়ীর বিশ্বাসের সাথে একমত পোষণ করে বলব: অচিরেই ইসরাইলের পতন ও বিলুপ্তি ঘটবে ইনশাআল্লাহ।
ইসরাইলের ভবিষ্যত সংক্রান্ত এ ধরনের বাস্তব সত্য দৃষ্টিভঙ্গি ইমাম খামেনেয়ীর সার্বিক ও রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের ভিত্তিমূলসমূহের সঠিকতা থেকেই উৎসারিত; তা বাস্তব ঘটনাবলির সার্বিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ এবং তাঁর দৃঢ়মনোবল ও সাহসিকতার ওপরও প্রতিষ্ঠিত। আপনারা বিবেচনা করে দেখুন যে,সঠিক চিন্তাধারা এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক পর্যবেক্ষণ,পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি কোন নেতা ভীরু হয় তবে সে দুর্বল, অপমানজনক ও নতজানু পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার চিন্তাধারার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে ও পরিবেশ- পরিস্থিতিকে তার শত্রুর অনুকূলে পাল্টে দেবে। এ মহান নেতার সাহস নিঃসন্দেহে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নিয়ামতস্বরূপ। আর এ বিষয়টির প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তাঁর পথে জিহাদে রত সৈনিকদের দিয়েছেন:‘যারা আমাদের জন্য জিহাদ করে আমরা অবশ্যই তাদের আমাদের পথসমূহ দেখিয়ে দিব; আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীল ও পুণ্যবানদের সঙ্গে আছেন।’
আমরা যখন এ সেমিনারের উদ্বোধন করতে যাচ্ছি তখন আমাদের উচিৎ ফিলিস্তিনীদেরকে বিশেষ করে ঐসব সাহসী, প্রতিরোধ-সংগ্রামী অকুতোভয় ফিলিস্তিনী ও সিরীয় যুবকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যারা ইসরাইল কর্তৃক অধিকৃত গোলান উপত্যকার সীমান্তে সমবেত হয়ে শত্রুর ভ্রূকুটিকে তোয়াক্কা না করে তাদের আগ্নেয়াস্ত্রের মোকাবেলায় খালি হাতে প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছে ও কয়েক ডজন শহীদ ও শত শত আহত উৎসগ্র্ করেছে। তাদের এ উদ্যোগটা ছিল এ উম্মতের দৃঢ় সংকল্প ও সিদ্ধান্তের স্পষ্ট অভিব্যক্তি এবং নতুন করে মার্কিন প্রশাসন ও পশ্চিমা সরকারগুলোর বাস্তবস্বরূপ উন্মোচনকারী। এ শহীদদের রক্ত আসলে মার্কিন প্রশাসন এবং এর সকল পদক্ষেপ, উদ্যোগ ও নীতি অবস্থানের ওপর কলঙ্কের কালিমা লেপন করেছে। শহীদদের এ রক্ত ইসরাইলের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা ও নিরঙ্কুশ সমর্থনের কথাই প্রমাণ করে যা সম্প্রতি ওবামা ও মার্কিন কংগ্রেস নেতানিয়াহুর সামনে পুনর্ব্যক্ত করেছে। বরং মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক সব নিয়ম-নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রশাসন বলেছে:‘গতকাল গোলান সীমান্তে যা কিছু ঘটেছে (ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিন ও সিরীয় নাগরিকদের হতাহত করার ঘটনা) তা বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ ব্যতীত আর কিছু নয়।’ অর্থাৎ মার্কিন প্রশাসন এ ঘটনায় কোন নিন্দা তো করেই নি বরং ইসরাইলকে বলেছে:‘আল্লাহ তোমাকে নিরাপদে রাখুন।’
এই হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কিনা আমাদেরকে মানবাধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতার কথা বলে ও শুনায়। গতকালের শহীদদের পবিত্র রক্ত ছিল ঐ রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সচেতনতা বোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক নয়াসাক্ষ্য ও দৃষ্টান্ত যার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন স্বয়ং ইমাম খোমেইনী (রহ.)ও তাঁর পরে ইমাম খামেনেয়ী তা অব্যাহত এবং মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। এগুলো হচ্ছে এ মহান ইমামের বিভিন্ন দিক ও পর্যায়ের একটি দিকের কিছু সাক্ষ্য ও দৃষ্টান্ত মাত্র। আমরা যখন কোন বিজ্ঞ, সাহসী, দক্ষ প্রশাসক নেতার কথা বলব তখন আমাদের এধরনের বাস্তব ঘটনাবলি থেকেই শুরু করতে হবে। তবে এসব বাস্তব ঘটনা আমরা যা জানি এবং যা কিছু এখানে ব্যক্ত করা সম্ভব নয় সেগুলোর মধ্য হতে গুটি কতক মাত্র।
এ যুগে উদ্ভূত বিশেষ ফেতনার প্রেক্ষাপটে এ মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ আলেম ও নেতৃবর্গের সঠিক পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে উম্মাহর সকল চিন্তাবিদ, জ্ঞানী ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তির কাঁধে যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার সামান্য কিছু বাস্তবায়নে যদি আমি সক্ষম হয়ে থাকি তার জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করছি।
 ট্যাগ: ইসলামী ব্যক্তিত্ব, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী, ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা, রাহবার, সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ
অনুবাদ: আবুল কাসেম আনোয়ার

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: