bayyinaat

Published time: 19 ,November ,2018      22:34:38
আহলে সুন্নাতের ইরানী ফকীহগণ
আহমদ ইবনে হাম্বলকে আরব বংশোদ্ভূত ইরানী বলা যেতে পারে। তাই আহলে সুন্নাতের চার ইমামের একজন ইরানী, একজন আদনানী আরব, একজন কাহতানী আরব এবং একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। বিশিষ্ট ফকীহদের মধ্যে ইবনে সিরিজ শাফেয়ী, আবু সাঈদ ইসতাখরী ও আবু ইসহাক মুরুজী চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে, আবু হামিদ ইসফারাইনী, আবু ইসহাক ইসফারাইনী, আবু ইসহাক সিরাজী, ইমামুল হারামাইন জুয়াইনী, ইমাম মুহাম্মদ গাজ্জালী, আবুল মুজাফ্ফার খাওয়াফী ও কিয়াল হারাসী পঞ্চম হিজরীতে, আবু ইসহাক আরাকী মৌসেলী ষষ্ঠ হিজরীতে, আবু ইসহাক মৌসেলী সপ্তম হিজরীতে, ইমাম শাতেবী আন্দালুসী অষ্টম হিজরীতে প্রসিদ্ধ ইরানী ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত।
সংবাদ: 108

আহলে সুন্নাতের ইরানী ফকীহগণ

মূল: আয়াতুল্লাহ মুতাহহারী

অনুবাদ: আবুল  কাসেম                          কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বাকর

সারাংশ: আহমদ ইবনে হাম্বলকে আরব বংশোদ্ভূত ইরানী বলা যেতে পারে। তাই আহলে সুন্নাতের চার ইমামের একজন ইরানী, একজন আদনানী আরব,একজন কাহতানী আরব এবং একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। বিশিষ্ট ফকীহদের মধ্যে ইবনে সিরিজ শাফেয়ী, আবু সাঈদ ইসতাখরী ও আবু ইসহাক মুরুজী চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে, আবু হামিদ ইসফারাইনী, আবু ইসহাক ইসফারাইনী, আবু ইসহাক সিরাজী, ইমামুল হারামাইন জুয়াইনী, ইমাম মুহাম্মদ গাজ্জালী, আবুল মুজাফ্ফার খাওয়াফী ও কিয়াল হারাসী পঞ্চম হিজরীতে, আবু ইসহাক আরাকী মৌসেলী ষষ্ঠ হিজরীতে, আবু ইসহাক মৌসেলী সপ্তম হিজরীতে, ইমাম শাতেবী আন্দালুসী অষ্টম হিজরীতে প্রসিদ্ধ ইরানী ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত।

ট্যাগ: আহলে সুন্নাত, ফকীহ, প্রসিদ্ধ চার মাযহাব, আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালেক ইবনে আনাস আহমদ ইবনে হাম্বল

প্রথমে আমরা আহলে সুন্নাতের ফকীহগণ সম্পর্কে একটি ভূমিকা পেশ করছি। উমাইয়্যা খলীফাগণ অ-শিয়া আরব বংশোদ্ভূত ফকীহদের পৃষ্ঠপোষকতা করত। পরবর্তীতে আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসলে অ-শিয়া অনারব ফকীহদের পৃষ্ঠপোষকতা করা শুরু করে। জর্জি যাইদান উমাইয়্যা খলীফাদের সম্পর্কে বলেন,

"উমাইয়্যাগণ গোঁড়া আরব ছিল এবং অনারবদের অপাঙ্ক্তেয় মনে করত। মদীনার ফকীহগণ যেহেতু নবী (সা.)-এর পরিবারকে খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকারী মনে করত ও উমাইয়্যাদের ক্ষমতার অবৈধ দখলদার হিসেবে অপছন্দ করত সেহেতু উমাইয়্যা শাসকগণ মদীনার ফকীহদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু তদুপরি বাধ্য হয়ে তাঁদের প্রতি বাহ্যিক সম্মান প্রদর্শন করত এবং কখনও কখনও তাঁদের বিভিন্নভাবে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করত। উমাইয়্যা শাসকদের মধ্যে সৎ শাসক হিসেবে উমর ইবনে আবদুল আজিজ মদীনার ফকীহদের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। উমাইয়্যাদের পরে আব্বাসীয়রা ক্ষমতা লাভ করে। আব্বাসীয় খলীফা মনসুর আরবদের হেয় ও ইরানীদের বড় করার চেষ্টায় রত হন। কারণ আব্বাসীয় খেলাফত ইরানীদের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মনসুর তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুসলমানদের দৃষ্টিকে মক্কা ও মদীনা হতে অন্যত্র সরানোর চেষ্টায় রত হন। তিনি মদীনার লোকদের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করেন ও মক্কা হতে মুসলমানদের বিরত রাখার লক্ষ্যে ‘কোব্বাতুল খাদরা’ (সবুজ গম্বুজ) প্রতিষ্ঠা করে মক্কা যাওয়ার পরিবর্তে সেখানে গিয়ে হজ্বের বিধিবিধান পালন করার নির্দেশ দেন। সে সময় মদীনার ফকীহ্ ছিলেন আনাস ইবনে মালেক। তিনি মদীনার লোকদেরকে মনসুর হতে বাইয়াত প্রত্যাহারের ফতোয়া দেন। মদীনার লোকজন মনসুরের বাইয়াত প্রত্যাহার করে ইমাম হাসানের পৌত্র মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে হাসান ইবনে হাসানের হাতে বাইয়াত করে। মুহাম্মদের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকলে মনসুর তাঁকে দমন করার উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন ও বেশ প্রতিরোধের পর মুহাম্মদ পরাস্ত (বন্দী ও নিহত) হন। মদীনার লোকজন পুনরায় মনসুরের নিকট বাইয়াত করতে বাধ্য হয়। এতদসত্ত্বেও ইমাম মালিক আব্বাসীয় খলীফাদের খলীফা হিসেবে মানতেন না। মনসুরের চাচা মদীনার গভর্নর জাফর ইবনে সুলায়মান এ বিষয় সম্পর্কে অবহিত হলে মালেককে ডেকে পাঠান ও তাঁর পৃষ্ঠ উন্মুক্ত করে চাবুক দ্বারা প্রহার করেন।”১ (জর্জি যাইদান, তারিখে তামাদ্দুন, খ. ৩, পৃ. ১০৪-১০৫)

ইবনুন নাদিম তাঁর ‘আল ফেহেরেস্ত’ গ্রন্থে ফকীহদের সম্পর্কে লিখিত প্রবন্ধে মুহাম্মদ ইবনে সুজার (ইবনুস সালজী নামে প্রসিদ্ধ) জীবনী আলোচনায় একটি কাহিনী বর্ণনা করেছেন যা আব্বাসীয় খলীফাদের রাজনীতিতে ইরানীপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে। তিনি ইসহাক ইবনে ইবরাহীম মাসআবীর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,

"খলীফা একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন : আমার কর্মে সহযোগিতার জন্য একজন ফকীহ্ আলেমকে আন যে হাদীস বিষয়ে যেমন পণ্ডিইত হবে তেমনি স্বাধীন মত প্রকাশের (কিয়াস করার) যোগ্যতাসম্পন্ন হবে। খোরাসানীদের নিকট হতে আমাদের শাসনের অধীন প্রশিক্ষিত সুন্দর চেহারার এরূপ বৈশিষ্ট্যের এক ব্যক্তিকে মনোনীত কর যাকে বিচার বিভাগের কাযী নিয়োগ করব।” ইসহাক বলেন, "আমি খলীফাকে বললাম : মুহাম্মদ ইবনে সুজা সালজী ব্যতীত এরূপ কাউকে দেখছি না। যদি অনুমতি দেন তাহলে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি। খলীফা বললেন : ঠিক আছে। যদি তিনি রাজী হন তাহলে আমার নিকট নিয়ে এসো। আমি মুহাম্মদ ইবনে সুজাকে প্রস্তাব দিলে তিনি তা গ্রহণ করলেন না; বরং বললেন : এটি গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন আমার নেই। আমার অর্থ-সম্পদ, সম্মান ও মর্যাদা কিছুরই প্রয়োজন নেই...”২ (ইবনে নাদিম, আল ফেহেরেস্ত, পৃ. ৩০৫।)

আমরা জানি, আহলে সুন্নাতের ফকীহদের মধ্যে চারজন স্বতন্ত্র মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে প্রসিদ্ধ। সাধারণ সুন্নী জনগণ এই চার মাযহাবের একটিকে অনুসরণ করে থাকে। এ চার ফকীহ্ হলেন আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালেক ইবনে আনাস এবং আহমদ ইবনে হাম্বল। কিন্তু চার মাযহাবের মধ্যে দীনকে সীমিত করার বিষয়টি সপ্তম হিজরী শতাব্দীতে সম্পন্ন হয়। এর পূর্বে আহলে সুন্নাতের মধ্যে দশটি মাযহাব প্রচলিত ছিল।

আমরা আহলে সুন্নাতের ফকীহদের সম্পর্কে আলোচনাকে তিন ভাগে ভাগ করেছি। প্রথম ভাগে চার মাযহাবের উদ্ভবের পূর্বের সময়কাল, দ্বিতীয় ভাগে চার মাযহাবের উৎপত্তির সমকালীন সময়, তৃতীয় ভাগে চার মাযহাবের ইমামদের পরবর্তী সময়।

চার মাযহাবের পূর্ববর্তী সময়ে তাবেয়ীদের যুগ ছিল। তাবেয়ীন হলেন যাঁরা রাসূল (সা.)-এর সাহচর্য লাভ করেননি কিন্তু তাঁর সাহাবীদের সাহচর্য পেয়েছেন। তাবেয়ীদের মধ্যে সাতজন প্রসিদ্ধ ফকীহ্ মদীনায় ছিলেন যাঁদের ‘ফোকাহায়ে সাবআ’ বলা হয়। তাঁরা হলেন :

১. আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে হারেস ইবনে মাখযুমী : তিনি কুরাইশ বংশোদ্ভূত ব্যক্তি এবং কুরাইশ নেতা আবু জাহলের ভ্রাতার বংশধর। তিনি ৯৪ হিজরীতে মারা যান।

২. সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব মাখযুমী : তিনিও একজন কুরাইশ। তিনি ইবাদাত-বন্দেগীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। কথিত আছে তিনি পঞ্চাশ বছর রাত্রি জেগে ইবাদত করেছেন ও রাত্রির এশার নামাজের ওজু দিয়ে ফজরের নামাজ পড়েছেন। অবশ্য আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর ও অনেক শিয়া আলেম তাঁকে শিয়া বলেছেন।২ সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব ৯১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

৩. কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি বাকর : তিনি প্রথম খলীফা আবু বকরের বংশধর এবং ইমাম সাদিক (আ.)-এর নানা। আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদরও তাঁকে শিয়া বলেছেন। একটি বর্ণনা মতে কাসেম ইবনে মুহাম্মদের মাতা সাসানী শাসক ইয়ায্দ গারদের কন্যা ছিলেন। এ সূত্র মতে কাসেম পিতার দিক হতে কুরাইশ ও মাতার দিক হতে ইরানী ছিলেন। তিনি ১১০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

৪. খারেজা ইবনে যায়েদ ইবনে সাবিত আনসারী : তিনি প্রসিদ্ধ সাহাবী যায়েদ ইবনে সাবিতের পুত্র। তিনি ৯৯ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৫. সুলাইমান ইবনে ইয়াসার : তিনি অনারব, সম্ভবত ইরানী। তিনি ৯৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৬. আবদুল্লাহ্ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ : তিনি বিশিষ্ট সাহাবী আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি ৯৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৭. উরওয়া ইবনে যুবাইর : তিনি প্রসিদ্ধ সাহাবী যুবাইর ইবনে আওয়ামের পুত্র। তিনিও ৯৪ হিজরীতে মারা যান।

এ সাত ব্যক্তি হতে সম্ভবত একজন (সুলাইমান ইবনে ইয়াসার) ইরানী বংশোদ্ভূত। অন্যান্যরা মক্কা অথবা মদীনার অধিবাসী। অবশ্য এ স্তরে আরো কিছু প্রসিদ্ধ ফকীহ্ ছিলেন যাঁরা ইরানী ছিলেন। যেমন মালেকী মাযহাবের ইমাম মালেক ইবনে আনাসের শিক্ষক রাবীয়াতুর রাই। তিনিই ফিকাহ্শাস্ত্রে কিয়াসের উদ্গাতা। রাবীয়া ১৩৬ হিজরীতে মারা যান। তাউস ইবনে কাইসান এ সময়ের অপর প্রসিদ্ধ ইরানী ফকীহ্। তিনি ১০৪ অথবা ১০৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। সুলাইমান আমাশও তৎকালীন সময়ের প্রসিদ্ধ ইরানী ফকীহ্।

সে সময়ের প্রসিদ্ধ ফকীহদের অন্যতম হলেন ইবনে আব্বাসের মুক্ত দাস ইকরামা। ইকরামা উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী ছিলেন। তিনি তাফসীর ও ফিকাহ্শাস্ত্রে দক্ষ ছিলেন। বিভিন্ন তাফসীর ও ফিকাহর গ্রন্থে তাঁর নাম উল্লিখিত হয়ে থাকে।

প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ফকীহ্

১. আবু হানিফা নোমান ইবনে সাবিত ইবনে যোতী অথবা নোমান ইবনে সাবিত ইবনে নোমান ইবনে মারযবান (মৃত্যু ১৫০ হিজরী) আবু হানিফা একজন ইরানী বংশোদ্ভূত ফকীহ্। তাঁকে আহলে সুন্নাতের ফকীহদের প্রধান (ইমামে আযম) বলা হয়। অধিকাংশ সুন্নী সমাজে তাঁকে নবী (সা.), খোলাফায়ে রাশেদীন, ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মনে করা হয়। ইরানে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা স্বল্প হলেও ইরানের বাইরে তাদের সংখ্যা অনেক।

২. মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস শাফেয়ী : শাফেয়ী কোরেশী আরব। অনুসারীদের সংখ্যার ভিত্তিতে তিনি আবু হানিফার সমকক্ষ বা তাঁর অনুসারীর সংখ্যা কিছুটা বেশি হতে পারে। শাফেয়ী ২০৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৩. মালেক ইবনে আনাস (মৃত্যু ১৭৯ হিজরী) : মালেক কাহতান বংশীয় আরব। উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ মুসলমান তাঁর অনুসারী।

৪. আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃত্যু ২৪১ হিজরী) : আহমদ আরব বংশোদ্ভূত, তবে সম্ভবত তাঁর পরিবার ইরানের খোরাসানের মারভে বাস করত। ইবনে খাল্লেকান বলেছেন, তাঁর মাতা তাঁকে গর্ভধারণকালে মারভ হতে বাগদাদ রওয়ানা হন এবং বাগদাদে তাঁর জন্ম হয়।

আহমদ ইবনে হাম্বলকে আরব বংশোদ্ভূত ইরানী বলা যেতে পারে। তাই আহলে সুন্নাতের চার ইমামের একজন ইরানী, একজন আদনানী আরব, একজন কাহতানী আরব এবং একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী।

আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এ স্তরের (সময়কালে) আরো কিছু ফকীহ্ ছিলেন যাঁদের মাযহাব বর্তমানে বিলুপ্ত হয়েছে, যেমন মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী (মৃত্যু ৩১০ হিজরী) এবং দাউদ ইবনে আলী জাহিরী ইসফাহানী (মৃত্যু ২৭০ হিজরী) দাউদ ইবনে আলী জাহিরী ফিকাহ্শাস্ত্রে জাহিরী মতবাদের উদ্গাতা। তাঁর ফিকাহর মত হলো হাদীসের বাহ্যিক অর্থের বাইরে কোন অর্থই নেই। এ কারণে তাঁর মতবাদ এক প্রকার স্থবিরতা ছাড়া কিছু নয়। ইরানী বংশোদ্ভূত ফকীহ্ ইবনে হাযম আন্দালুসী উমাইয়্যাদের চরম ভক্ত ব্যক্তি। তাঁর নবী পরিবারের প্রতি এক রকম বিদ্বেষ ছিল। ফিকাহর বিষয়ে তিনি দাউদ ইবনে আলী জাহিরীর অনুসারী ছিলেন। ইবনে জারীর তাবারী একজন ইরানী ফকীহ ও মুফাসসির যিনি আহলে সুন্নাতের প্রথম সারির আলেমগণের একজন। তিনি তাঁর সময়ের অধিকাংশ ইসলামী জ্ঞানের পণ্ডিত ছিলেন ও এ ক্ষেত্রে অন্যদের পুরোধা হিসেবে পরিগণিত হতেন। তাবারী প্রথম জীবনে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী হলেও পরবর্তী জীবনে স্বতন্ত্র ফিকাহ্র প্রবর্তন করেন এবং চার মাযহাবের কোন ইমামেরই অনুসরণ হতে বিরত হন। তাঁর মাযহাব কিছুদিন পর বিলুপ্ত হয়। ইনবুন নাদিম তাঁর ‘আল ফেহেরেস্ত’ গ্রন্থে বেশ কিছু ফকীহ্র নাম বলেছেন যাঁরা তাবারী ফিকাহর অনুসরণ করতেন।

এ সময়কালের আরো কিছু প্রসিদ্ধ ফকীহ্ যাঁদের কেউ স্বতন্ত্র মাযহাবের প্রবক্তা, আবার কেউ শুধুই ফকীহ্ ছিলেন। আমরা এখানে তাঁদের অনেকের পরিচয় তুলে ধরছি যাতে আহলে সুন্নাতের ফিকাহয় ইরানীদের অবদানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

১. মুহাম্মদ ইবনে হাসান শাইবানী (মৃত্যু ১৮৯ হিজরী) : তিনি আবু হানিফার ছাত্র ও হারুনুর রশীদের সহযোগী ছিলেন। তিনি সিরীয় হলেও ইরাকের ওয়াসেতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ইরানের রেই শহরে। একবার হারুনুর রশীদের সঙ্গে ইরানে আগমন করলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয় ও তাঁকে সেখানে সমাহিত করা হয়।

২. আবু ইউসুফ (মৃত্যু ১৯২ হিজরী) : তিনিও আবু হানিফার ছাত্র এবং আব্বাসীয় খলীফা মাহ্দী, হাদী ও হারুনের সময় বিচার বিভাগের প্রধান কাযী ছিলেন। তাঁকে আনসার বংশীয় বলা হয়ে থাকে।

৩. যাফর ইবনিল হাযিল (মৃত্যু ১৫৮ হিজরী) : তিনি আদনানী আরব এবং আবু হানিফার অনুসারী।

৪. লাইস ইবনে সা’দ ইসফাহানী (মৃত্যু ১৫৭ হিজরী) : তিনি মিশরের ফকীহ্ ও স্বতন্ত্র মাযহাবের প্রবক্তা ছিলেন, যদিও অনেকে তাঁকে আবু হানিফার অনুসারী বলেছেন।

৫. আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারাক মুরুজী (মৃত্যু ১৮১ হিজরী) : তিনি আবু হানিফা, মালেক ও সুফিয়ান সাউরীর ছাত্র। তিনি ইরানের মারভের অধিবাসী।

৬. আউযায়ী, আবু আমর আবদুর বহমান ইবনে আমর (মৃত্যু ১৫৭ হিজরী) : তিনি জুহরী ও আতা ইবনে আবি রিবাহর ছাত্র। তিনি সিরিয়ার অধিবাসী। তাঁকে সিরীয় একক ফিকাহর ইমাম বলা হয়। তিনি ফিকাহর স্বতন্ত্র মাযহাবের প্রবক্তা। তাঁর পূর্বপুরুষ ইয়েমেনের মুক্ত আরব ছিলেন নাকি বন্দী তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।

উপরিউক্তগণ আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যায়ের ফকীহদের মধ্যে কেউ ইরানী আবার কেউ অ-ইরানী।

তৃতীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট ফকীহদের মধ্যে ইবনে সিরিজ শাফেয়ী, আবু সাঈদ ইসতাখরী ও আবু ইসহাক মুরুজী চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে, আবু হামিদ ইসফারাইনী, আবু ইসহাক ইসফারাইনী, আবু ইসহাক সিরাজী, ইমামুল হারামাইন জুয়াইনী, ইমাম মুহাম্মদ গাজ্জালী, আবুল মুজাফ্ফার খাওয়াফী ও কিয়াল হারাসী পঞ্চম হিজরীতে, আবু ইসহাক আরাকী মৌসেলী ষষ্ঠ হিজরীতে, আবু ইসহাক মৌসেলী সপ্তম হিজরীতে, ইমাম শাতেবী আন্দালুসী অষ্টম হিজরীতে প্রসিদ্ধ ইরানী ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত।

নবম হিজরী শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে ইরানের মানুষ শিয়া মাযহাব গ্রহণ করলে তার প্রভাবে বিগত চারশ’ বছরের ইরানী ফকীহগণের সকলেই শিয়া মাযহাবভুক্ত।

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: