bayyinaat

Published time: 20 ,November ,2018      00:36:14
নাহজুল বালাগায় ‘তাকওয়া’
নাহজুল বালাগায় তাকওয়া একটি আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে উত্থাপিত হয়েছে যা অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হয়। আর এর বহু চি‎হ্ন, নিদর্শন এবং অপরিহার্য-অবিচ্ছেদ্য বিষয় ও ফলাফল রয়েছে। তাকওয়া পাপ থেকে বিরত থাকাকে সহজসাধ্য করে।
সংবাদ: 112

নাহজুল বালাগায় তাকওয়া

২২৮ নং খুতবায় তিনি বলেছেন, فإن تقوى الله مفتاح سداد و ذخيرة معادٍ و عتق من كلّ ملكةٍ و نجاة من كلّ هلكةٍ  

সারাংশ : নাহজুল বালাগায় তাকওয়া একটি আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে উত্থাপিত হয়েছে যা অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হয়। আর এর বহু চিহ্ন, নিদর্শন এবং অপরিহার্য-অবিচ্ছেদ্য বিষয় ও ফলাফল রয়েছে। তাকওয়া পাপ থেকে বিরত থাকাকে সহজসাধ্য করে।

ট্যাগ : ইমাম আলী (আ.), তাকওয়া. নাহজুল বালাগা, তাকওয়া ও নিরাপত্তা, পারস্পরিক প্রতিশ্র"তি ও অঙ্গীকার

মূল প্রবন্ধ: তাকওয়া’ ‘নাহজুল বালাগার অন্যতম বহুল ব্যবহৃত শব্দ। খুব কম সংখ্যক বই-পুস্তকেই নাহজুল বালাগার মত তাকওয়ার ওপর এতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর নাহজুল বালাগায় তাকওয়ার সমপরিমাণ খুব কম বিষয় অর্থ ও ধারণার প্রতিই মনোযোগ দেয়া হয়েছে।

তাকওয়া কি?

সাধারণত এ রকম ধারণা করা হয় যে, ‘তাকওয়ার অর্থ পরহেজগারী (খোদাভীরুতা)। আরেক ভাবে বলা যায়, ‘তাকওয়ার অর্থ এক ধরনের নেতিবাচক ব্যবহারিক কার্যপদ্ধতি। অর্থাৎ পরিহার, সংযমশীলতা, পৃথক ও দূরে থাকা যত বেশি হবে তাকওয়াও তত বেশি পূর্ণাঙ্গ হবে। এ ব্যাখ্যা অনুসারে প্রথমত তাকওয়া হচ্ছে এমন এক অর্থ ও ধারণা যা কর্ম পর্যায় থেকে উদ্ভূত। দ্বিতীয়ত তাকওয়া হচ্ছে এক ধরনের নেতিবাচক প্রক্রিয়া। তৃতীয়ত নেতিবাচক দিক যত পরিমাণ তীব্রতর হবে তাকওয়া তত বেশি পূর্ণাঙ্গ হবে। এ কারণেই যাঁরা তাকওয়া অবলম্বন করেন যাতে করে কোন কলঙ্ক ও কালিমা তাঁদের তাকওয়ার ওপর পতিত না হয় সেজন্য তাঁরা যা কিছু কলঙ্ক আনয়ন করতে পারে তা পরিহার করেন এবং এ ধরনের যে কোন কাজে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ ও জড়িত হওয়া থেকেও বিরত থাকেন। নিঃসন্দেহে সংযমশীলতা ও পরিহারনীতি সুস্থ মানব জীবনের অন্যতম মূল ভিত্তি। সুস্থ জীবনে প্রত্যাখ্যান ও বাস্তবায়ন, বিলুপ্তিকরণ ও অপরিহার্যকরণ, বর্জন ও কর্ম সম্পাদন, মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও মনোযোগ দেয়া পরস্পর যুগল ও পরিপূরক। প্রত্যাখ্যান, রদ ও বিলুপ্তিকরণের মাধ্যমে বাস্তবে রূপায়ণ ও অপরিহার্যকরণের পর্যায়ে উপনীত হওয়া যায়। আর পরিহার, বর্জন ও মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে সম্পাদন ও মনোযোগ বাস্তবায়িত হয়।

কালেমা-ই তাওহীদ অর্থাৎ لا إله إلا الله (মহান আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই) সামগ্রিকভাবে প্রত্যাখ্যান ও বাস্তবায়ন সমন্বিত। আল­াহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্তাকে প্রত্যাখ্যান ও রদ করা ব্যতীত মহান আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় বলে স্বীকার করা সম্ভব নয়। বিরুদ্ধাচরণ ও আত্মসমর্পণ এবং কুফ্রী ও ঈমান পরস্পর নিত্যসঙ্গী অর্থাৎ প্রতিটি আত্মসমর্পণের মধ্যেই বিরুদ্ধাচরণ নিহিত আছে এবং প্রতিটি ঈমানের সাথে একটি করে কুফ্র রয়েছে। প্রতিটি অপরিহার্যকরণ, বাস্তবায়ন (প্রমাণ) ও প্রতিষ্ঠার মধ্যে বিলুপ্তিকরণ (রহিতকরণ) ও প্রত্যাখ্যান নিহিত আছে।

 পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ و يُؤْمِنْ بِاللهِ فقَد اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الوُثْقى

"যে খোদাদ্রোহী শক্তিতে অবিশ্বাস করে মহান আল­াহ্য় বিশ্বাস করবে সে আসলে দৃঢ় মজবুত রশিকেই আঁকড়ে ধরল।

তবে প্রথমত সংযমশীলতা, প্রত্যাখ্যান, বিলুপ্তিকরণ, বিরুদ্ধাচরণ ও অবিশ্বাস পরস্পর বৈপরিত্যের পর্যায়ের تضاد অর্থাৎ একটি বিপরীত জিনিস পরিহার ও বর্জন অপর আরেকটি বিপরীত জিনিস বা বিষয় অর্জন করার সোপান। একটি বিপরীত জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া আসলে অন্য আরেকটি বিপরীত জিনিস বা বিষয়ের সাথে জড়িত হওয়ার পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপস্বরূপ।

এ কারণেই প্রতিটি সুস্থ ও উপকারী পরিহার ও বর্জনের ঠিক যেমন নির্দিষ্ট দিক ও লক্ষ্য রয়েছে এবং নির্দিষ্ট সীমারেখা দ্বারা চিন্তিহ্নত ও সুনির্দিষ্ট, ঠিক তেমনি অন্ধ অনুকরণকৃত ব্যবহারিক কর্ম প্রক্রিয়ার না কোন দিক ও লক্ষ্য আছে আর না তা কোন সীমারেখা দ্বারা সুস্পষ্ট ও সীমিত, সংরক্ষণযোগ্য ও প্রশংসনীয়।

দ্বিতীয়ত নাহজুল বালাগায় তাকওয়ার বর্ণিত তাৎপর্য ও অর্থ সংযমশীলতার সাথে, এমন কি এর যৌক্তিক অর্থেরও সমার্থক নয়। নাহজুল বালাগায় বর্ণিত তাকওয়া এমন একটি আধ্যাত্মিক শক্তি যা প্রচুর চর্চা ও অনুশীলনের দ্বারা বিকশিত হয়। যৌক্তিক সংযমশীলতাসমূহ একদিকে যেমন এ আত্মিক অবস্থার উৎপত্তির কারণ ও প্রারম্ভিকাস্বরূপ, ঠিক তেমনি অন্যদিকে এগুলো এ আত্মিক অবস্থা অর্থাৎ তাকওয়ারই ফলাফল ও পরিণতি এবং এর অবিচ্ছেদ্য বিষয়াদিরও অন্তর্ভুক্ত। এ আত্মিক অবস্থা আত্মাকে শক্তিশালী ও সজীব করে এবং এক ধরনের নিরাপত্তা প্রদান করে। যে লোকের এ শক্তি নেই (অর্থাৎ যার তাকওয়া নেই) সে যদি নিজেকে পাপাচার থেকে রক্ষা করতে চায় পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণসমূহ থেকে দূরে থাকা ছাড়া তার আর কোন উপায়ই নেই। আর যেহেতু সমাজে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণসমূহ সর্বদা বিদ্যমান, তাই তাকে বাধ্য হয়েই সামাজিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন ও নির্লিপ্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকতে হবে। এ যুক্তির আলোকে মুত্তাকী ও পরহেজগার ব্যক্তিকে হয় অবশ্যই সামাজিক পরিবেশ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে ও সরিয়ে ফেলতে হবে নতুবা তাকওয়া বিসর্জন দিয়ে অবশ্যই সামাজিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করতে হবে। এ ধরনের যুক্তির আলোকে যে সব ব্যক্তি যত বেশি পরিহার ও বর্জন নীতি অবলম্বন করবে এবং নির্লিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন থাকবে সাধারণ জনতার দৃষ্টিতে তাদের তাকওয়া তত বেশি বিকশিত হবে। তবে কোন ব্যক্তির মাঝে যদি তাকওয়ার আধ্যাত্মিক শক্তি বিকশিত হয় তাহলে তার পক্ষে সমাজকে বর্জন করার কোন আবশ্যকতা নেই। সমাজ ও জাগতিক পরিমণ্ডলকে ত্যাগ না করেও নিজেকে পবিত্র এবং দোষত্র"টি থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব।

প্রথম গোষ্ঠীটি হচ্ছে ঐ সব ব্যক্তির মত যারা কোন একটি সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হবার ভয়ে নিজেদের আবাসিক এলাকা ত্যাগ করে পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আর দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি হচ্ছে ঐ সব ব্যক্তির ন্যায় যারা এক ধরনের ভ্যাক্সিন গ্রহণ করে নিজেদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সৃষ্টি করে। তাই তাঁরা নগর থেকে বের হওয়া প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন না; বরং তাঁরা রোগীদের সাহায্যার্থে অগ্রসর হন এবং তাদেরকে সেবাশুশ্রƒষা করে রোগ মুক্ত ও সুস্থ করেন। কবি শেখ সাদী প্রথম গোষ্ঠীটি প্রসঙ্গে বলেছেন,

"একজন আবেদকে দেখলাম জগৎ-সংসার থেকে বিমুখ হয়ে পাহাড়ের একটি গুহায়।

আমি বললাম : কেন আপনি নগরের ভেতরে আসতে চাচ্ছেন না

এমনও তো হতে পারে, আপনি অন্তঃকরণসমূহের জটিলতা সৃষ্টিকারী গিঁটগুলো খুলে দিতে সক্ষম?

তখন ঐ আবেদ বললেন : সেখানে অনেক মনোরম দেহ সৌষ্ঠব ও সুন্দর চেহারার অধিকারী ব্যক্তি তো আছেই।

যখন পথ বেশি কর্দমাক্ত হয় তখন হাতীরও পদস্খলন হয়।

নাহজুল বালাগায় তাকওয়া একটি আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে উত্থাপিত হয়েছে যা অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হয়। আর এর বহু চিহ্ন, নিদর্শন এবং অপরিহার্য-অবিচ্ছেদ্য বিষয় ও ফলাফল রয়েছে। তাকওয়া পাপ থেকে বিরত থাকাকে সহজসাধ্য করে।

ذمَّتِيْ بما أقول رهينة و أنا به زعيمإن من صرحت له العبر عمّا بين يديه من المثلات حجره التّقوى عن التقحم في الشهوات

নিশ্চয়ই আমি আমার নিজ বক্তব্যের সত্যতার নিশ্চয়তা দিচ্ছি এবং আমার বক্তব্যের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, সতর্ক ও যতœবান। যদি আমাদের অতীত উপদেশাবলী কোন ব্যক্তির কাছে আয়নাস্বরূপ হয় তাহলে তাকওয়া তাকে প্রবৃত্তি ও রিপুর কামনা-বাসনাসমূহে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।

ইমাম আলী (আ.) নাহজুল বালাগায় বলেছেন,

ألا وَ إِنّ الْخَطايا خَيْلُ شَمْسٍ حمل عليها راكبها و خلعت لجمها فتقَّحَمَتْ بِهِمْ في النَّارألا و إنَّ التّقوَى مطايا ذللٍ حمل عليها راكبها و أُعْطوا أزمتها فأوردتهم الْجنّة.  (نهج البلاغة خطبه:۱۶)

"তোমরা সবাই জেনে রাখ, নিশ্চয়ই পাপ ও অপরাধসমূহ এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা উদ্ধত-উচ্ছৃঙ্খল অশ্বসমূহের ন্যায় যেগুলো লাগামমুক্ত এবং যেগুলোকে বশ মানানোর ক্ষমতা আরোহীদের নেই। আর পরিণামে এ সব অশ্ব আরোহীকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করে। জেনে রাখ যে, তাকওয়ার উপমা হচ্ছে অনুগত ও পোষ মানা সওয়ারী পশুর মত যার লাগাম আরোহীর হাতের মুঠোয় এবং ঐ সব সওয়ারী পশু শান্তভাবে আরোহীদেরকে বেহেশ্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এ খুতবায় তাকওয়া একটি আত্মিক ও নৈতিক অবস্থা হিসেবে উলি­খিত হয়েছে যার প্রত্যক্ষ ফল ও প্রভাব হচ্ছে প্রবৃত্তিকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ ও সংযত রাখা। এ খুতবায় তিনি বলেছেন, "তাকওয়াহীনতা ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার আজ্ঞাবহ হওয়ার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে রিপুর কামনা-বাসনা ও তাড়নার সামনে দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং ব্যক্তিত্বহীনতা।

তাকওয়াহীন অবস্থায় মানুষ একজন অসহায় ও দুর্বল আরোহীর মত হয়ে যায় যার কোন নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি, ক্ষমতা ও স্বাধীনতা নেই। আর এই সওয়ারী পশু তাকে যেখানে ইচ্ছা সেখানে নিয়ে যায়। তাকওয়ার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি, আধ্যাত্মিক-নৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া এবং নিজ জীবন ও অস্তিত্ব বলয়ের অধিপতি হওয়া। তাকওয়াসম্পন্ন ব্যক্তি দক্ষ আরোহীর মত যে শিক্ষাপ্রাপ্ত অশ্বের ওপর আরোহণ করেছে এবং পূর্ণ শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ সমেত উক্ত ঘোড়াটিকে তার পছন্দমত লক্ষ্য ও দিকের পানে চালনা করছে এবং অশ্বও খুব সহজেই তার অনুগত থাকছে।

إنَّ تقوى اللهِ حمت أولياءَ اللهِ محارِمهُ و ألْزَمتْ قلوبَهم مخافته حتّى اسهرت لياليهم و أظْمَأتْ هواجِرَهُمْ

"নিশ্চয়ই মহান আল্লাহর তাকওয়া তার বন্ধুদেরকে নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে রক্ষা করে এবং বিরত রাখে; এই তাকওয়া খোদাভীতিকে তাদের অন্তরের নিত্যসঙ্গী করে দেয় যার ফলে তাদের রজনীগুলো (ইবাদত বন্দেগী করার কারণে) বিনিদ্রভাবে কেটে যায় এবং তাদের দিনগুলো (রোযা রাখার কারণে) তৃষ্ণার্ত অবস্থায় অতিবাহিত হয়।

এখানে হযরত আলী (আ.) বোঝাতে চেয়েছেন যে, তাকওয়া এমন এক বিষয় যা মহান আল­াহ্র নিষিদ্ধ বিষয়াবলীর ব্যাপারে মানুষকে সংযমী করে এবং খোদাভীতি যার অন্যতম অনিবার্য ও অপরিহার্য ফল ও পরিণতি। অতএব, ইমাম আলীর প্রদত্ত যুক্তি অনুসারে তাকওয়া না হুবহু সংযমশীলতা আর না তা হুবহু খোদাভীতি; বরং তাকওয়া হচ্ছে এমন এক পবিত্র আধ্যাত্মিক শক্তি যা এ সব বিষয় ও অবস্থার সৃষ্টি করে।

فإنَّ التّقْوى: في اليومِ الحِرزُ وَ الْجُنَّةُ و في غد الطَّريقِ إلى الجَنَّةِ

"নিশ্চয়ই তাকওয়া আজ (এ পার্থিব জীবনে) মানুষের রক্ষাকবচ ও ঢালস্বরূপ এবং আগামীকাল (আখেরাতে) বেহেশ্তে পৌছানোর পথ।

ইমাম আলী নাহজুল বালাগার ১৫৫ নং খুতবায় তাকওয়াকে সুউচ্চ ও সুরক্ষিত আশ্রয়স্থলের সাথে তুলনা করে বলেছেন যে, শত্র" (অর্থাৎ শয়তান ও প্রবৃত্তি) তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করতে অক্ষম।

এ সব ভাষণ ও খুতবায় ইমাম আলীর মনোযোগ ও দৃষ্টি তাকওয়ার মনস্তাত্তি¡ক ও নৈতিক দিক এবং তা আত্মার ওপর যে সব প্রভাব রাখে সেগুলোর দিকেই নিবদ্ধ। তাকওয়া মানুষের মধ্যে সৎ কাজ সম্পন্ন করার ও পবিত্রতার প্রতি ঝোঁক ও অনুভূতি সৃষ্টি করে এবং পাপ-পঙ্কিলতা ও অপবিত্রতার প্রতি ঘৃণাবোধের উন্মেষ ঘটায়।

এ ক্ষেত্রে (নাহজুল বালাগায়) আরো অন্যান্য নমুনা বিদ্যমান আছে। তবে সম্ভবত এতটুকু যথেষ্ট বলেই সেগুলো এখানে উলে­খ করা নিম্মেপ্রয়োজন।

তাকওয়া নিরাপত্তা ও রক্ষাকবচ, তা সীমাবদ্ধতা আরোপকারী নয়

নাহজুল বালাগার উপদেশমূলক বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা (করা) হচ্ছে। আমরা তাকওয়া থেকে শুরু করেছি। আমরা দেখেছি যে, নাহজুল বালাগার দৃষ্টিতে তাকওয়া এক পবিত্র আধ্যাত্মিক শক্তি যা সুমহান নৈতিক-আধ্যাত্মিক ও অপাশবিক মূল্যবোধসমূহের প্রতি আকর্ষণ এবং হীনতা-নীচতা ও বস্তুবাদের দূষণ থেকে মুক্তির উৎস। নাহজুল বালাগার দৃষ্টিতে তাকওয়া এমন এক অবস্থা যা মানবাত্মাকে ব্যক্তিত্ব, শক্তি ও অনুপ্রেরণা দান করে এবং মানুষকে তার নিজ প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রক ও অধিকর্তা করে দেয়।

তাকওয়া নিরাপত্তা

নাহজুল বালাগায় এ ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে যে, তাকওয়া নিরাপত্তাবেষ্টনী, রক্ষাকবচ ও আশ্রয়স্থল। তা শিকল, কারাগার ও সীমাবদ্ধতা নয়। এমন অনেক লোক আছে যারা নিরাপত্তা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে কোন পার্থক্য করে না এবং স্বাধীনতা ও বন্ধন থেকে মুক্ত হবার নামে তারা তাকওয়ার সুরক্ষিত দুর্গ ধ্বংসের পক্ষে রায় দিয়ে থাকে।

আশ্রয়স্থল ও কারাগারের মধ্যকার অভিন্ন বিষয় হচ্ছে প্রতিহতকরণ, বাধা দান ও দুর্ভেদ্যতা। তবে আশ্রয়স্থল বিপদসমূহ প্রতিহত করে, আর কারাগার সামর্থ্য, যোগ্যতা এবং নিয়ামতসমূহ ব্যবহার করা থেকে বাধা দান করে। হযরত আলী (আ.) বলেছেন,

اعلموا عباد الله, إنّ التقوى دارحصن عزيز و الفجور دار حصن ذليل. لا يمنع أهله و لا يحرز من لجأ إليه. الا و بالتقوى تقطع حمة الخطايا.

"মহান আল্লাহর বান্দাগণ! জেনে রাখো, নিশ্চয়ই তাকওয়া সুউচ্চ ও অপ্রতিরোধ্য দুর্গ, আর তাকওয়াহীনতা অর্থাৎ লাম্পট্য ও অনৈতিকতা এমন এক দুর্গ যা বসবাসকারীদেরকে নিরাপত্তা দান করে না এবং শত্র"র আক্রমণ ও বিপদাপদ প্রতিহত করে না। যে এতে আশ্রয় নেয় তাকে রক্ষা করে না। জেনে রাখ তাকওয়ার দ্বারাই পাপের বিষাক্ত ছোবল ও দংশনের প্রভাব প্রশমিত হয়।

হযরত আলী (আ.) তাঁর এ উচ্চাঙ্গের বাণী ও বক্তব্যের দ্বারা পাপ ও স্খলনকে দংশনকারী সাপ ও বিচ্ছুর সাথে তুলনা করেছেন যা মানুষের আত্মাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তিনি বলেছেন, "তাকওয়া এসব পাপ ও অপরাধের বিষাক্ত দংশন ও ছোবল প্রশমিত করে।

হযরত আলী কতিপয় বাণীতে স্পষ্ট করে বলেছেন, "তাকওয়া স্বাধীনতার প্রকৃত উৎস অর্থাৎ তাকওয়া কেবল বন্ধন ও পরাধীনতা এবং স্বাধীনতার বাধা তো নয়ই বরং তা সকল প্রকার স্বাধীনতার উৎস।

২২৮ নং খুতবায় তিনি বলেছেন, فإن تقوى الله مفتاح سداد و ذخيرة معادٍ و عتق من كلّ ملكةٍ و نجاة من كلّ هلكةٍ "নিশ্চয়ই মহান আল্লাহর তাকওয়া সততার চাবি, আখেরাতের পাথেয়, সকল ধরনের দাসত্ব থেকে মুক্তি এবং সকল প্রকার ধ্বংস থেকে নাজাতস্বরূপ।

প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তাকওয়া মানুষকে নৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করে অর্থাৎ তাকে প্রবৃত্তি ও রিপুর কামনা-বাসনার দাসত্ব ও বন্ধন থেকে মুক্ত করে। তাকওয়া মানুষের কাঁধ থেকে লোভ-লালসা, হিংসা-দ্বেষ, খ্যাতি ও ক্রোধ দূরীভূত করে। আর এভাবেই তাকওয়া সকল ধরনের সামাজিক দাসত্ব ও পরাধীনতার মূলোৎপাটন করে। যে সব ব্যক্তি অর্থ, পদমর্যাদা ও আরাম-আয়েশের দাস না হবে তারা কখনোই সামাজিক দাসত্ব ও বন্দীত্ব দশার কাছে নতি স্বীকার করবে না।

নাহজুল বালাগায় তাকওয়ার প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে অনেক আলোচনা করা হয়েছে এবং এগুলোর সব কিছু সম্পর্কে পুনরায় আলোচনা করা নিম্মেপ্রয়োজন। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে নাহজুল বালাগার মতাদর্শে বর্ণিত তাকওয়া শব্দের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য স্পষ্ট হওয়া যাতে করে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, এ শব্দের ওপর হযরত আলী কেন এত তাগিদ দিয়েছেন।

তাকওয়ার প্রভাব ও ফলাফলসমূহ যা এখানে উলে­খ করা হয়েছে তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুটি। যথা : (ক) স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচক্ষণতা এবং (খ) সমস্যা সমাধান করার যোগ্যতা এবং বিপদাপদ, সংকীর্ণতা ও কাঠিন্য থেকে মুক্তি। যেহেতু আমরা অন্যত্র এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছি এবং এ ব্যাপারটি অত্র আলোচনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা তাকওয়ার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে তা থেকে বাইরে। তাই এসব ব্যাপারে আলোচনা করা থেকে আমরা বিরত থাকছি।

আর আমরা তাকওয়া সংক্রান্ত আলোচনার শেষে মানুষ ও তাকওয়ার মধ্যকার পারস্পরিক প্রতিশ্র"তি ও অঙ্গীকার সংক্রান্ত নাহজুল বালাগার সূ² যেসব ইঙ্গিত রয়েছে সেগুলো বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকছি।

পারস্পরিক প্রতিশ্র"তি ও অঙ্গীকার

পাপ ও স্খলনের বিপরীতে তাকওয়া এক ধরনের রক্ষাকবচ-এ ব্যাপারে নাহজুল নালাগায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা সত্তে¡ও এ বিষয়ের দিকেও মনোযোগ দেয়া হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে তাকওয়ার সংরক্ষণ ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের অবহেলা প্রদর্শন করা অনুচিত। তাকওয়া মানুষের রক্ষক এবং মানুষ তাকওয়ার রক্ষক এবং এ ধরনের চক্র অসম্ভব নয় বরং তা বৈধ।

এ ধরনের পারস্পরিক রক্ষণাবেক্ষণ আসলে মানুষ ও পোশাকের পারস্পরিক রক্ষণাবেক্ষণের অনুরূপ। মানুষ চুরি ও ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাওয়া থেকে তার নিজ পোশাককে রক্ষা করে এবং পোশাকও মানুষকে শীত ও গরমের হাত থেকে রক্ষা করে। যেহেতু আমরা জানি পবিত্র কোরআন তাকওয়াকে জামা বা পোশাকের সাথে তুলনা করেছে- আর তাকওয়ার ভূষণই উত্তম

(و لباس التقوى ذلك خير)তাই হযরত আলী (আ.) মানুষ ও তাকওয়ার পারস্পরিক সংরক্ষণ সম্পর্কে বলেছেন,

ايقظوا بها نومكم و اقطعوا بها يومكم و أشعروها قلوبكم و ارحضوا بها ذنوبكم... ألا فصونوها و تصونوابها

"তাকওয়ার দ্বারা নিজেদের নিদ্রাকে জাগরণে রূপান্তরিত কর এবং তাকওয়া সহকারে তোমাদের নিজেদের দিবা ভাগকে অতিবাহিত কর। আর তোমাদের অন্তঃকরণসমূহে তাকওয়ার অনুভূতিকে জাগ্রত রাখ এবং তাকওয়ার দ্বারা তোমাদের পাপসমূহ ধৌত কর।... অবশ্যই তোমরা তাকওয়াকে রক্ষা করবে এবং নিজেদেরকে তাকওয়ার মাধ্যমে সংরক্ষণ করবে।

তিনি আরো বলেছেন,

 أوصيكم عباد الله بتقوى الله فإنّها حقّ الله عليكم و الموجبة على الله حقّكم و ان تستعينوا عليها بالله و تستعينوا بها على الله

"হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমাদের সবাইকে আমি তাকওয়া অবলম্বন করার ওসিয়ত করছি। নিশ্চয়ই তা তোমাদের ওপর মহান আল্লাহর অধিকার (হক) এবং মহান আল্লাহর কাছে তোমাদের অধিকার সৃষ্টিকারী। আমি তোমাদেরকে তাকওয়া অর্জন করার ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে এবং তাকওয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের ওসিয়ত করছি।

সংগ্রহে : মোহাম্মাদ ফারুক হুসাইন

 

তথ্যসূত্র[1]



. নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা ১৬।

২. নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা ১১২।

৩. নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা ১৮৯।

৪. নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা ১৫৭।

৫. নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা  ১৮৯।

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: