bayyinaat

Published time: 26 ,November ,2018      23:31:58
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে পরাগানের হাদিস (২)
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে পরাগানের হাদিস (২) লেখক: আবুল কাসেম এখন আমরা হাদিসটির সনদ এবং মাতন বা টেক্সট নিয়ে আলোচনা করব। ক. হাদিসটির সনদের পর্যালোচনা সনদের দৃষ্টিতে হাদিসটির বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। কারণ, হাদিসটির সনদে ইকরামা, আফফান, হাম্মাদ ইবনে সালমাহ, হিশাম ইবনে উরওয়াহ, সাম্মাক ইবনে র্হাব এবং আবদুল্লাহ ইবনে মূসা রয়েছেন এবং বিভিন্ন রিজালশাস্ত্রবিদের দৃষ্টিতে তাঁরা ত্রুটিপূর্ণ বিবেচিত হয়েছেন।
সংবাদ: 133
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে পরাগানের হাদিস (২)
লেখক: আবুল কাসেম
এখন আমরা হাদিসটির সনদ এবং মাতন বা টেক্সট নিয়ে আলোচনা করব।                  বুদ্ধিবৃত্তির মানদণ্ডে হাদিসটির পর্যালোচনা : وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ ٱلسَّمْعَ وَٱلْبَصَرَ وَٱلْفُؤَادَ كُلُّ أُولـٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً  ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার অনুসরণ কর না, কেননা, শ্রবণেন্দ্রিয়, দর্শনেন্দ্রিয় এবং হৃদয়- তাদের প্রত্যেকে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল: ৩৬)
ক. হাদিসটির সনদের পর্যালোচনা
সনদের দৃষ্টিতে হাদিসটির বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। কারণ, হাদিসটির সনদে ইকরামা, আফফান, হাম্মাদ ইবনে সালমাহ, হিশাম ইবনে উরওয়াহ, সাম্মাক ইবনে র্হাব এবং আবদুল্লাহ ইবনে মূসা রয়েছেন এবং বিভিন্ন রিজালশাস্ত্রবিদের দৃষ্টিতে তাঁরা ত্রুটিপূর্ণ বিবেচিত হয়েছেন। যেমন:
ইমাম নাসাঈ ইকরামাকে যাইফ, আকিলি তাঁকে ‘মুযতারিব’ (হিফ্যের ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে যার বর্ণিত হাদিসের সনদ ও মাত্নে অসঙ্গতি রয়েছে) হাদিস বর্ণনাকারী এবং আহমাদ ইবনে হাকিম তাঁকে ‘বর্ণনার ক্ষেত্রে শক্তিশালী নয়’ বলেছেন। (ইবনে হাজার আসকালানী, তাহযিবুত তাহযিব, ৪র্থ খ-, পৃ. ২১০)
আফফান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এ নামে দু’ব্যক্তি রয়েছে, তারা উভয়ই মাজহুল বা অজ্ঞাত (যাকে কেউ বিশ্বস্ত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন বলে জানা যায় নি)। (আসকালানী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৪) মিযযি সুলায়মান ইবনে র্হাব থেকে তার সম্পর্কে বলেছেন যে, সে তার কবরে এমন অবস্থায় প্রবেশ করেছে যে শো’বার ওপর মিথ্যা হাদিস আরোপ করার কারণে অনুশোচিত ছিল। (মিযযি, তাহযিবুল কামাল, ২০তম খ-, পৃ. ১৬৯ ও ১৭৩)
হিশাম ইবনে উরওয়াহও বেপরোয়াভাবে হাদিস বর্ণনা করার কারণে ইরাকি হাদিসবিদদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। যাহাবি তার সম্পর্কে বলেছেন: ‘সে ইরাকে প্রবেশ করার পর ব্যাপকহারে হাদিস বর্ণনা করার কারণে তারা তাকে অগ্রহণযোগ্য গণ্য করেছে।’ (যাহাবি, শামসুদ্দিন, তাযকিরাতুল হুফফায, ১ম খ-, পৃ. ১৪৪ ও সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৩০তম খ-, পৃ. ২৩৯)
হাম্মাদ ইবনে সালমাহ বৃদ্ধাবস্থায় হিফ্যের দুর্বলতার কারণে যাঈফ বলে গণ্য হয়েছে। ফলে তার থেকে বর্ণিত হাদিসের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক। বিশেষত সে বিশ্বস্ত রাবীদের বিপরীতে কোন হাদিস বর্ণনা করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। একারণে বুখারী তার থেকে হাদিস গ্রহণ করেন নি। (মিযযি, তাহযবিুল কামাল, ২০তম খ-, পৃ. ১৬৯ ও ১৭৩)
আহমাদ ইবনে হাম্বাল ও মাদিনীর দৃষ্টিতে এ হাদিসের অপর রাবি সাম্মাক ইবনে র্হাব ‘মুযতারিবুল হাদিস’ অর্থাৎ তার বর্ণিত হাদিসের মধ্যে সনদ ও মাতনগত অসঙ্গতি রয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ আম্মার মুসেলী তাকে ‘গালি’ বা অতিরঞ্জনকারী বলেছেন। (প্রাগুক্ত, ১২তম খ-, পৃ. ১১৯-১২০)
আবদুল্লাহ ইবনে মূসা সম্পর্কে আহমাদ ইবনে হাম্বাল বলেছেন: ‘সে সঠিক হাদিসের সাথে মিথ্যা ও জাল হাদিস মিশ্রিত করত।’ (মিযযি, তাহযবিুল কামাল, ১৯তম খ-, পৃ. ১৬৮-১৬৯)
সুতরাং এ হাদিসের রাবীদের অনেকেই রিজালশাস্ত্রবিদদের দৃষ্টিতে ‘যাঈফ’ বলে গণ্য যা একে অনির্ভরযোগ্য প্রমাণ করে। তাই এ হাদিসের বিচারে মহানবী (সা.)-এর নির্ভুলতার বিষয়ে মন্তব্য করা কখনই সঠিক নয়।
খ. হাদিসের মাতন বা টেক্সটের পর্যালোচনা
হাদিসটির একটি বড় ত্রুটি হলো তা অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা, বিভিন্ন হাদিসের বর্ণনামতে মহানবী (সা.) সকল অবস্থায়ই (ক্রোধ-সন্তুষ্টি, শোক-আনন্দ) সঠিক ও নির্ভুল কথা বলেন। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস থেকে বর্ণিত হয়েছে : "আমি রাসূল (সা.) থেকে যা-ই শুনতাম তা লিখে রাখতাম। কিন্তু কুরাইশরা আমাকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলল : ‘তুমি কি যা কিছু রাসূল (সা.) থেকে শোন তা-ই লিখে রাখ? অথচ তিনি একজন মানুষ যে (কখনও) ক্রোধ এবং (কখনও) সন্তুষ্টির সময় কথা বলে (যা তাঁর ওপর প্রভাব ফেলে)।’ এ কথা শুনে আমি লিখা থেকে বিরত হলাম এবং তাদের কথাটি রাসূলের নিকট বললাম। তিনি বললেন : ‘লিখ। আমার জীবন যাঁর হাতে নিবদ্ধ তাঁর কসম, এখান (নিজের মুখের প্রতি ইশারা করে) থেকে সত্য ব্যতীত কিছুই বের হয় না।” (সুনানে আবি দাউদ, ৩য় খ-, পৃ. ৩১৮, রাকাম ৩৬-৪৬; মুসনাদে আহমাদ, ২য় খ-, বাকিউ মুসনাদিল আনসার, হাদিসু সাইয়্যেদাহ আয়েশাহ, পৃ. ৩৯৫)
তাছাড়া বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে এ সম্পর্কে যে হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে তার মাতন বা মূলপাঠের মধ্যে লক্ষণীয় পার্থক্য দেখা যায়। যার কোনটিতে বলা হয়েছে ما اظن ذالک یغنی شیأ (আমি ধারণা করি না যে, এতে কোন লাভ আছে), আবার কোনটিতে বলা হয়েছে لو لم تفعلوا لصلح (তোমরা যদি তা না কর, তাই উপযুক্ত); কোনটিতে বলা হয়েছে لو لم تفعلوا کان خیرا অর্থাৎ যদি তোমরা না কর তবে তা উত্তম; এ কথাগুলোর একটিতে তিনি বলছেন, ‘আমার ধারণা এমন’। অন্য দুটিতে এমনভাবে কথা বলছেন যা থেকে বোঝা যায় পরাগায়নের কাজটি না করলে যে ভালো হবে এবং তা না করা যে উত্তম তিনি তা নিশ্চিত। তবে কি তিনি না জেনে একটি বিষয়ে নিশ্চিত সুরে কথা বলেছেন ও দাবি করছেন। তবে তো তিনি নাউজুবিল্লাহ মিথ্যা কথা বলেছেন।
হাদিসের শেষাংশের মধ্যেও মিল নেই। কোনটিতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন,إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ دِينِكُمْ فَخُذُوا بِهِ وَإِذَا أمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ مِنْ رَأْيِي فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ অর্থাৎ ‘আমি তো মানুষ, আমি তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কিছু বললে তা গ্রহণ কর। আর যদি আমার মতে কিছু বলি তাহলে আমি কেবল মানুষ’; কোনটিতে এর পরিবর্তে বলা হয়েছে, إِنَّمَا ظَنَنْتُ ظَنًّا فَلَا تُؤَاخِذُونِي بِالظَّنِّ অর্থাৎ ‘আমি তো শুধু ধারণা করেছি, আমার ধারণার কারণে আমার সমালোচনা করো না’; কোনটিতে এ অতিরিক্ত অংশ সংযোজিত হয়েছে যে, أنتم أعلم بأمر دنياكم অর্থাৎ ‘তোমরা তোমাদের দুনিয়ার ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি জান’। এগুলোর মধ্যে কিভাবে সমন্বয় করা হবে। বিশেষত إِنَّمَا ظَنَنْتُ ظَنًّا فَلَا تُؤَاخِذُونِي بِالظَّنِّ অর্থাৎ ‘আমি তো শুধু ধারণা করেছি, আমার ধারণার কারণে আমার সমালোচনা করো না’Ñ এ কথার মধ্যে মানুষের সামনে তাঁর অসহায়ত্ব ও ক্ষুদ্রতার বিষয়টি কতটা প্রকট তা লক্ষ্য করা যায়। এটা তাঁর নবুওয়াতের প্রতি একটি অবমাননা।
সুতরাং বর্ণিত হাদিসের পাঠ্য পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতের পরিপন্থীই শুধু নয়; বরং অন্য হাদিসসমূহ যাতে রাসূলকে নির্ভুল বলা হয়েছে সেগুলোর সাথেও সাংঘর্ষিক। তাছাড়া এগুলোর টেক্সট বা মাত্নের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। একটি ঘটনার বর্ণনায় এতটা পার্থক্য কখনই স্বাভাবিক নয়। তদুপরি কোন কোনটি থেকে তিনি নাউজুবিল্লাহ মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হন, যা তাঁর মহান মর্যাদার সুস্পষ্ট অবমাননা।
বুদ্ধিবৃত্তির মানদণ্ডে হাদিসটির পর্যালোচনা
হাদিসটি বিবেক-বুদ্ধিরও পরিপন্থী। কেননা, প্রথমত, যদি রাসূল পার্থিব কোন বিষয়ে ভুল করেন, তাহলে মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর থেকে কোরআন-বহির্ভূত অন্যান্য বিষয়েওএমনকি ঐশীভাবে বর্ণিত হলেও তিনি তাতে ভুল করতে পারেন বলে সন্দেহ দেখা দিবে। ফলে (পরিমাণের দিক থেকে) দ্বীনের জ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস অর্থাৎ সুন্নাত প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। কারণ,এ হাদিসের অর্থ হলো তাঁর বাণী ও কর্ম দু’ভাগে বিভক্ত : ব্যক্তিমত ও ধারণাভিত্তিক (ভুলের সম্ভাবনাযুক্ত) এবং ঐশী ও নির্ভুল। তাই রাসূলের সকল কথাকে যার অধিকাংশই তাঁর তথাকথিত ইজতিহাদপ্রসূত-সূক্ষ্মভাবে যাচাই করে এ দুয়ের পার্থক্য নির্ণয় করে তারপর গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে তাঁর যে সুন্নাতের কথাই আসবে প্রথম প্রশ্ন দেখা দেবে তিনি এটা ব্যক্তিমতে ও ধারণার ভিত্তিতে বলেছেন ও করেছেন, না কি ঐশী নির্দেশে। তাই প্রতিমুহূর্তে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে যে, তিনি কি সেটা নিজের পক্ষ থেকে বলছেন, না আল্লাহর পক্ষ থেকে? প্রতিটি ক্ষেত্রে এরূপ করা অসম্ভব। বিশেষত আকস্মিক কোন পরিস্থিতিতে যেমন যুদ্ধের মধ্যে তিনি ত্বরিত কোন নির্দেশ দিলে তাৎক্ষণিক তা বাস্তবায়িত হওয়া আবশ্যক। না হলে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে। আর তাঁর ওফাতের পর এটাÑনিজের পক্ষ থেকে বলছেন, না আল্লাহর পক্ষ থেকেÑনির্ণয় করা আরো অসম্ভব। পরিণতিতে তাঁর থেকে আসা কোন হাদিসের ওপরই নির্ভর করা যাবে না যতক্ষণ না সে হাদিসে এ অংশটি থাকবে যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তা বলছেন। যেহেতু তাঁর সুন্নাতের বড় অংশটিই তাঁর কর্ম ও আচরণÑযা অন্যরা তাঁকে করতে দেখে বর্ণনা করেছেন সেক্ষেত্রে আদৌ বলা সম্ভব না যে, কোনটি তিনি আল্লাহর নির্দেশে করেছেন এবং কোন্টি (উক্ত দাবি অনুযায়ী) নিজের ইজতিহাদি মতে। আর এটা সার্বিকভাবে তাঁর সুন্নাতের (বাণী, কর্ম, আচরণ) গ্রহণযোগ্যতা, প্রামাণ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে। সাইয়্যেদ জাফর মুরতাযা আমেলী এ বিষয়ে বলেন :
‘রাসূল (সা.) সার্বিকভাবে সকল ক্ষেত্রে নির্ভুল ও নিষ্পাপ। তাই আমরা ঐ ব্যক্তিদের কথাকে সঠিক বলে মনে করি না যাঁরা বলেন যে, তিনি কেবল দ্বীনি বিষয়ের প্রচারের ক্ষেত্রে নির্ভুল, কিন্তু জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র ও বিভাগে নির্ভুল নন। বরং আমরা মনে করি, তিনি দ্বীনের প্রচারের ক্ষেত্রে যেমন নির্ভুল, তেমনি জীবনের সকল দিকেও নির্ভুল। কারণ, তাঁর জীবনের সকল পদক্ষেপ ও কর্ম তাঁর রেসালাতের (মিশনের) অন্তর্ভুক্ত। তাই আমরা তাঁর ব্যক্তিত্বকে বিভাজিত ও খ-িত করে বলি না যে, তিনি এদিক থেকে নির্ভুল, কিন্তু অমুক দিকে নির্ভুল নন। আমরা বলি, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি, অন্তঃকরণ, ভাবাবেগ, অনুভূতি, অনুধাবন ক্ষমতাসহ জীবনের সকল চিন্তা, কর্ম ও আচরণগত দিক নির্ভুলতার সার্বিক নীতির অধীন।’ (খালফিয়াতু মাসা’তিয যাহরা, ২য় খ-, পৃ. ৩৫৩)
দ্বিতীয়ত, এ হাদিসটি মহানবী (সা.)-এর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের সাথেও সংগতিশীল নয়। কারণ, একজন সাধারণ সৎ ও বুদ্ধিমান মানুষও কখনও ধারণার বশবর্তী হয়ে যে বিষয়ে তার পারদর্শিতা নেই সে বিষয়ে অযাচিত মন্তব্য করে মানুষকে বিপদ ও ক্ষতির মুখে ফেলবে না। সেখানে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ যাঁর উন্নত নৈতিক চরিত্র ও আদর্শের নিরঙ্কুশ প্রশংসা করেছেন, তাঁর পক্ষে কিভাবে এরূপ কর্ম করা সম্ভব। বিশেষত যখন তাঁকে যে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত জ্ঞান রাখেন না, তার অনুসরণ করতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করে বলা হয়েছে:
وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ ٱلسَّمْعَ وَٱلْبَصَرَ وَٱلْفُؤَادَ كُلُّ أُولـٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولاً  ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার অনুসরণ কর না, কেননা, শ্রবণেন্দ্রিয়, দর্শনেন্দ্রিয় এবং হৃদয়- তাদের প্রত্যেকে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল: ৩৬)
সহীহ মুসলিমের বর্ণনাটি এ সমস্যাটিকে আরো প্রকট করে। কেননা, তিনি তাদের প্রশ্ন করেছিলেন কেন তারা এটা করে, তারা জবাবে বলেছিল: یلقحونه و یجعلون الذکر فی الانثی فتلقح ‘তারা সেটার পরাগায়ন করছে এবং পুরুষকে (গাছের রেনুকে) স্ত্রী গাছের ওপর ঝারছে যাতে নিষিক্ত হয়।’ তিনি এটা শোনার পরও তাদের কথার তোয়াক্কা না করে এ কাজে তাদেরকে নিষেধ করেন।
তৃতীয়ত, হাদিসটির বর্ণনা মতে অন্যরা রাসূলের থেকে পার্থিব বিষয়ে অধিকতর অবগত যার অর্থ হলো রাসূল (সা.) যদি এ বিষয়ে তথাকথিত ইজতিহাদের ভিত্তিতে কিছু বলেন তা নির্ভরযোগ্য নয়। তবে কেন বুখারী তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে ‘কিতাবুত তিব’ শিরোনামে তাঁর থেকে চিকিৎসা বিষয়ে শতাধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন? (সহীহ বুখারী, ১০ম খ-, পৃ. ১৩৪) যেহেতু চিকিৎসকরা এ বিষয়ে তাঁর থেকে বেশি জানেন সেহেতু এ হাদিসগুলোর সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য কি আমাদেরকে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে হবে না? এভাবে অন্যান্য পার্থিব (যেমন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক) বিষয়সমূহে তাঁর বাণীগুলোর প্রত্যেকটিকে ঐ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে ও তারা সঠিক বলে গ্রহণ করলে তবেই গ্রহণ করা ঠিক হবে, নতুবা নয়। এরূপ চিন্তার পরিণতিতে তাঁর বাণী ও কর্মের আর কোন মূল্য থাকবে না।
চতুর্থত, যদি পার্থিব বিষয়ে আল্লাহর রাসূলের ইজতিহাদই এমন মারাত্মক ভুলের শিকার হয় তবে সাহাবীদের ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তার অবস্থা আরো শোচনীয় হওয়াই স্বাভাবিক। তাহলে কেন কোনরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়া তাঁদের সব ইজতিহাদভিত্তিক রাজনৈতিক ও অন্যান্য পদক্ষেপ নির্দ্বিধায় সঠিক ও প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করা হয় (এমনকি যদিও তার সপক্ষে কোরআনের কোন দলিল না থাকে)? এটা কি বৈপরীত্য নয়।
ঐতিহাসিক মানদণ্ডে হাদিসটির অগ্রহণযোগ্যতা
এ হাদিসে এসেছে যে, মহানবী (সা.) খেজুর গাছের পরাগায়ন সম্পর্কে জানতেন না এবং এ কারণেই মানুষের মধ্যে প্রচলিত এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে নিষেধ করেন। ফলশ্রুতিতে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও অসন্তুষ্ট হয়। ফলে তিনি পার্থিব বিষয়ে তারা তাঁর থেকে অধিক অবগত এ বিষয়টি স্বীকারোক্তি করে তাদের কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু আরবের তৎকালীন ঐতিহাসিক বাস্তবতাÑযা থেকে রাসূলও ব্যতিক্রম ননÑএ দাবির সাথে সঙ্গতি রাখে না। কারণ, কিভাবে এটা মেনে নেয়া যায় যে, মহানবী (সা.) মদীনায় শিশুকাল থেকে হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ (৫৩ বছর বা অর্ধ শতাব্দীরও অধিক) সময় আরবদের মধ্যে বাস করেছেন এবং মক্কা, তায়েফসহ খেজুর বাগানে পূর্ণ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছেন। অসংখ্যবার কৃষকদের বাগানে তাদের কাছে গিয়ে কথা বলেছেন, তাদের ফলনের খোঁজ খবর নিয়েছেন, তাদের সাথে আহার করেছেন, দ্বীনের বাণী প্রচার করেছেন, খেজুর বাগানের ছায়ায় বিশ্রাম করেছেন। অথচ তিনি খেজুরের পরাগায়নের বিষয়টি জানতেন না এবং একবারও এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন নি, কিন্তু হঠাৎ করে মদীনায় গিয়ে প্রথমবারের মতো বিষয়টি লক্ষ্য করবেন। এটা কিভাবে সম্ভব, যে ব্যক্তি খেজুর গাছের নিচে বসে খেজুর খেয়ে ও খেজুর বাগানে বড় হয়েছে সে এর পরাগায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত থাকবে না? এটা বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী।
হাদিস জালকারণ ইসলামের ইতিহাসের এক ধ্বংসাত্মক চরম বাস্তবতা
দুঃখজনকভাবে ইসলামের ইতিহাসের এক ধ্বংসাত্মক চরম বাস্তবতা হল এর ইতিহাস ও হাদিস গ্রন্থগুলোতে জাল ও বানোয়াট বর্ণনা ও হাদিসের অনুপ্রবেশ। কোন কোন ক্ষেত্রে এগ্রন্থগুলোর সঙ্কলক ও রচয়িতারা শাসকগোষ্ঠীর ভয়ে অসংখ্য সহীহ হাদিস বর্ণনা করতে অথবা গোপন করতে বাধ্য হয়েছে। আবার অনেক সময় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও ছত্রচ্ছায়ায় ইতিহাস ও হাদিস গ্রন্থসমূহ রচিত হওয়ায় তাদের ফজিলত ও মর্যাদায় এবং তাদের প্রতিপক্ষের অবমাননায় জাল হাদিস রচিত হয়েছে। রাসূল (সা.) কে সাধারণ এক মানুষ হিসাবে ভুল-ত্রুটির সম্মুখীন প্রমাণ করার উদ্দেশে বনি উমাইয়া শাসক গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে অনেক জাল রচনা করা হয়।
ইমাম মুহাম্মদ আবদুহ বলেন: বনি উমায়ার শাসনামলে মানুষের ওপর সাধারণভাবে যে বিপদ নেমে এসেছিল তা হল ব্যাপক আকারে মিথ্যার প্রচলন। ফলে যদিও বর্ণনাকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যবাদীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। প্রসিদ্ধ সাহাবাদের অনেকেই তাদের থেকে শ্রুত হাদীস বিকৃত হওয়ার আশংকায় হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন এবং সীমিত কিছু বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছেই কেবল হাদীস বর্ণনা করতেন।  
উপসংহার
খেজুর গাছের পরাগায়ন সম্পর্কে রাসূলের অজ্ঞতা নির্দেশকারী হাদিসটি প্রত্যাখ্যাত। কারণ, কোরআনে তাঁর নির্ভুলতার প্রমাণবাহী যে সকল আয়াত রয়েছে তার পরিপন্থী এবং সনদের দিক থেকেও হাদিসটিতে প্রকট সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া এর বিষয়বস্তু হাদিস, বুদ্ধিবৃত্তি এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সমর্থনযোগ্য নয়। তাই এ হাদিসটি পার্থিব বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর জ্ঞানগত ভুলের সপক্ষে কোন প্রমাণ বলে গণ্য হতে পারে না।
গ্রন্থপঞ্জি
১.    ইবনে হাম্বাল, আহমাদ, মুসনাদ, বৈরুত, ১৪১২হি., দারু এহইয়াউত তুরাসিল আরাবি।
২.    কুলাইনী, মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকূব, আলকাফি, তেহরান, দারুল কিতাবিল ইসলামিয়াহ, ৩য় প্রকাশ।
৩.    নাভাভী, ইয়াহইয়া ইবনে শারাফ, আল মিনহাজ ফি শারহি সাহিহ মুসলিম, বৈরুত, দারুল কালাম, ১৪০৭ হি.।
৪.    নিশাবুরি, মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ, সহীহ মুসলিম, দারু এহইয়াউত তুরাসিল আরাবি, ১৪২০হি.।
৫.    ইবনে মাজাহ কাযভিনি, মুহাম্মাদ, সুনানু ইবনি মাজাহ, বৈরুত, দারুল কিতাবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪২৩ হি.।
৬.    মুরতাযা আলআমেলী, সাইয়্যেদ জাফর, খালফিয়াতু মাসা’তিয যাহরা, বৈরুত, ১৪২২ হি.।
৭.    তাবাতাবাঈ, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হুসাইন, আলমিযান ফি তাফসিরিল কুরআন।
৮.    মিযযি, জামালুদ্দিন ইউসূফ, তাহযবিুল কামাল ফি আসমায়ির রিজাল, গবেষণা বাশার আওয়াদ মা’রূফ, ১৪১৫ হি.।
৯.    জাফর সুবহানী, হি. ১৪১৯, ইলাহিয়াত আলা হুদাল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ ওয়াল আকল, কোম, মুয়াসসাসাহ ইমাম সাদিক (আ.)।
১০.    ইবনে হাজার আসকালানী, তাহযিবুত তাহযিব, প্রথম প্রকাশ, বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৪০৪ হি.।


মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: