bayyinaat

Published time: 22 ,November ,2018      23:20:15
বেলায়াতে ফকীহ্ কি ঐশী পদ, নাকি পার্থিব ও জনগণের দ্বারা নির্বাচনীয় পদ?
সারাংশ: হুকুমাতের বৈধতার মূল উৎস হচ্ছে দ্বীন এবং আল্লাহ্ তা‘আলার শরীয়াত বা আইন-বিধান প্রণয়ন বিষয়ক শাসন-কর্তৃত্ব। আর জনগণ কর্তৃক তা গ্রহণ করার ফলে প্রকৃত পক্ষে ফকিহের ঐশী হুকুমাত বাস্তবে কার্যোপযোগিতা লাভ করে এবং এর ফলে সে হুকুমাত সুদৃঢ় ও টেকসই হয়।
সংবাদ: 126

বেলায়াতে ফকীহ্ কি ঐশী পদ, নাকি পার্থিব ও জনগণের দ্বারা নির্বাচনীয় পদ?

সংগ্রহে : আবুল কাসেম 

 
 

সারাংশ: হুকুমাতের বৈধতার মূল উৎস হচ্ছে দ্বীন এবং আল্লাহ্ তাআলার শরীয়াত বা আইন-বিধান প্রণয়ন বিষয়ক শাসন-কর্তৃত্ব। আর জনগণ কর্তৃক তা গ্রহণ করার ফলে প্রকৃত পক্ষে ফকিহের ঐশী হুকুমাত বাস্তবে কার্যোপযোগিতা লাভ করে এবং এর ফলে সে হুকুমাত সুদৃঢ় ও টেকসই হয়।

ট্যাগ: ইরান, ইসলামী বিপ্লব, ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ), বেলায়াতে ফকীহ্, শরীয়াত বা আইন-বিধান প্রণয়ন, শাসন-কর্তৃত্ব

জবাবঃ যেহেতু জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণকে নির্বাচন করে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা ফকিহ শাসককে নির্বাচিত করেন, অতএব, এর ভিত্তিতে সর্বোচ্চ নেতা পরোক্ষভাবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত এবং এ হিসেবে এটি একটি পার্থিব পদ ও তাঁর পদাভিষেক কার্যতঃ জনগণ কর্তৃক আইনগত বৈধতা লাভ করে, সেহেতু উপরোক্ত প্রশ্নের ও সংশয়ের উদয় হয়েছে।

এ প্রশ্ন ও সংশয়ের জবাবে বলতে হয় ঃ এভাবে জনগণ কর্তৃক বৈধতা প্রদান মানে প্রকৃত পক্ষে ফকিহ শাসককে গ্রহণ করে নেয়া। ফকিহ শাসকের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি নির্ধারণ করার জন্য ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে এমন একটি পথ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে যাতে আইনানুগ ফকিহ শাসক জনগণের সমর্থনের ফলে ইসলামী সমাজে খোদায়ী আইন-কানুন ও বিধি-বিধান বাস্তবায়ন ও কার্যকর করণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হন।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) অস্থায়ী সরকারের প্রধান মন্ত্রী নিয়োগের ঘোষণায় বলেন ঃ "শরয়ী অধিকার এবং ইরানী জনগণ আন্দোলনে শরীক হয়ে সারা ইরানে বহু সংখ্যক বিশাল বিশাল জনসভা ও বিরাট বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে অকাট্যভাবে প্রায় সর্বসম্মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহকারে যে মতামত ব্যক্ত করেছে তা থেকে উৎসারিত আইনগত অধিকারের ভিত্তিতে ... আমি আপনাকে  অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য দায়িত্ব প্রদান করলাম।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর দৃষ্টিতে জনগণ কর্তৃক নির্বাচন -তা বিশাল বিশাল জনসভা ও বিরাট বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমেই হোক বা সর্বোচ্চ নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের মাধ্যমেই হোক - মুজতাহিদ শাসকের হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্বের বৈধতার উৎস নয়। কারণ, হুকুমাতের বৈধতার মূল উৎস হচ্ছে দ্বীন এবং আল্লাহ্ তাআলার শরীয়াত বা আইন-বিধান প্রণয়ন বিষয়ক শাসন-কর্তৃত্ব। আর জনগণ কর্তৃক তা গ্রহণ করার ফলে প্রকৃত পক্ষে ফকিহের ঐশী হুকুমাত বাস্তবে কার্যোপযোগিতা লাভ করে এবং এর ফলে সে হুকুমাত সুদৃঢ় ও টেকসই হয়।

জনগণ যখন এ ধরনের হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্বকে গ্রহণ করে নেয় তখন দ্বীনের ওপর আস্থার ও খোদা-কেন্দ্রিকতার পতাকা উড্ডীন হয় এবং বেলায়াতে ফকীহ্র ছায়াতলে জনগণের অন্তঃকরণে ও দৃষ্টিতে তাওহীদ, নবুওয়াত ও ইমামতের সীমাহীন বরকত বর্ষিত হতে থাকে এবং পূর্ণতার পথ সমুজ্জল হয়ে ওঠে।

জনগণের এ ভূমিকাকেই গ্রহণযোগ্যতা (مقبوليت) নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ গ্রহণযোগ্যতা সকল যুগেই বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী ছিলো এবং সব সময়ই আদর্শ ও নেতৃত্বের পাশে স্থানলাভ করেছে। আর এ হচ্ছে এমন এক বাস্তবতা যে, হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) এর অধিকারী ছিলেন। তাই এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা এরশাদ করেন ঃ

هو الذی ايدک بنصره و بالمؤمنين.

"তিনিই সেই সত্তা যিনি স্বীয় সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা আপনাকে শক্তিশালী করেছেন।

এর কারণেই, আমরা দেখতে পাই, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) বলেন ঃ "জনগণ যদি তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় একজন ন্যায়বান ফকিহকে অধিষ্ঠিত করার জন্য নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করে এবং তাঁরা এক ব্যক্তিকে নেতৃত্বের জন্য নির্বাচিত করেন, অতঃপর তিনি নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে অবশ্যই তিনি জনগণ কর্তৃক গ্রহণযোগ্য হয়েছেন। ফলে তিনি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত শাসক এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ অবশ্য কার্যকরযোগ্য। (ছাহীফায়ে নূর, ২১তম খণ্ড, পৃঃ ১২৯)

জনগণ যদি নেতাকে সমর্থন না করে এবং নেতার পিছনে না থাকে তাহলে সুস্পষ্ট যে, জনগণের নিকট তাঁর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং এ কারণে তাঁর আদেশ-নিষেধ কার্যকর হয় না। কিন্তু এর মানে ফকিহ শাসককে জনগণ কর্তৃক বৈধতা প্রদান নয়। কারণ, গ্রহণ করা-নাকরা ও বৈধতা প্রদান এক কথা নয়। জনগণ গ্রহণ না করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত শাসক শাসনক্ষমতা পরিচালনার সুযোগ না পেতে পারেন, কিন্তু সে কারণে দ্বীন ও শরীয়াতের দৃষ্টিতে তাঁর মনোনয়ন বৈধতা হারায় না।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) অন্যত্র এ বিষয়টির ওপর সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করেছেন। ছাহীফায়ে নূর গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৯৫ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমামের (রহ্ঃ) যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেন ঃ "বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকিহের শাসন-কর্তৃত্ব এমন কোনো বিষয় নয় যা নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদ কর্তৃক তৈরী হয়েছে। বেলায়াতে ফকীহ্ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা মহান আল্লাহ্ তাআলা তৈরী করেছেন। আর এ হচ্ছে সেই শাসন-কর্তৃত্ব স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) যার অধিকারী ছিলেন।

একই গ্রন্থের ১৯তম খণ্ডের ২৩৭ নং পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত উক্তিতে হযরত ইমাম (রহ্ঃ) বলেন ঃ "পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকিহগণ মাছূম ইমামগণের (আঃ) পক্ষ থেকে সকল শরয়ী, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে প্রতিনিধিত্বের অধিকারী, আর হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে সকল বিষয়ের দায়িত্বই তাঁদের ওপর অর্পিত হয়েছে।

এ ধরনের ফকিহ শাসককে সমর্থন, সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা জনগণের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। আর ফকিহ শাসক যখন জনগণের সমর্থনপুষ্ট হন তখন তাঁর জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম আলী (আঃ) বলেন ঃ

لو لاحضور الحاضر و قيام الحجة بوجود الناصر.

"যদি এ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত না হতেন এবং এই সাহায্যকারীগণ থাকার কারণে আমার জন্য হুজ্জাত (চূড়ান্ত প্রমাণ) প্রতিষ্ঠিত না হতো (তাহলে আমি খেলাফতের এ দায়িত্ব গ্রহণ করতাম না)

নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণের দায়িত্ব হচ্ছে মাছূম ইমামগণের (আঃ) ও আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে মনোনীত ফকিহ শাসককে চিহ্নিত করা ও জনগণের নিকট পরিচয় করিয়ে দেয়া। তাঁরা হচ্ছেন মুজতাহিদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং এরূপ শাসককে চিহ্নিতকরণের যোগ্যতার অধিকারী। তাই তাঁরা সাক্ষ্য দেন যে, এই ব্যক্তি নেতা হওয়ার যোগ্যতার অধিকারী। বিষয়টি এমন নয় যে, নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণ Ñ যারা সমাজের সদস্যগণ তথা জনগণের অন্যতম, তাঁরা এক ব্যক্তিকে নেতা হিসেবে বৈধতা প্রদান করেন এবং তাঁকে এ পদের জন্য নির্বাচিত করেন। বরং নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণের কাজ হচ্ছে তাঁরা নেতৃত্বের মানদণ্ড সম্পর্কে যে জ্ঞান রাখেন তার ভিত্তিতে সমকালে এ মানদণ্ড যার ব্যাপারে প্রযোজ্য এমন ব্যক্তি সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করা। আর তাঁদের এভাবে সাক্ষ্যদানের ফলে যে সাধারণ জনগণ ফকিহ শাসককে চিহ্নিত করতে সক্ষম নয় তাদের করণীয় সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

অতীতেও সাধারণ লোকেরা মুজতাহিদদেরকে চেনার জন্য তাঁদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন এমন বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হতো। তারা তখন নিজ নিজ শহরের শীর্ষস্থানীয় ও মোত্তাকী-পরহেযগার খ্যাতনামা আলেমদের নিকট যেতো এবং জিজ্ঞেস করতো ঃ "সবচেয়ে বড় অলেম কে? বেশী জ্ঞানী কে?” আজকের দিনেও সাধারণ জনগণ পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য নির্বাচন করে। আর নির্বাচিত বিশেষজ্ঞগণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাঁদের বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে এ ধরনের ফকিহ নেতাকে চিহ্নিত করেন এবং তাঁকে জনগণের সামনে পরিচিত করিয়ে দেন, যাতে জনগণ মাছূম ইমামের (আঃ) পক্ষ থেকে মনোনীত পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকিহ শাসকের প্রতি সমর্থন ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর জন্য আল্লাহ্ তাআলার বিধি-বিধান বাস্তবায়নের পথকে মসৃণ করে দিতে পারে।

একজন লোকের মধ্যে ফিক্বহী বিষয়ে বিশেষজ্ঞত্ব, দ্বীনী আইন-কানুন ও বিধি-বিধান চিহ্নিত ও প্রমাণিত করণের যোগ্যতা এবং দ্বীনের মৌলিক ভিত্তি সমূহের সাথে পরিচিতির মাত্রা কতখানি তা যথাযথভাবে বুঝতে পারা কোনো সহজ কাজ নয়। এ কারণেই এ বিষয়ে সচেতন ও বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তির শরণাপন্ন না হয়ে পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ শাসককে চিনতে পারা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমরা যদি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ্ তাআলা, হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও মাছূম ইমামগণের (আঃ) পক্ষ থেকে মনোনীত ফকিহ শাসককে চেনার জন্যে সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে এমন বিশেষজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হওয়া যারা জনগণের হাতকে একজন ন্যায়বান, মোত্তাকী ও সুপরিচালক ফকিহের হাতে তুলে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন এবং যাদের ব্যাপারে জনগণ নিশ্চিন্ত হতে পারেন যে, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতের অনুসরণ করলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া সম্ভবপর হবে।

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: