bayyinaat

Published time: 05 ,March ,2017      23:13:29
প্রবন্ধ
বিশ্বের প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমান এক আল্লাহ্‌, এক কোরআন, এক নবী, এক কিবলা, একইরূপ মৌলিক বিশ্বাসের অধিকারী ও ধর্মীয় বিধিবিধানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক মিল থাকা সত্ত্বেও এক উম্মাহর লক্ষ্যে পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছে। যেখানে পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী তারা পরস্পরের ভাই ও পৃষ্ঠপোষক হওয়া উচিত ছিল সেখানে ইসলামের শত্রুদের প্ররোচনায় তারা একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছে...
সংবাদ: 25

ভূমিকা

ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের মৌলিক আহ্বান হচ্ছে: «لا اله الا الله محمد الرسول الله» অর্থাৎ ‘আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ্‌র রাসূল।’ এই তাওহিদী আহ্বানের মধ্যেই ঐক্যের বীজ নিহিত।

ইসলামের আগমনের পূর্বে আরববাসীর মধ্যে কী ধরনের অনৈক্য বিরাজমান ছিল তা ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানা থাকার কথা। ইসলাম পূর্বকালে আরবের গোত্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত ও শত্রুতা ছিল। কথায় কথায় লড়াই-ঝগড়া এবং দিনরাত খুনা-খুনী ও রক্তপাত লেগেই ছিল। এরই পরিণামে গোটা আরব জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই কঠিন অবস্থা হতে তাদেরকে ইসলামই রক্ষা করেছিল। কাজেই ইসলাম হচ্ছে মুমিনদের জন্য একটি অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ। আল্লাহ্‌ তাআলা পবিত্র কালামে উল্লেখ করেছেন:

﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّـهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُون

"এবং তোমরা সকলে আল্লাহ্‌র রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহকে স্মরণ কর। তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ্‌ তা হতে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। এইরূপে আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা সৎ পথ পেতে পার।(সূরা আলে ইমরান: ১০৩)

আল্লাহ্‌র রজ্জু অর্থে এখানে আল্লাহ্‌র দ্বীনকেই বোঝানো হয়েছে। একে রজ্জু এজন্যই বলা হয়েছে যে, এ সূত্র দ্বারাই এক দিকে আল্লাহ্‌র সাথে ঈমানদার লোকদের সস্পর্ক স্থাপন হয় অন্যদিকে সমস্ত ঈমানদার লোককে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ ও মিলিত করে একটি দৃঢ় ও শক্তিশালী জাতি তথা মুসলিম মিল্লাতে রূপান্তরিত করা হয়। এই রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার অর্থ এই যে, মুসলমানদের দৃষ্টিতে মৌলিক গুরুত্বে আল্লাহ্‌র দ্বীনের হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ দ্বীনকে আল্লাহ্‌র জমিনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টানুবর্তী হওয়া প্রতিটি মুসলমানের অবশ্যই কর্তব্য।

ইসলামের পূর্বে আরববাসী যে কদর্য অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল তা থেকে আল্লাহ্‌ তাআলা তাদের এ দ্বীনের মাধ্যমেই রক্ষা করছেন এবং বলেছেন, এখন থেকে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে, কাজেই তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না, পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত হবে না। আল্লাহ্‌ তাআলা অন্যত্র বলেছেন:

﴿وَأَطِيعُوا اللَّـهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ۖ وَاصْبِرُوا ۚ إِنَّ اللَّـهَ مَعَ الصَّابِرِينَ

"আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ্‌ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা আনফাল: ৪৬)

মহানবী (সা.)-এর আবির্ভাবের ফলে পৃথিবীতে এক বিস্ময়কর ও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। প্রাক ইসলাম যুগের যাবতীয় কুসংস্কার, অন্ধ অনুসরণ এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত সংঘর্ষ অপসৃত হয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় এক তাওহীদভিত্তিক ভ্রাতৃত্বের সমাজ- যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে একান্তই বিরল।

ইসলামী ঐক্য

বিশ্বের সকল মুসলমান মহানবী (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী পালন করে থাকেন। সুন্নী ভাইয়েরা ১২ রবিউল আউয়াল এবং শিয়া ভাইয়েরা ১৭ রবিউল আউয়াল তারিখে দিবসটি উদযাপন করে থাকেন। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ১২ থেকে ১৭ রবিউল আউয়ালকে মুসলমানদের জন্য ঐক্য সপ্তাহ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ইরান বিশ্বের সকল মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, ইসলামের দুশমনদের মোকাবিলার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে দিন দিন তারা পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসছে এবং তারা এখন একই গন্তব্যে পৌঁছতে চায়।

ইসলামী ঐক্যের উদ্দেশ্য

শহীদ আয়াতুল্লাহ মুতাহ্‌হারী এ প্রসঙ্গে বলেন, ইসলামী ঐক্যের উদ্দেশ্য কী? এর দ্বারা কি এ কথা বুঝায় যে, সকল ইসলামী গ্রুপ থেকে একটি গ্রুপকে বাছাই করে নিতে হবে? অথবা এর অর্থ কি পার্থক্য ভুলে গিয়ে সকল গ্রুপের সাযুজ্যমূলক দিকগুলো নির্ধারণ করে নেয়া এবং এভাবে নতুন একটি ধর্মমত আবিষ্কার করা? বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে আপোসের সাথে ইসলামী ঐক্যের সস্পর্ক কতটুকু? না কি এর অর্থ হলো, মাযহাবী মতপার্থক্য সত্ত্বেও বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে দুশমনের মোকাবিলা করবে এবং ইসলামী ঐক্যের এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সবাই এক কাতারে এসে দাঁড়াবে।

ইসলামী ঐক্যের যাঁরা বিরোধী তাঁরা বিষয়টিকে অযৌক্তিক ও অবাস্তব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে বলেন যে, এর দ্বারা মাযহাবী ঐক্য বুঝানো হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো শুরুতেই ধারণাটির গ্রহণযোগ্যতা শেষ করে ই আলেম সমাজ ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছেদেয়া। অথচ অভিন্ন দুশমনদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের জন্য মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যেন।

চিন্তাবিদদের মতে, মুসলমানদের বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে ঈমানের দিক দিয়ে সুন্দর ঐকমত্য রয়েছে। এ দিকটি তাদের ঐক্যের জন্য মজবুত ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। সকল মুসলমান এক আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাসী, মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রতি সবাই আস্থাশীল, মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সকলেরই পবিত্র কিতাব এবং কাবার দিকে মুখ করে তারা সবাই নামায আদায় করে। সবাই রমজান মাসে রোযা রাখেন, একই পদ্ধতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, ছেলেমেয়েদের একই শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলে এবং একই পদ্ধতিতে মৃতের দাফন কাফন সস্পন্ন করে।

এ উপলক্ষে আমরা পৃথিবীর সকল মুসলমানকে অভিনন্দিত করছি এবং ইসলামী ঐক্য সম্পর্কে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি। ঐক্য শব্দের অর্থ হলো একতা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ফলে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক দিয়েও মানুষের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা যখন বলি, দুটি দেশ বা দুটি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তখন এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

মুসলমানরা অভিন্ন সংস্কৃতি এবং একটি মহান ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী। ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি হিসেবে তাদের গড়ে তুলতে এ সকল সাযুজ্যগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। তখন মুসলমানরা এমন একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হবে যাদের সামনে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য থাকবে।

পবিত্র কুরআন বলে, মুসলমানরা পরস্পর ভাই। তাদের একের প্রতি অপরের বিশেষ অধিকার ও কর্তব্যবোধ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে।

ইসলাম প্রদত্ত এ সকল সুযোগকে মুসলমানরা ব্যবহার না করার কি কোন কারণ থাকতে পারে?

ঐক্যের প্রতি পবিত্র কুরআনের আহ্বান

কুরআন, ইসলাম এবং আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে মহান আল্লাহ স্বয়ং ঐক্যের নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনের নিম্নবর্ণিত আয়াতসমূহের দিকে দৃষ্টি দিলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّـهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّـهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ

"এবং তোমরা আল্লাহ্‌র রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ্‌ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত লাভ করতে পার।” (আলে ইমরান: ১০৩)

﴿إِنَّ هَـٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ

"তোমাদের এই যে উম্মত এতো একই উম্মত এবং আমিই তোমাদের রব। অতএব, আমারই ইবাদত কর।” (সূরা আম্বিয়া: ৯২)

পবিত্র কুরআন মুসলমানদেরকে পরস্পরের ভাই বলে উল্লেখ করেছে এবং পরস্পরের মাঝে এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট রাখার আহ্বান জানিয়েছে।

﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ۚ وَاتَّقُوا اللَّـهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

"মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।” (আল-হুজুরাত: ১০)

মুসলিম উম্মাহর উন্নতি ও সাফল্য ঐক্যের মধ্যেই নিহিত

ঐক্যের সুফলের যে অন্ত নেই তা উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না। এর বিপরীতে বিভেদ ও অনৈক্যের নানাবিধ কুফলও কারো অজ্ঞাত নয়। বরং বলা যেতে পারে এটা সকল বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাছে স্বতঃসিদ্ধ একটি বিষয়। পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতেই এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ্‌ বলেন: তোমরা সমবেতভাবে আল্লাহ্‌র রজ্জুকে দৃঢ়তার সাথে ধরে থাক এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ো না; আর তোমাদের ওপর আল্লাহ্‌র নিয়ামতকে স্মরণ কর যে, তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করে দিলেন, ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে এবং তোমরা আগুনের গহ্বরের কিনারায় ছিলে, আর তিনি (আল্লাহ্‌) তোমাদের তা থেকে রক্ষা করলেন। এভাবেই আল্লাহ্‌ তাঁর আয়াতসমূহকে তোমাদের জন্য বিবৃত করেন হয়তো তোমরা পথপ্রাপ্ত হবে। (আলে ইমরান ১০৩-১০৪) তিনি অন্যত্র বলেছেন: তোমরা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, আর পরস্পর দ্বন্দে লিপ্ত হয়ো না, অন্যথায় তোমরা মনোবল হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের প্রভাবশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, আর ধৈর্য্যধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (আনফালঃ ৪৬) অসংখ্য হাদীসেও ঐক্যের সুফল ও বিভেদের মন্দ পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যাতে করে মুসলিম উম্মাহ ও সমাজ এর ভিত্তিকে মজবুত ও দৃঢ় রাখতে সচেষ্ট থাকে।

ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা এ বিষয়টি প্রমাণ করেছে যে, যদি কোন দল ও জনসমষ্টি পরাশক্তির অধিকারী হতে চায় তবে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ ও নিজেদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলতে হবে। এ বাস্তবতাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে বলেই আমরা দেখি পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী দেশগুলো এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানরা তাদের মধ্যকার ঐতিহাসিক শত্রুতাকে ভুলে গিয়ে রাজনৈতিক, কুটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই প্লাটফর্মে সমবেত হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলো ভৌগলিক, আঞ্চলিক, ভাষাগত, জাতিভিত্তিক ও রাজনৈতিক সীমার বিভাজনেই শুধু বিভক্ত নয় বরং তারা একদিকে পাশ্চাত্যের অনুপ্রবেশকৃত ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধর্মবিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন ও তথাকথিত ডেমোক্রেসির নামে শতদলে বিভক্ত হয়েছে অন্যদিকে সুস্থ ও সঠিক ধর্মীয় চিন্তার বিকাশের অভাবে সংকীর্ণ মাযহাবী চিন্তা ও গোড়ামির বশবর্তী হয়ে স্বীয় দল ও মাযহাবের বাইরের সকলকে বিচ্যুত, বিভ্রান্ত আবার কখনও কখনও ধর্মবহির্ভূত বলে গণ্য করছে। পরিণতিতে ধর্মীয় অন্তর্কোন্দলের সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি তাদের একদল অপরদলকে নিশ্চিহ্ন করাকে জিহাদ বলে ঘোষণা করছে এবং নারী ও শিশুদের হত্যা ও তাদের ওপর নির্যাতন চালানোকেও বৈধ জ্ঞান করছে। আর কিছু ইসলামের ধ্বজাধারী বলে দাবিকারী শাসক যারা প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদীদের দোসর এধরনের অপরাধ সংঘটন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ইন্ধন যোগাচ্ছে। এখানে একটি তথ্য উপস্থাপন জরুরী বলে মনে করছি। আর তা হল বিগত অর্ধশতাব্দীতে মুসলিম বিশ্ব বিদেশী আগ্রাসনে যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার থেকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ ও অন্তর্কোন্দলে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মিশরের আলআহরাম সাময়িকীর রিপোর্ট অনুযায়ী আরববিশ্ব ইসরাঈলের সঙ্গে যুদ্ধে বিগত পাঁচ দশকে ৩০০ বিলিনয়ন ডলার খেসারত দিয়েছে। এর বিপরীতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ সংঘাতে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার। যখন যায়নবাদী ইসরাঈলের হাতে একলক্ষ মুসলমান শহীদ হয়েছে তখন মুসলানদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দলের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে ২৫ লক্ষ লোক। অবশ্য এপরিসংখ্যান আমেরিকার ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলার (যাতে বিশলক্ষ লোক নিহত হয়েছে) এবং সাম্প্রতিক সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধের প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিকে হিসাবে আনেনি। এরূপ ভয়াবহ অবস্থায়ও মুসলিম উম্মাহ সম্বিত ফিরে পায়নি। যদিও মুসলিম উম্মাহর সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ঐক্যের প্রত্যাশী কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এ উম্মারই একাংশের উগ্রচিন্তা ও ধর্মান্ধতাকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ হাসিল করে চলেছে।

একারণেই বিশ্বের প্রায় দেড়শ কোটি মুসলমান এক আল্লাহ্‌, এক কোরআন, এক নবী, এক কিবলা, একইরূপ মৌলিক বিশ্বাসের অধিকারী ও ধর্মীয় বিধিবিধানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক মিল থাকা সত্ত্বেও এক উম্মাহর লক্ষ্যে পৌছাতে ব্যর্থ হয়েছে। যেখানে পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী তারা পরস্পরের ভাই ও পৃষ্ঠপোষক হওয়া উচিত ছিল সেখানে ইসলামের শত্রুদের প্ররোচনায় তারা একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছে। তারা পাশ্চাত্যের ও তাদের মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক মুসলিম নামধারী শাসকদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম কর্তৃক মুসলমানদের বিভিন্ন দল সম্পর্কে উপস্থাপিত অবাস্তব ও বিরূপ চিত্রকে সঠিক বলে ধারণা করে পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ও বিদ্বেষী হয়ে আত্মঘাতি তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। অথচ মহান আল্লাহ্‌ তাদের পূর্বেই এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন: হে বিশ্বাসিগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা তা উত্তমরূপে অনুসন্ধান করবে, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতি না করে বস এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুশোচিত হতে হয়। (হুজুরাত: ) মুসলমানরা বুঝতে পারছে না যে, ইসলামের শত্রুরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এ উম্মাহর মধ্যে (Divide and Rule policy) বাস্তবায়ন করছে। এরূপ পরিস্থিতিতে মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় নেতৃবর্গ, বুদ্ধিজীবি, বিভিন্ন দল, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ওপর দায়িত্ব রয়েছে তাদের জাতি ও অনুসারীদের ঐক্যের বিষয়ে সচেতন ও অনৈক্যের মন্দ পরিণতি এবং ইসলামের শত্রুদের অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করা। বিশেষত মুসলমানদের ঐক্যের বিরোধী পাশ্চাত্যের দোসর রাজতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী এবং কট্টরপন্থী, গোড়া ও সংকীর্ণ চিন্তার ঐ সকল আলেম থেকে সতর্ক করতে হবে যারা কেবল অস্ত্রকেই তাদের ভাষা হিসাবে ব্যবহার করে ও ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের স্বীয় বিরোধীদের বিরুদ্ধে উস্কে দেয় অথচ ইসলামের প্রকৃত শত্রুদের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থাকে।

ইসলামের বিভিন্ন দল ও মাযহাবের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যতম যে বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দিতে হবে তা হল ইসলামের সার্বিক কাঠামো ও মৌলিক বিশ্বাসের ঐক্যের গণ্ডিতে বিভিন্ন মত, চিন্তাধারা ও ইজতিহাদকে স্বীকৃতি দান এবং পরস্পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সংলাপের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা ও অনৈক্য পরিহার করে এক কাতারে এসে দাঁড়ানো। অমূলক ধারণার ভিত্তিতে আক্রমণাত্মক ও নেতিবাচকভাবে এক অপরের মতকে খণ্ডন করার পরিবর্তে সঠিক যুক্তি ও জ্ঞানের আলোকে পর্যালোচনার মাধ্যমে এক অপরকে মূল্যায়ন করা। সকল মাযহাবকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দেয়া, বিধি-বিধান ও আচার-অনুষ্ঠান পালনের অনুমতি দান এবং পরস্পরের স্বার্থ ও অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা। এক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন ইসলাম হল সেই ধর্ম যা ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরও স্বীয় শাসনের অধীনে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে সেক্ষেত্রে মুসলমানদের অধিকার রক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে।

বর্তমানে ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছে। তাই মুসলমানদের নিজেদের মতদ্বৈততা ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাত করতে হবে। কোনভাবেই শত্রুদের মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিদ্যমান মতপার্থক্যকে ব্যবহার করে স্বার্থ উদ্ধারের সুযোগ দেয়া যাবে না। আমাদের সকলকে মহান আল্লাহ্‌র এ আহ্বানের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে: তোমরা (আল্লাহ্‌র) দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা কর এবং দ্বীনের ব্যাপারে পরস্পর বিভেদে লিপ্ত হয়ো না। (শুরা: ১৩) মহান আল্লাহ্‌ আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তওফিক দিন ও অনৈক্যের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন!

 

লেখক আবুল কাসেম ও আশিফুর রহমান

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: