bayyinaat

Published time: 05 ,March ,2017      20:50:11
প্রবন্ধ
ইসলামী বিশ্বকোষে ‘আকাশ হচ্ছে একটি বাহ্য গম্বুজ যা পৃথিবীবাসী সব জায়গা থেকে নিজেদের মাথার ওপরে প্রত্যক্ষ করে থাকে’– এ কথা বলার পর প্রখ্যাত অভিধান প্রণেতা ইবনে মানযুর থেকে বর্ণিত হয়েছে আরবী ভাষায় ‘আসমান’ শব্দের সমার্থক হচ্ছে সামা (سماء) শব্দ অর্থাৎ যা কিছু কোন কিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে...
সংবাদ: 13

‘আকাশ’ শব্দের অর্থ

সুমূ (سمو) ধাতুমূল থেকে সামা (سماء) শব্দের উৎপত্তি। আর যে কোন জিনিস বা বস্তুর আকাশ বলতে উক্ত বিষয় বা বস্তুর ঊর্ধ্বলোককে বোঝানো হয়। এমনকি কতিপয় অভিধান রচয়িতার মতে প্রতিটি উচ্চতাই হচ্ছে এর নি¤œর ক্ষেত্রে আকাশ এবং যে কোন নি¤œর অংশই হচ্ছে এর উচ্চ অংশের জন্য জমিন স্বরূপ। ইসলামী বিশ্বকোষে ‘আকাশ হচ্ছে একটি বাহ্য গম্বুজ যা পৃথিবীবাসী সব জায়গা থেকে নিজেদের মাথার ওপরে প্রত্যক্ষ করে থাকে’Ñ এ কথা বলার পর প্রখ্যাত অভিধান প্রণেতা ইবনে মানযুর থেকে বর্ণিত হয়েছে আরবী ভাষায় ‘আসমান’ শব্দের সমার্থক হচ্ছে সামা (سماء) শব্দ অর্থাৎ যা কিছু কোন কিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে। যেমন ছাদ অথবা শামিয়ানাÑ সেটাই হচ্ছে সামা।

আল্লামা তাবারসী মাজমাউল বায়ানে বলেছেন : ‘প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, কোন কিছু তোমার ওপরে আছে অথবা আংশিকভাবে হলেও তোমার ওপর ছায়া ফেলে সেটাই হচ্ছে সামা। সুতরাং ঘরের সামা হচ্ছে ছাদ। মেঘ ও বৃষ্টিকেও সামা (আকাশ) বলা হয়।’

আধুনিক পদার্থ বিদ্যায় ‘আকাশ’ হচ্ছে অস্তিত্বহীন ও গম্বুজবৎ একটি প্রপঞ্চ যা গ্রহ-নক্ষত্র দৃষ্টিগোচর হওয়ার ক্ষেত্র বা পটভমি স্বরূপ।

সামা (سماء ) অর্থাৎ আকাশ শব্দটি পবিত্র কোরআনে একবচন (سماء) ও বহু বচন আকারে (سموات) ৩১০ বারেরও বেশি উল্লিখিত হয়েছে। তবে সবক্ষেত্রেই এ শব্দটি একই অর্থে এবং একই উপমা ও দৃষ্টান্তে ব্যবহার করা হয় নি। সার্বিকভাবে, পবিত্র কোরআনে আকাশ শব্দ পার্থিব ও অবস্তুগত (অজড়)Ñ এ দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর কতিপয় প্রয়োগক্ষেত্র হচ্ছে নি¤œরূপ :

১. উচ্চ ও ঊর্ধ্ব অর্থে : এ অর্থ ‘আকাশ’ (سماء) শব্দের আভিধানিক অর্থের সাথে পূর্ণ সংগতিস¤পন্ন। আর তা নি¤œাক্ত আয়াত থেকে প্রতিপন্ন হয় :

كلَمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَ فَرْعُهَا فىِ السَّمَاءِ

ঐ পবিত্র বরকতময় বৃক্ষের মত যার মূল মাটিতে দৃঢ় প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখাসমূহ আকাশে উন্মুক্ত ও প্রসারিত (হয়ে আছে) 

এ অর্থই সমসাময়িক কালের কতিপয় মুফাস্সির উল্লেখ করেছেন; তবে অন্যান্য তাত্তি¡ক আলেম নি¤œাক্ত এ অভিমত পোষণ করেন :

পবিত্র কোরআনে সামা শব্দটি ‘ঊর্ধ্ব, ওপর ও উঁচু দিক’ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি তবে রূপকভাবে এ অর্থেও (পবিত্র কোরআনে) ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ, ঊর্ধ্ব, উঁচু বা ওপর (سماء) এর বহুবচন হয় না এবং ওপর বা উঁচু একাধিকও (বহু) হতে পারে না। অথচ পবিত্র কোরআনে সামা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আস-সামাওয়াত (السموات) অর্থাৎ বহুবচন আকারে ব্যবহৃত হয়েছে।  সুতরাং সাত আসমান (السموات السبع) উঁচু, ঊর্ধ্ব দিক বা ওপর অর্থে হতে পারে না।

২. ভপৃষ্ঠ বা পৃথিবীর চারপাশের বায়ুমÐল অর্থাৎ যে স্থানে মেঘমালা ও বাতাস রয়েছে সেই স্থান

وَ نَزَّلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً مُّبَارَكاً

এবং আমরা আকাশ থেকে বরকতময় (কল্যাণময়) পানি (বৃষ্টি) অবতীর্ণ করেছি (ভপৃষ্ঠে) 

৩. গ্রহ ও নক্ষত্রসমূহের স্থান

تَبَارَكَ الَّذِى جَعَلَ فىِ السَّمَاءِ بُرُوجاً وَ جَعَلَ فِيهَا سِرَاجًا وَ قَمَرًا مُّنِيرً

ঐ সত্তাই হচ্ছেন সুমহান যিনি আকাশে সৃষ্টি করেছেন রাশিচক্র এবং তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র। 

৪. (মহান আল্লাহর) নৈকট্য ও সান্নিধ্য স্থল : যা হচ্ছে গোটা অস্তিত্বজগতের সমুদয় বিষয় পরিচালনা করার স্থান বা কেন্দ্র। কতিপয় মুফাস্্সির, যেমন আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ) কয়েকটি ক্ষেত্রে সামা শব্দটির এ অর্থ নির্দেশ করেছেন। যে সব আয়াত সামা শব্দের এ অর্থ নির্দেশ করে তন্মধ্যে রয়েছে এ আয়াতটি।

يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلىَ الْأَرْض

তিনিই (মহান আল্লাহ) আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বের যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করছেন। 

৫. শ্রেষ্ঠ ও প্রকৃত অস্তিত্বশীল সত্তা : কতিপয় তাত্তি¡ক আলেমের মতে যেমনভাবে আকাশ (সামা) শব্দটি পবিত্র কোরআনে পার্থিব (জগতের) আকাশ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন সাত আকাশ (السموات السبع), তেমনি উচ্চ পর্যায়ের অস্তিত্ব ও অস্তিত্বশীল সত্তা অর্থেও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর এই আকাশ (সামা) হচ্ছে জড় জগতের ঊর্ধ্বে অবস্থিত অজড় আকাশ ও জগৎ এবং এ পার্থিব ও জড় জগতের যাবতীয় অস্তিত্ব উক্ত উচ্চতর (ও শ্রেষ্ঠতর) পর্যায়ে থেকে (নি¤œ জগতে অর্থাৎ জড় পার্থিব জগতে) অবতীর্ণ হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

وَ إِن مِّن شىَ‏ْءٍ إِلَّا عِندَنَا خَزَائنُهُ وَ مَا نُنزَِّلُهُ إِلَّا بِقَدَرٍ مَّعْلُومٍ

প্রতিটি বস্তুর (উপায়-উপকরণের) ভাÐার আমাদের কাছেই বিদ্যমান এবং আমরা সুনির্দিষ্ট পরিমাণেই কেবল তা (এ পার্থিব জগতে) অবতীর্ণ করি। 

সুতরাং আভিধানিক অর্থে এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পবিত্র কোরআনের ভাষায়ও সামা (আকাশ) শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

সাত আকাশ

পবিত্র কোরআনে মোট আটবার সাত আকাশ (السموات السبع) বাক্যাংশটি বর্ণিত হয়েছে। এই আট স্থানে ব্যবহৃত ‘সাত আকাশ’ বাক্যাংশটি নিয়ে একটু গভীর ও সূ²ভাবে চিন্তা করলে ¯পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই সাত আকাশ একের পর এক আবৃত অবস্থায় বিদ্যমান, ঠিক যেমন পিঁয়াজের স্তর সমূহ একের পর এক বিন্যস্ত; কারণ, অধিকাংশ মুফাস্্সির (طباقا বা ত্বিবাক্বান) শব্দটি পরস্পরের ওপর অবস্থিত স্তরসমূহ বলে অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন। পবিত্র কোরআনের আয়াতসমূহ অনুসারে এ সকল স্তর আসলে গাঢ় (ঘনীভত) গ্যাস থেকে সৃষ্ট ও গঠিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

ثُمَّ اسْتَوَى إِلىَ السَّمَاءِ وَ هِىَ دُخَان

অতঃপর তিনি (মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করার পর) আকাশসমূহের দিকে (সৃষ্টি করার জন্য) মনোনিবেশ করেন; অথচ তখন সেগুলো (সপ্তাকাশ) ধোঁয়া ও বাষ্প আকারে বিরাজ করছিল।

অর্থাৎ মহান আল্লাহ আদি গ্যাস থেকে গ্রহ-নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেন। কারণ, (পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার আগে) ঐ সময় আকাশ (সামা) ধোঁয়া ও ঘনীভত (গাঢ়) গ্যাস ছিল এবং ধীরে ধীরে তা তরল বা পাতলা হয়ে সাত আকাশে পরিণত হয়। সার্বিকভাবে সাত আকাশ সংক্রান্ত দুটি সম্ভাবনা রয়েছে : 

ক. সাত আকাশ বলতে পৃথিবীর বায়ুমÐলের স্তরসমূহকেও নির্দেশ করা হয়ে থাকতে পারে। কারণ, পবিত্র কোরআনের কতিপয় আয়াত থেকে এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, আকাশসমূহ হচ্ছে সাতটি এবং সেগুলো স্তরে স্তরে বিন্যস্ত। মহান আল্লাহই সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোর মত সাত জমীনও (পৃথিবী) সৃষ্টি করেছেন।

তত্ত¡বিদগণ পৃথিবীর বায়ুমÐলের স্তরসমূহকে এগুলোর বৈশিষ্ট্য ও ক্রিয়াকলাপ অনুসারে সাত স্তরে বিভক্ত করেছেন :

১.     ট্রপোস্ফেয়ার : ট্রপো শব্দের অর্থ পরিবর্তনশীল এবং স্ফেয়ার শব্দের অর্থ হচ্ছে গোল, বৃত্ত ও অঞ্চল। বিষুব রেখার কাছে অর্থাৎ বিষুবীয় অঞ্চলে এর উচ্চতা ১৬ কি.মি. এবং মেরুতে এর উচ্চতা ১০ কি.মি। বায়ুমÐলের এ অংশেই মেঘমালা গঠিত হয় এবং পৃথিবীর আবহাওয়া সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকে।

২.     র্স্ট্যাটোস্ফেয়ার : এ স্তরটি ট্রপোস্ফেয়ারের ঊর্ধ্ব হতে শুরু হয়ে ভপৃষ্ঠ থেকে ৩২ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত প্রসারিত। এ অংশে সর্বদা প্রবল ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে।

৩.     ওজোনোস্ফেয়ার : এ স্তর দ্বিতীয় স্তরের কিছু অংশকেও ধারণ করেছে। এর উচ্চতা ২০ কি.মি. থেকে শুরু হয়ে ৫০ কি.মি. পযর্ন্ত বিস্তৃত। এই স্তরে এক ধরনের অক্সিজেন আছে যা ওজোন নামে অভিহিত। এই অংশ বায়ুমÐলের অন্যান্য অংশের তুলনায় অধিক উষ্ণ এবং এর উষ্ণতা প্রায় শূন্য ডিগ্রীর কাছাকাছি এর কারণ হচ্ছে এই যে, ওজোন সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করে (যার ফলে তা ভপৃষ্ঠে পৌঁছতে পারে না)

৪.     মেজোস্ফেয়ার : এ স্তর বা অংশে মহাশূন্য থেকে আগত নভোমÐলীয় জড়পদার্থ বা বস্তুকণাসমূহ তীব্র গতিবেগ থাকার কারণে বায়ুমÐলের সাথে ঘর্ষণের ফলে প্রচÐ উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে পুড়ে ভস্মীভত হয়ে যায় এবং এগুলোর ভস্ম ভপৃষ্ঠে পতিত হয়।

৫.     আয়োনোস্ফেয়ার : এ স্তরটি এমন এক অঞ্চল যা সত্যিই বিস্ময়কর ও রহস্যময়। বায়ু এ অংশে এতটা পাতলা হয়ে গেছে যে, এ কারণে তা প্রায় বায়ুশূন্যই বলা চলে। ৫০ কি.মি. উচ্চতা থেকে এ অংশের শুরু এবং ঊর্ধ্বে ৩০০ কি.মি. বা ৮০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে কোন জীব বা প্রাণী সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি, মহাজাগতিক রশ্মি এবং উল্কাপাত থেকে নিরাপদ ও জীবিত থাকতে সক্ষম নয়। তবে নভোযানসমূহে যে সব যন্ত্রপাতি আছে সেগুলো ব্যবহার করে মানুষ বা জীব বায়ুমÐলের এ অংশে নিরাপদ এবং বেঁচে থাকতেও পারবে।

৬.     থার্মোস্ফেয়ার : এ অংশে বায়ু-কণাসমূহ বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত হয়ে থাকে অর্থাৎ বৈদ্যুতিক চার্জ গ্রহণ করে।

৭.     এক্সোস্ফেয়ার : এ অংশ বা স্তরে বিদ্যমান কণাসমূহ নি¤œবর্তী স্তরসমূহে বিদ্যমান কণাসমূহের চেয়ে পরিমাণে অনেক কম। আর এ কারণেই এ সব কণা এই স্তরে যেমন দ্রæত গতিতে ছুটে বেড়াতে সক্ষম, তেমনি কিছু কিছু কণা এই স্তর থেকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি উপেক্ষা করে বায়ুমÐলের বাইরে চলে যেতেও সক্ষম।

খ. কতিপয় তাত্তি¡ক আলেমের মতে মহানবী (সা.) মেরাজের রাতে যে সাত আকাশ সফর করেছিলেন সেগুলো আসলে পৃথিবীর বায়ুমÐলের ৭ স্তর ছিল না; বরং এ ক্ষেত্রে সাত আকাশ বলতে আমাদের দৃষ্টির প্রথম আকাশ যা সমগ্র নক্ষত্রপুঞ্জ ও তারকাজগতকে শামিল করে তা ছাড়াও আরো এমন ছয় আকাশকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো সংক্রান্ত বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি তথ্য ও জ্ঞান আমাদের নেই। তাঁরা তাঁদের এ দাবী ও বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দেখান এ বলে : আমরা যদি সাত আকাশ এবং সাত সংখ্যাটি সংখ্যা হিসেবেই গণ্য করি তাহলে এর অর্থ হবে সাত আকাশ। সূরা সাফফাতের ৬ নং আয়াত :

إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةٍ الْكَوَاكِبِ

‘আমরা (পৃথিবীর) নিকটবর্তী আকাশ অর্থাৎ প্রথম আকাশকে গ্রহ ও নক্ষত্রসমূহ দিয়ে সৌন্দর্যমÐিত ও সুশোভিত করেছি।’

এবং সূরা ফুসসিলাতের ১২ নং আয়াত :

وَ زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَ حِفْظًا

‘আমরা নি¤œবর্তী আকাশকে (তারকা ও নক্ষত্ররাজির) প্রদীপসমূহ দিয়ে সুসজ্জিত ও সৌন্দর্যমÐিত করেছি’Ñ এ থেকে ¯পষ্ট হয় যে, আমরা যা দেখি এবং যা মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নাগালে রয়েছে তা সবকিছু প্রথম আকাশের সাথেই সংশ্লিষ্ট। আর প্রথম আকাশের এ সব গ্রহ-তারকার পরেও আরো ছয়টি জগৎ বা বিশ্ব আছে যা আমাদের জ্ঞানের নাগালের বাইরে। 

এ সব আয়াত থেকে ভালোভাবে বোঝা যায় যে, আমরা যা কিছু দেখি তা অর্থাৎ তারকারাজির জগৎ এসব কিছুই আসলে প্রথম আকাশেরই অংশবিশেষ। আর এ প্রথম আকাশের পরেই আরো ছয় আকাশ রয়েছে যেগুলোর খুঁটিনাটি বিষয় সংক্রান্ত বর্তমানে কোন সূ² তথ্যই আমাদের হাতে নেই। তাই উক্ত ছয় আকাশ আমাদের কাছে অজানা এবং অজ্ঞাত রয়ে গেছে।  তবে ভবিষ্যতে সেগুলো স¤পর্কে বিস্তারিত জানার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, মানুষের অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে তা তত বেশি সৃষ্টিজগতের নতুন নতুন আশ্চর্যজনক বিষয় ও রহস্য উদ্ঘাটন করছে। যা বর্ণনা করা হলো তদনুসারে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব এভাবে দেয়া যায় :

১.     মেরাজের রাতে যে আকাশে মহানবী (সা.) উড্ডয়ন করেছিলেন তা নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর বায়ুমÐলের স্তরসমূহ ছিল না। আপত্তি তখনই অবধারিত হয়ে যাবে যখন আমরা মহানবী (সা.)-এর মেরাজকে পৃথিবী বা ভপৃষ্ঠের বায়ুমÐলের স্তরসমূহে পরিক্রমণ বলে গণ্য করব। কারণ, মহানবী (সা.) বহু আকাশের অস্তিত্বের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন ও কথা বলেছেন এবং তাঁর কথার বাহ্য অর্থই হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমÐলের বাইরে অবস্থিত বা বিদ্যমান আকাশসমূহ। কতিপয় মুফাস্সির যেমন বিশ্বাস করেন তদনুসারে এ পৃথিবীর আকাশের পরে বা পশ্চাতে আরো ছয় আকাশের অস্তিত্ব রয়েছে। 

২.     সুউচ্চ আকাশসমূহ এবং সপ্তম আকাশে মহানবী (সা.)-এর উড্ডয়ন সৃষ্টিজগতের অন্যতম রহস্য এবং তাঁর অন্যতম মোজেযা। পবিত্র কোরআনে যে সাত আকাশের কথা বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে আমরা কেবল এ পৃথিবীর আকাশকেই দেখি। কিন্তু আমরা জানি না যে, এই আকাশ, পৃথিবী, সৌরজগৎ এবং ছায়াপথসমূহের পশ্চাতে কোন্্ কোন্্ গ্রহ, নক্ষত্র ও জীব বিদ্যমান। মানুষের জ্ঞান ও তথ্যের এ সীমাবদ্ধতা অন্যান্য আকাশ ও জগৎ যে বিদ্যমান নেইÑ এ কথার দলিল হতে পারে না।

৩.     বর্তমান যুগের মানুষ, সকল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতি ও অগ্রগতি সত্তে¡ও নিশ্চিত করে দাবী করতে সক্ষম নয় যে, এই সৌরতন্ত্রে বিদ্যমান গ্রহসমূহেরই সব বিষয় তারা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। তাই দৃশ্যমান এ আকাশ ব্যতীতও যে আরো আকাশের অস্তিত্ব আছে তা কিভাবে অস্বীকার করা যাবে?

ফলাফল

যা আলোচনা করা হলো তা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, মেরাজের ঘটনায় বর্ণিত আকাশ বলতে ভপৃষ্ঠের বায়ুমÐলের স্তরসমূহ এবং সূর্য ও পৃথিবীর অন্তর্বর্তী সীমাহীন মহাশূন্য বুঝানো হয় নি; বরং আকাশ বলতে আকাশের স্তরসমূহকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলোর মধ্য থেকে আমরা প্রথম আকাশ অর্থাৎ প্রথম বিশ্বের (দুনিয়ার) পদার্থ ও বিষয়াবলী স¤পর্কেই কেবল জ্ঞাত।

মানবজাতি অপরাগতার কারণে এখন পযর্ন্ত আরো ছয় আকাশের নাগাল পায় নি। এ দাবীর সপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত নব নব আবিষ্কার। যে সব বিষয় মানুষ তার চর্মচক্ষু অর্থাৎ জড় দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় সেগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করার অধিকারও তার নেই। কারণ, মানুষের জ্ঞান সীমিত এবং এই সীমিত ও অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞান দিয়ে সে অসীমকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে পারে না।

অধিক অধ্যয়নের জন্য নি¤œাক্ত গ্রন্থসমূহ দ্রষ্টব্য

১.     সাইয়্যেদ আলী আকবার কোরাইশী প্রণীত পবিত্র কোরআনের অভিধান, দারুল কুতুব আল-ইসলামিয়াহ, তেহরান, (১৩৭১ ফার্সী সাল) কর্তৃক প্রকাশিত।

২.     আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ তাকী মিসবাহ ইয়াযদী প্রণীত মাআরেফে কোরআন (১-৩), ইমাম খোমেইনী শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত, কোম, ১৩৮৪ ফার্সী সাল।

৩.     আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইন তাবাতাবাঈ প্রণীত আল-মীযান ফী তাফসীরিল কোরআন, ১৬ ও ১৯তম খÐ, দাফতারে তাবলীগাতে ইসলামী, কোম কর্তৃক প্রকাশিত (১৪১৭ হিজরি)