bayyinaat

Published time: 19 ,November ,2018      23:42:28
ইসলামের সাহসী ও বীরাঙ্গনা নারী উম্মে আমের
উম্মে আমেরের নাম ছিল নাসীবা। উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই আত্মোৎসর্গকারী নারীর সাহস ও বীরত্বের জন্য মহানবী (সা.) বিস্ময়বোধ করলেন। তিনি (সা.) যুদ্ধের মধ্যে যখন তাঁর সন্তানের আঘাতকারীকে দেখতে পেলেন, তখনই নাসীবাকে সম্বোধন করে বললেন : “তোমার সন্তানের আঘাতকারী হচ্ছে এই লোক।” প্রিয়জনের বিয়োগে বেদনাবিধুর এই নারী, যে এতক্ষণ পতঙ্গের ন্যায় হযরতের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ছিল, এ কথা শোনার সাথে সাথে সিংহের মতো লোকটির ওপর আক্রমণ করল এবং তার পায়ের নলি বরাবর এমন আঘাত করল যে, তাতে লোকটি ধরাশায়ী হয়ে গেল।
সংবাদ: 110

ইসলামের সাহসী ও বীরাঙ্গনা নারী উম্মে আমের

আবুল কাসেম

এই মহিয়সী নারীর বীরত্বের দৃশ্য মহানবীকে এতখানি আনন্দিত করে যে, তিনি এই নারী সম্পর্কে বলেছিলেন : لمقام نسيبة بنت كعب اليوم خير من فلان و فلان  

সারাংশ: উম্মে আমেরের নাম ছিল নাসীবা। উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই আত্মোৎসর্গকারী নারীর সাহস ও বীরত্বের জন্য মহানবী (সা.) বিস্ময়বোধ করলেন। তিনি (সা.) যুদ্ধের মধ্যে যখন তাঁর সন্তানের আঘাতকারীকে দেখতে পেলেন, তখনই নাসীবাকে সম্বোধন করে বললেন : "তোমার সন্তানের আঘাতকারী হচ্ছে এই লোক।” প্রিয়জনের বিয়োগে বেদনাবিধুর এই নারী, যে এতক্ষণ পতঙ্গের ন্যায় হযরতের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ছিল, এ কথা শোনার সাথে সাথে সিংহের মতো লোকটির ওপর আক্রমণ করল এবং তার পায়ের নলি বরাবর এমন আঘাত করল যে, তাতে লোকটি ধরাশায়ী হয়ে গেল।

ট্যাগ: উম্মে আমের, উহুদের যুদ্ধ, ইসলামের বীরাঙ্গনা নারী, নারীর জিহাদ, মহানবী (সা.)

মূল প্রবন্ধ: এ ব্যাপারে আলোচনার কোন অবকাশ নেই যে, ইসলামে নারীদের জন্য জিহাদ অপরিহার্য নয়কারণে যখন মদীনার নারীদের প্রতিনিধি মহানবীর নিকট উপস্থিত হন, তখন তাঁরা এই বঞ্চনার ব্যাপারে মহানবির সাথে কথা বলেন এবং অভিযোগ করেন : "আমরা সাংসারিক জীবনে স্বামীদের জন্য সকল কাজ সম্পাদন করি। আর তারা নিশ্চিন্তে জিহাদে অংশগ্রহণ করে মহান মর্যাদা লাভ করে; অথচ আমরা নারী সমাজ এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।”

মহানবী (সা.) তাঁর মাধ্যমে মদীনার নারী সমাজের প্রতি বার্তা পাঠান : "তোমরা যদিও কতক সৃষ্টিগত ও সামাজিক কারণে এই মহা সৌভাগ্য হতে বঞ্চিত হয়েছ; কিন্তু তোমরা সাংসারিক ও বৈবাহিক জীবনের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জিহাদের সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম।” অতঃপর তিনি এই ঐতিহাসিক উক্তি করেন : و إنّ حُسن التّبعّل يعدل ذلك كلّه "সুচারুরূপে ঘর-সংসারের দায়িত্ব পালনই জিহাদের সমকক্ষ।” তবে কখনো কখনো কিছু অভিজ্ঞ নারী ইসলামের যোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য তাঁদের সাথে মদীনার বাইরে আসতেন। তাঁরা পিপাসার্তদের পানি পান করানো, সৈনিকদের কাপড় ধোয়া ও আহতদের সেবা করার মাধ্যমে মুসলমানদের বিজয় লাভে সাহায্য করতেন।

উম্মে আমেরের নাম ছিল নাসীবা। তিনি বলেন : "আমি ইসলামের মুজাহিদগণের পানি সরবরাহের জন্য উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। আমি দেখতে পেলাম, বিজয়ের হাওয়া মুসলমানদের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ মোড় ঘুরে গেল। মুসলমানরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে লাগল। মহানবী (সা.)-এর প্রাণ নিয়ে আশংকা দেখা দিল। আমি নিজ দায়িত্ব মনে করলাম যে, জীবন যতক্ষণ আছে, মহানবীর প্রাণ রক্ষা করব। পানির মশক মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। একটি তরবারি সংগ্রহ করে নিয়ে শত্র"দের আক্রমণের তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করলাম। কখনো কখনো তীর নিক্ষেপ করছিলাম।” এ ঘটনা ঘটার সময় তাঁর কাঁধে যে ক্ষত হয়েছিল, তা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন : "লোকেরা যখন শত্র"বাহিনীর বিপরীত দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন পলায়নরত এক ব্যক্তির উপর মহানবীর দৃষ্টি পড়ে। তিনি বললেন : এখন যে পালিয়ে যাচ্ছ, অন্তত তোমার ঢালটি ফেলে যাও। সে ঢালটি মাটিতে ফেলে দিল। আমি সেই ঢালটি নিয়ে ব্যবহার করতে লাগলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, ‘ইবনে কুমিআ’ নামক এক ব্যক্তি সজোরে চিৎকার দিয়ে বলছে, মুহাম্মদ কোথায় আছে? সে মহানবীকে চিনতে পেরে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে তাঁর ওপর আক্রমণ করতে আসে। আমি ও মুসআব তাকে তার লক্ষ্যের দিকে যেতে বাধা দিলাম। সে আমাকে পেছনে তাড়ানোর জন্য আমার কাঁধের উপর একটি আঘাত করে। আমি যদিও তাকে কয়েক বার আঘাত করেছি; কিন্তু তার আঘাত আমার ওপর প্রভাব ফেলেছিল, যা এক বছর পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তার শরীরে দু’টি বর্ম ছিল।  এজন্য আমার আঘাত তার ওপর কার্যকর প্রভাব রাখে নি।

আমার কাঁধের ওপর যে আঘাত লাগে, তা খুবই মারাত্মক ছিল। মহানবী (সা.) আমার আঘাতের কথা বুঝতে পারেন। তিনি দেখতে পেলেন, তা থেকে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে। তৎক্ষণাৎ তিনি আমার এক ছেলেকে ডেকে বললেন : তোমার মায়ের ক্ষতস্থানটা বেঁধে দাও। সে আমার ক্ষতস্থান বেঁধে দিল। আমি আবার প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত হলাম।

এর মধ্যে আমি দেখতে পেলাম, আমার এক ছেলে আহত হয়েছে। তৎক্ষণাৎ আহতদের পট্টি বাঁধার জন্য যে কাপড় সাথে এনেছিলাম, তা দিয়ে আমার ছেলের ক্ষতস্থান বেঁধে দিলাম। এ সময় মহানবীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টির দিকে আমার ছেলের মনোযোগ আকর্ষণ করে বললাম :

قم فضارب القوم হে বৎস! ওঠ, যুদ্ধে অবতীর্ণ হও।”

মহানবী (সা.) এই আত্মোৎসর্গকারী নারীর সাহস ও বীরত্বের জন্য বিস্ময়বোধ করলেন। যখনই তাঁর সন্তানের আঘাতকারীকে দেখতে পেলেন, তখনই নাসীবাকে সম্বোধন করে বললেন : "তোমার সন্তানের আঘাতকারী হচ্ছে এই লোক।” প্রিয়জনের বিয়োগে বেদনাবিধুর এই নারী, যে এতক্ষণ পতঙ্গের ন্যায় হযরতের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ছিল, এ কথা শোনার সাথে সাথে সিংহের মতো লোকটির ওপর আক্রমণ করল এবং তার পায়ের নলি বরাবর এমন আঘাত করল যে, তাতে লোকটি ধরাশায়ী হয়ে গেল। এবার নারীর বীরত্বের ব্যাপারে মহানবীর বিস্ময় আরো বৃদ্ধি পেল। তিনি বিস্ময়ে হেসে ফেললেন এমনভাবে যে, তাঁর পেছনের সারির দাঁতগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ল। তিনি বললেন : "তোমার সন্তানের যথার্থ প্রতিশোধ নিয়েছ।”

পরের দিন যখন মহানবী (সা.) তাঁর সেনাদলকে ‘হামরাউল আসাদ’-এর দিকে পরিচালিত করলেন, নাসীবাও সেনাবাহিনীর সাথে যেতে চাইলেন। কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত হবার কারণে তাঁকে যাবার অনুমতি দেয়া হয় নি। মহানবী হামরাউল আসাদ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে এক ব্যক্তিকে নাসীবার ঘরে পাঠান যাতে তিনি নাসীবার অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে অবগত করেন। মহানবী তাঁর সুস্থতার সংবাদ পেয়ে খুশী হন।

এই নারী এত ত্যাগের বিনিময়ে মহানবীর কাছে আবেদন করেন, যাতে তিনি তাঁর জন্য প্রার্থনা করেন, মহান আল্লাহ্ যেন তাঁকে বেহেশতে মহানবীর নিত্য সহচর করেন। মহানবীও তাঁর জন্য দুআ করেন এবং বলেন : "হে আল্লাহ্! এদেরকে বেহেশতে আমার সাথী করে দিন।”

এই মহিয়সী নারীর বীরত্বের দৃশ্য মহানবীকে এতখানি আনন্দিত করে যে, তিনি এই নারী সম্পর্কে বলেছিলেন : لمقام نسيبة بنت كعب اليوم خير من فلان و فلان "আজ নাসীবা বিনতে কা’ব-এর মর্যাদা অমুক অমুকের চাইতে শ্রেষ্ঠ।”

ইবনে আবীল হাদীদ লিখেছেন, হাদীস বর্ণনাকারী মহানবীর প্রতি খেয়ানত করেছেন। কেননা এ দু’ব্যক্তির নাম পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন নি।  তবে আমি মনে করি, অমুক অমুক বলতে ঐ লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যাঁরা রাসূলের পরে মুসলমানদের মধ্যে বড় বড় পদমর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন; বর্ণনাকারী তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাজনিত ভীতির কারণেই কথাটি অস্পষ্ট রেখে দিয়েছেন। (ইবনে আবিল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ১৪তম খণ্ড পৃ. ২৬৫-২৬৭; উসদুল গাবাহ্, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৫৫৫)

এই আত্মত্যাগী নারীর বীরত্ব ও সেবা এখানেই শেষ হয় নি; পরবর্তীতে নিজ সন্তানসহ মুসাইলিমা কায্যাবের ফিতনার সময় যুদ্ধে গমন করেছিলেন এবং সে যুদ্ধে তিনি তাঁর একখানা হাত হারিয়েছিলেন।  

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: