ইসলামের দৃষ্টিতে পরার্মশের গুরুত্ব
সংগ্রহে : মোহাম্মাদ ফারুক হুসাইন
সারাংশ : যে নিজের কথা ও চিন্তা-ভাবনার ওপর নির্ভর করে (এবং অন্যের পরামর্শ ও অভিমত উপেক্ষা করে) সে আসলে নিজেকে বিপদ ও সমস্যার সাথে জড়িয়ে ফেলে; আর যে ব্যক্তি অন্যের অভিমতকে স্বাগত জানায় অর্থাৎ তা থেকে সাহায্য নেয় সে স্খলন ও ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়। মহান আল্লাহ্ ভুল-ভান্তির ঊর্ধে হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় নবী (সা.)-কে তাঁর সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ট্যাগ: পরামর্শ, স্বেচ্ছাচারিতা ও একগুঁয়েমি পরিহার, পরামর্শদাতার বৈশিষ্ট্য, পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা রক্ষা
মূল প্রবন্ধ: (সকল কাজে পরামর্শ করা) জীবনের সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করার চিন্তা সবারই আছে। সমস্যা সমাধানের উত্তম পন্থা হচ্ছে পরামর্শ করা এবং অপরের চিন্তা-ভাবনা থেকে উপকৃত হওয়া।
ইমাম আলী (আ.) বলেন :
... وَ لَا ظَهِيْرَ كَالْمُشَاوَرَةِ
"...পরামর্শের মতো কোনো (উত্তম) সাহায্যকারী ও আশ্রয়স্থল নেই।”১
তিনি আরো বলেছেন :
الإِسْتِشَارَةُ عَيْنُ الْهِدَايَةِ
"পরামর্শ করাই হচ্ছে হেদায়েত বা সুপথপ্রাপ্তি।”২
ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেন :
لَنْ يُبْلِكُ امْرُءٌ عَنْ مَشْوَرَةٍ
"পরামর্শ করার কারণে কেউ তোমাকে কখনোই বিপদে ফেলতে পারবে না।”৩
মহানবী (সা.) বলেন :
الحَزْمُ أَنْ تَسْتَشِيْرَ دَا الرَّأْيِ وَ تُطِيْعَ أَمْرَهُ
"কাজে-কর্মে সতর্কতা অবলম্বন করার পন্থা হচ্ছে চিন্তাশীল লোকের সাথে পরামর্শ করে তার কথা মেনে চলা।”৪
পবিত্র কোরআন মহানবী (সা.)-কে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছে :
وَ شَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ
"তাদের (মুসলমানদের) সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন ও তা কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন তখন মহান আল্লাহ্র ওপর ভরসা করুন।”৫
মুমিন-মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
وَ الَّذِيْنَ اسْتَجَابُوا لِرَبِّهِمْ وَ أَقَامُوا الصَّلوةَ وَ أَمْرُهُم شُوْرَى بَيْنَهُمْ وَ مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يَنْفِقُوْنَ
"এবং যারা নিজেদের প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়েছে (অর্থাৎ সত্যের আহ্বান গ্রহণ করেছে), নামায কায়েম করেছে, নিজেদের সকল কাজে-কর্মে একে অপরের সাথে পরামর্শ করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে মহান আল্লাহ্র পথে দান ও ব্যয় করে।”৬
ইসলামে স্বেচ্ছাচারিতা, একগুঁয়েমি মনোভাব এবং ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ও অহংকার অর্থাৎ অন্যের অভিমত ও পরামর্শকে তোয়াক্কা না করা নিষিদ্ধ।
হযরত আলী (আ.) বলেন :
وَ مَنْ اسْتَبَدَّ بِرَأْيِهِ هَلَكَ وَ مَنْ شَاوَرَ الرِّجَالَ شَارَكَهَا فِيْ عُقُوْلِهَا
"যে স্বেচ্ছাচারিতা ও একগুঁয়েমি প্রকাশ করবে (অর্থাৎ অন্যের অভিমত উপেক্ষা করে নিজের অভিমতকে প্রাধান্য দেবে) সে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং যে ব্যক্তি বিভিন্ন মানুষের সাথে পরামর্শ করবে সে তাদের চিন্তা, বুদ্ধি ও মতেরই অংশীদার হবে।”৭
ইমাম সাদেক (আ.) বলেন :
المُسْتَبِدُّ بِرَأْيِهِ مَوْقُوْفٌ عَلَى مَدَاحِضِ الزّلَلِ
"স্বেচ্ছাচারী-একগুঁয়ে ব্যক্তি যেন উঁচু কঙ্করময় স্থানের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে (যে কোনো সময় তার পদস্খলন হতে পারে)।”৮
হযরত আলী তাঁর পুত্র মুহাম্মদ ইবনে হানাফীয়ার উদ্দেশে কৃত অসিয়তে বলেন :
قَدْ خَاطَرَ بِنَفْسِهِ مَنِ اسْتَغْنَى بِرَأْيِهِ وَ مَنِ اسْتَقْبَلَ وُجُوْه الْآرَاءِ عَرَفَ مَوَاقِعَ الْخَطَإِ
"যে নিজের কথা ও চিন্তা-ভাবনার ওপর নির্ভর করে (এবং অন্যের পরামর্শ ও অভিমত উপেক্ষা করে) সে আসলে নিজেকে বিপদ ও সমস্যার সাথে জড়িয়ে ফেলে; আর যে ব্যক্তি অন্যের অভিমতকে স্বাগত জানায় অর্থাৎ তা থেকে সাহায্য নেয় সে স্খলন ও ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়।”৯
কাদের পরামর্শ নেয়া উচিত
যে কোনো লোকের সাথে পরামর্শ করার অনুমতি ইসলাম দেয় না; বরং যাদের পরামর্শ দেয়ার যোগ্যতা আছে তাদের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দেয়।
ইমাম সাদেক (আ.) বলেন :
اِسْتَشِرْ فِيْ أَمْرِكَ الَّّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ
"তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে এমন ব্যক্তিদের পরামর্শ নাও যারা স্বীয় প্রভুকে ভয় করে।”১০
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন :
اِسْتَشِرِ الْعَاقِلَ مِنَ الرِّجَالِ الْوَرْعِ فَإِنَّهُ لَا يَأْمُرُ إِلَّا بِخَيْرٍ وَ إِيَّاكَ وَ الْخِلَافَ فَإِنَّ مُخَالَفَةَ الْوَرْعِ الْعَاقِلِ مَفْسَدَةٌ فِي الدِّيْنِ وَ الدُّنْيَا
"বুদ্ধিমান খোদাভীরু ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ কর; কারণ, সে মঙ্গল ও কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছুর নির্দেশ দেয় না। তাই তোমাকে দ্বিমত পোষণ ও বিরোধিতা করা থেকে সাবধান করে দিচ্ছি। কারণ, বুদ্ধিমান খোদাভীরু ব্যক্তির (অভিমতের) বিরোধিতা দীন-দুনিয়া বরবাদ করে দেয়।”১১
তিনি আরো বলেন :
إِنَّ الْمَشْوَرَةَ لَا تَكُوْنُ إِلَّا بِحُدُوْدِهَا فَمَنْ عَرَفَهَا بِحُدُوْدِهَا وَ إِلَّا كَانَتْ مَضَرَّتُهَا عَلَى الْمُسْتَشِيْرِ أَكْثَرَ مِنْ مَنْفَعَتِهَا لَهُ، فَأَوَّلُهَا أَنْ يَكُوْنَ الَّذِيْ تُشَاوِرُهُ عَاقِلاً وَ الثَّانِيَةُ أَن يَكُوْنَ حُرّاً مُتَدَيِّناً وَ الثَّالِثَةُ أَن يَكُوْنَ صَدِيْقاً مُوَاخِياً وَ الرَّابِعَةُ أَن تطلعَهُ عَلَى سِرِّكَ فَيَكُوْنَ عِلْمُهُ بِهِ كَعِلْمِكَ بِنَفْسِكَ ثُمَّ يُسِرّ ذلِكَ وَ يَكْتُمهُ فَإِنَّهُ إِذَا كَانَ عَاقِلاً انْتَفَعْتَ بِمَشْوَرَتِهِ وَ إِذَا كَانَ حُرّاً مُتَدَيِّناً اجهد نَفْسَهُ فِي النَّصِيْحَةِ لَكَ وَ إِذَا كَانَ صَدِيْقاً مُوَاخِياً كَتَمَ سِرَّكَ إِذَا اطلعتَهُ عَلَيْهِ وَ إِذَا اطلعتَهُ عَلَى سِرِّكَ فَكَانَ عِلْمُهُ بِهِ كَعِلْمِكَ بِهِ تَمَّتِ الْمَشَوَرَةُ وَ كَمُلَتِ النَّصِيْحَةُ
"পরামর্শের কিছু সীমা (শর্ত) আছে যা ব্যতীত পরামর্শই সম্ভব হয় না। অতঃপর যে পরামর্শের সীমা না জানবে এমতাবস্থায় এর ক্ষতি পরামর্শ গ্রহীতার ওপর এর উপকার ও লাভ অপেক্ষা বেশি হবে। পরামর্শ করার প্রথম শর্ত হচ্ছে তুমি যার সাথে পরামর্শ করছ তার বুদ্ধিমান হওয়া; দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে পরামর্শদাতার স্বাধীন, মুক্তমনা ও ধার্মিক হওয়া; তৃতীয় শর্ত হচ্ছে ভ্রাতৃপ্রতিম হওয়া এবং চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, যদি তুমি তাকে তোমার গোপন রহস্য জানাও তা হলে তোমার গোপন রহস্য সম্পর্কে তার জ্ঞান তোমার জ্ঞানেরই অনুরূপ হবে এবং তখন তার উচিত হবে তা গোপন রাখা। অতঃপর সে যদি বুদ্ধিমান হয় তা হলে তুমি তার প্রদত্ত পরামর্শের দ্বারা উপকৃত হবে। আর সে যদি স্বাধীন, মুক্তমনা ও ধার্মিক হয় তা হলে সে তোমাকে উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে; আর সে ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু হলে সে তোমার গোপন রহস্য গোপন রাখবে। আর যখন তুমি তাকে তোমার গোপন রহস্য সম্পর্কে অবগত করবে এবং তোমার গোপন রহস্য সম্পর্কে তার জ্ঞান ঐ রহস্য সংক্রান্ত তোমার জ্ঞানেরই অনুরূপ হবে তখন তার পরামর্শ পূর্ণতা লাভ করবে।”১২
ইসলাম পরামর্শ করার ক্ষেত্রে মানুষের পদমর্যাদা ও সামাজিক সম্মানকে বিবেচনায় আনে নি। তাই আমরা দেখতে পাই যে, মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-কে তাঁর সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইমাম সাদেক (আ.) বলেন :
امّا انّه إذا فعل ذلك لم يخذ له الله بل يرفعه الله و رماه بخير الأمور و أقربها إلى الله تعالى
"মানুষ যদি পরামর্শ করে তা হলে মহান আল্লাহ্ তাকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকেন না; বরং মহান আল্লাহ্ তার মর্যাদাকে উন্নীত করেন এবং তাকে সর্বোত্তম কাজ করার সামর্থ্য দান করেন এবং এভাবে বান্দা তার নৈকট্য লাভ করে থাকে।”১৩
ইমাম রেযা (আ.) তাঁর পিতা ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন :
كَانَ عَقْلُهُ لَا تُوَازَنُ بِهِ الْعُقُوْلُ وَ رُبَّمَا شَاوَرَ الْأَسْوَدَ مِنْ سُوْدِ أَنَّهُ فَقِيْلَ لَهُ تُشَاوِرُ مِثْلَ هذَا؟ فَقَالَ إِنَّ اللهَ تَبَارَكَ وَ تَعَالَى رُبَّمَا فَتَحَ عَلَى لِسَانِهِ...
"তাঁর বিবেক, জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির সাথে অন্য কারো বিবেক, জ্ঞান ও বিচার-বুদ্ধির কোনো তুলনাই চলে না। এতদসত্তে¡ও তিনি তাঁর দাসদের মধ্য থেকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হাবাশী দাসের সাথে পরামর্শ করতেন। তাই যখন তাঁকে বলা হলো : আপনি এর মতো লোকের সাথে পরামর্শ করেন? তখন তিনি বলেছিলেন : মহান আল্লাহ্ তার কণ্ঠের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান বাতলে দেন।”১৪
যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী নয় তাদের সাথে পরামর্শ করার অনুমতি ইসলাম দেয় নি। মহানবী (সা.) হযরত আলীকে বলেছেন :
يَا عَلِيُّ لَا تُشَاوِرَنَّ جَبَانَ فَإِنَّهُ يَضِيْقُ عَلَيْكَ الْمَخْرَجَ... وَ لَا تُشَاوِرَنَّ حَرِيْصاً فَإَنَّهُ يَزِيْدُ لَكَ شَرْهاً
"হে আলী! ভীরু-কাপুরুষের সাথে অবশ্যই পরামর্শ করবে না। কারণ, সে তোমার মুক্তির পথকে সংকীর্ণ করে দেবে। আর লোভী ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করবে না। কারণ, সে তোমার লোভ-লালসা বাড়িয়ে দেবে।”
পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা (খেয়ানত) না করা
ইসলাম মুসলমানদেরকে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা না করা এবং ভালোভাবে চিন্তা করে সঠিক অভিমত ব্যক্ত করার জোরালো নির্দেশ দিয়েছে।
ইমাম আলী (আ.) বলেন :
مَنْ غَشَّ الْمُسْلِمِيْنَ فِيْ مَشْوَرَةٍ فَقَدْ بَرِئْتُ مِنُهُ
"ঐ ব্যক্তির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই যে পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে ধোঁকা দেয়।”১৫
তিনি আরো বলেন :
اَلْمُشْتَشَارُ مُؤْتَمَنٌ...
"পরামর্শদাতা হচ্ছে বিশ্বস্ত...।”১৬
তথ্যসূত্র[1]
১. ইসলাম দীনে মুআশারাত, পৃ. ১৩০
২.প্রাগুক্ত।
৩.প্রাগুক্ত।
৪.বিহারুল আনওয়ার, ১৫তম খণ্ড, কিতাবুল ইশরাহ্, পৃ. ১৪৬।
৫.সূরা শুরা : ৩৮।
৬.সূরা নিসা : ৫৮।
৭.নাহজুল বালাগাহ্।
৮.বিহারুল আনওয়ার, ১৫তম খণ্ড, কিতাবুল ইশরাহ্, পৃ. ১৪৬।
৯.ইসলাম দীনে মুআশারাত, পৃ. ১৩১।
১০.প্রাগুক্ত।
১১.প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২।
১২.প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২।
১৩.প্রাগুক্ত।
১৪.প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩।
১৫.বিহারুল আনওয়ার, ১৫তম খণ্ড, কিতাবুল ইশরাহ্, পৃ. ১৪৪।
১৬.ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৮।