আল-কোরআনে গাদীরের ঐতিহাসিক ঘোষণা (২)
অনুবাদ: কামরুল হাসান
সংযোজন ও সম্পাদনা: আবুল কাসেম
সারাংশ: তাবলীগের আয়াত ও দ্বীন পূর্ণতার আয়াতের শানে নুযুল এবং সার্বিক অর্থ থেকে হযরত আলী (আ.) এর বেলায়েতের বিষয়টি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়।
ট্যাগ: দ্বীন-পরিপূর্ণতার আয়াত, তাবলীগের আয়াত, হযরত আলী (আ.) এর বেলায়েত, ইমামতের ধারা
দ্বীন-পরিপূর্ণতার আয়াতের বিশ্লেষণঃ
ٱلْيَوْمَ يَئِسَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَٱخْشَوْنِۚ ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلْإِسْلَٰمَ دِينًا
"আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব, তাদেরকে ভয় করো না বরং আমার অবাধ্য হওয়া কে ভয় কর। আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত কে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” ১
শানে-নযুলঃ আহলে সুন্নাতের বিখ্যাত আলেমগণ যেমনঃ মোহাম্মাদ বিন জারির তাবারী (৩১০) তাঁর "বেলায়াত” পুস্তকে ও হাকেম নিশাবুরী (মৃত্যু ৪৫০) তাঁর "আলমুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন” গ্রন্থে এবং আবু নাইম ইস্পাহানী (মৃত্যু ৪৩০) তাঁর "মা নাযালা ফি আলীয়েন মিনাল কোরআন” গ্রন্থে ও খাতিব বাগদাদী (মৃত্যু ৪৬৩) তাঁর "তারিখে বাগদাদ” গ্রন্থে ও ইবনে আসাকির দামেশকী (মৃত্যু ৫৭১) তাঁর তারিখু মাদিনাতে দামেশক কেতাবে ও ইবনে কাছির দামেশকী (মৃত্যু ৭৭৪) তাঁর "তাফসিরুল কোরআনুল আজিম” কেতাবে ও জালাল উদ্দীন সুয়ুতি (মৃত্যু ৯১১) তাঁর "দুররুল মানসুর” কেতাবে, দ্বীন-পরিপূর্ণতার আয়াতের শানে-নযুল হিসাবে যে সব রেওয়ায়াত উল্লেখ করেছেন; সেখানে বিভিন্ন সূত্রে রাসুলের (সা.) সাহাবীদের থেকে, যেমন: আমিরুল মোমিনীন হয়রত আলী (আ.), ইবনে আব্বাস (রা.), আবু সাইদ খুদরী (রা.), জাবের বিন আব্দুল্লাহ আনসারী (রা.) ও যায়েদ বিন আরকাম (রা.) বিশ্বস্ত-সনদ সহকারে বিশদ-বর্ণনা করেছেন যে, আয়াতটি হযরত আলীর শানে অবতীর্ণ হয়েছে।২
এ সকল রেওয়ায়েতের একটি হলো আবু সাইদ খুদরীর (রা.) বর্ণনা, যেখানে তিনি বলেছেন- "আল্লাহর নির্দেশ আসার পর, রাসুল (সা.) জনগণের সম্মুক্ষে তাঁর অসিয়তে হযরত আলী (আ.) এর ইমামত সম্পর্কে ঘোষণা দান করেন। সেদিন জনগণ তখনও আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়েনি, এমতাবস্থায় দ্বীন পরিপূর্ণতার আয়াতটি নাযিল হলে, রাসুল (সা.) বলেন-
«مِن بَعدِی اَللَّهُ أَكْبَرُ عَلَى إِكْمَالِ اَلدِّينِ وَ إِتْمَامِ اَلنِّعْمَةِ وَ رِضَا اَلرَّبِّ بِرِسَالَتِي وَ اَلْوَلاَيَةِ لِعَلِيٍّ»
"আল্লাহু আকবার! সেই পরোয়ারদিগার, যিনি তাঁর নিজের পক্ষ থেকে দ্বীনকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং তাঁর নেয়ামত কে আমাদের জন্য পরিপূর্ণ করেছেন আর আমার রেসালাত ও নবুওয়াতের প্রতি এবং আমার পরে আলী (আ.) এর বেলায়াতের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।” ৩
দ্বীন-পরিপূর্ণতার আয়াতের অন্য শানে-নযুল ও তার জবাবঃ
আহলে সুন্নাতের বর্ণিত অন্য কিছু রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে যে, এই আয়াত দশম হিজরি সালের আরাফাতের দিন নাযিল হয়ে ছিল।৪
প্রথম জবাবঃ এসব রেওয়ায়াতের বেশির ভাগই যায়িফ এবং এগুলোর বিপরীতে গাদীরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিন এ আয়াতের অবতীর্ণের প্রমাণবাহী যে রেওয়ায়াতগুলো এসেছে সেগুলো কে আহলে সুন্নাতের আলেমরা সহীহ বলেছেন। উপরন্তু, ইমামী-ধারার আলেমদের নিকট এ রেওয়ায়াতগুলো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত।
দ্বিতীয় জবাবঃ এই দুই ধরনের রেওয়ায়াতগুলো কে সমন্বিত (একত্র করে সিদ্ধান্ত দান) করা যায় এভাবে যে, - যেমনটি আহলে সুন্নাতের কিছু খ্যাতনামা আলেম বলে থাকেন- এই আয়াতটি দুই বার নাযিল হয়ে ছিল।৫
অন্যান্য যে সকল সম্ভবনা কোন কোন লেখকের লেখায় দেখা যায় তাতেও এ সমস্যা রয়েছে যে, তাদের উল্লিখিত দাবির সাথে, সংশ্লিষ্ট আয়াতের বৈশিষ্ট্যগুলোর কোন মিল পাওয়া যায় না; এমন কি কিছু কিছু বিষয় এমনও পাওয়া যায় যার সাথে ঐ দিনের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই।৬ এরূপ হলে তা কিভাবে যুক্তি-সঙ্গত হতে পারে!? কারণ উক্ত (দ্বীনের পূর্ণতা সম্পর্কিত) আয়াতের আগে ও পরে বিভিন্ন খাদ্যের নিষিদ্ধতার বিষয় বর্ণিত হয়েছে যার সাথে দ্বীনের পূর্ণতা ও কাফেরদের নিরাশ হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। তবে কি বিষয়টা এমন যে, কাফেররা বেশকিছু খাদ্যের প্রতি অনুরক্ত ছিল আর আরাফার বা গাদিরের দিন যখন ঐ খাবারের নিষিদ্ধতার বিধি-বিধান ঘোষিত হয়েছে তখন তারা নিরাশ হয়ে গেছে!
আয়াতে ব্যবহৃত শব্দাবলীর নির্দেশনাঃ উক্ত আয়াতের শানে-নযুল হিসাবে যা কিছু বলা হয়েছে সে-গুলো ছাড়াও; আয়াতে ব্যবহৃত শব্দাবলী থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এ আয়াতের বর্ণিত বিষয় হলো- ইসলামি সমাজের পরিণত-রূপ ও স্থায়িত্বের কাঠামো বর্ণনা করা। এখন আমরা আয়াতে ব্যবহৃত শব্দাবলীর প্রতি লক্ষ্য করব-
ٱلْيَوْمَ يَئِسَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِن دِينِكُمْ উল্লেখিত আয়াতে ٱلْيَوْم শব্দটি দুইবার ব্যবহার করা হলেও, ঘটনা ক্রমে ইমামী-মাজহাব ও আহলে সুন্নাতের আলেমগণ, উভয়ের জন্য একটিই অর্থ গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ ٱلْيَوْم শব্দটি দুইবার আসলেও মূলত তা দ্বারা একটি দিনকেই ইশারা করা হয়েছে এবং উভয় ধারার কোন একজন মোফাসসেরও এ বিষয়ে একাধিক দিনের কথা বলননি।৭
অপর দিকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এটাই যে, এখানে ٱلْيَوْمَ শব্দটির চারটি দিক রয়েছে অর্থাৎ -
(১) এ-দিনে কাফেররা নিরাশ হয়েছিল
(২) দ্বীন-ইসলাম চুড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল
(৩) মানুষের প্রতি আল্লাহ তাঁর নিয়ামত পরিপূর্ণ করে ছিলেন
(৪) ইসলাম কে বিশ্ববাসির মুক্তির সনদ হিসাবে পরিচয় করে ছিলেন।
রাসুলের (সা.) ঐতিহাসিক জীবনে, এই-রূপ একটি দিন কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা সহজেই অনুমিত! সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায়- এটা কোন সাধারণ ও গতানুগতিক দিন ছিল না! এত সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে দিনটিতে সংঘটিত হয়েছে, সে-দিনটি যদি একটি সাধারণ দিন হয় তবে তাকে বিশেষ ভাবে উল্লেখের কোন মানে হয় না! এ কারণেই তো কিছু ইয়াহুদ ও নাসারা, এ-আয়াত নাযিল হওয়ার কথা শুনে বলে ছিল যদি এমন আয়াত আমাদের আসমানী গ্রন্থে আসতো, তাহলে ঐ দিন কে আমরা ঈদের দিন হিসাবে উৎযাপন করতাম।৮
যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি এইদিন সংঘটিত হয়েছিল, তা কি খাদ্য বিষয়ক শারীয়াতের হালাল-হারাম সম্পর্কিত কোন বিধান ছিল? এ কথা তো সুস্পষ্ট যে, অনুরূপ আহকামের বিষয় নাযিল হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয় কারণ পূর্বে সূরা বাকারার ১৭৩ নং আয়াত, সূরা আনআমের ১৪৫ নং আয়াত ও সূরা নাহলের ১১৬ নং আয়াতে সার্বিকভাবে তা বর্ণিত হয়েছে তাই যেমন এক দিক থেকে দীনের হেফাজত ও পূর্ণতার ক্ষেত্রে এরূপ গুরুত্বের দাবী রাখে না; তেমনি অন্য দিক থেকেও তা উপরে বর্ণিত চারটি বৈশিষ্ট্যের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়! এ আয়াত নাযিল হলে, কাফিররা যে আশাহত হয়ে পড়ে; তারই বা কি গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকতে পারে!? রাসুল (সা.) এর জীবনের স্পর্শকাতর শেষ দিনগুলিতে, যখন ইসলামী উম্মাহ রাসুলের অনুপস্থিতির কথা চিন্তা করে বিক্ষিপ্তাবস্থায় পতিত; অন্য দিকে তখন কাফিররা- রাসুলের মাধ্যমে সরাসরি ঐশী-প্রজ্ঞার নির্দেশনায় চলা অ-প্রতিরোধ্য দাওয়াতী-কর্মসূচির পরিসমাপ্তির অপেক্ষায় ও তার ফলে- ঐশী নেতৃত্বের শূন্যতায় সৃষ্ট ফাঁকা মাঠের সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিল। কারণ তারা মনে করতো যে, ইসলাম ব্যক্তি রাসূলের (সা.) ওপর প্রতিষ্ঠিত তাই তিনি না থাকলে ইসলামও থাকবে না। কারণ তারা জানতো যে, ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরই ন্যায় একজন সুযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্ব সর্বদা অপরিহার্য।
ফলে এটাই স্বাভাবিক যে, রাসুলের ওফাতের পরপরই এরূপ নেতৃত্বের পদ খালি হওয়ার ফলে সব কিছু পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে থাকবে এবং ইসলামের শক্তি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যখন রাসুল (সা.) আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ.) কে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় নিজের স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন তখন কাফিররা হত-উদ্যম হয়ে পড়ে এবং তাদের প্রত্যাশার ঢেউগুলো মিলিয়ে যেতে থাকে! কেননা, ইসলামের কর্ণধার হিসাবে হযরত আলী (আ.) ও তাঁর বংশের পবিত্র ইমামরা একের পর এক রাসূলের স্থলাভিষিক্ত হবেন। ফলে ইসলাম ইতিহাসের পরিক্রমায় নির্ভুল একদল রক্ষকের হাতে সমর্পিত হয়েছে। ফলে রাসুল (সা.) এর রেসালাতের সাথে তাঁর ধারাবাহিক স্থলাভিষিক্তের বিষয় অর্থাৎ মুসলমানদের সর্বযুগের নেতৃত্ব এবং ইমামতের ধারা সংযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে দ্বীন-ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে, আর এভাবে আল্লাহর দ্বীনের লক্ষ্য বাস্তবায়িত তথা ঐশী হেদায়াত অব্যাহত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। আল্লাহর এ সিদ্ধান্ত, ভবিষ্যতে মহানবির অবর্তমানে ইসলামের মধ্যে যে কোন ত্রুটি ও বিচ্যুতির অনুপ্রবেশের সম্ভাবনাকে দূর করে দেয়। এ কাজের মাধ্যমেই দ্বীনের লক্ষ্য অর্জিত ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি ঐশী নেয়ামত পূর্ণ হয় এবং ইসলাম আল্লাহর পছন্দনীয় ও মনোনীত দ্বীন হিসাবে ঘোষিত হয়।৯
উপরুন্তু আয়াতে ٱلَّذِينَ كَفَرُواবলতে কিয়ামত পর্যন্ত সকল কাফেরের নিরাশ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ একদিকে আয়াতটি সর্বজনীন হিসাবে বিশেষ কোন গোষ্ঠীর কাফেরকে নির্দেশ করছে না, অন্যদিকে তাতে দ্বীন কিয়ামত পর্যন্ত পূর্ণতা পেয়েছে বলা হয়েছে। সুতরাং ইসলাম কেবল সীমিত কিছুদিন কাফেরদের হাত থেকে নিরাপদ ও বিকৃতিমুক্ত থাকবে না বরং কিয়ামত পর্যন্ত এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী থাকবে। যে বৈশিষ্ট্যটি শুধু রাসূলের স্থলাভিষিক্ত এক ব্যক্তির মনোনয়নের মাধ্যমে সম্ভব নয়। তাই কিয়ামত পর্যন্ত রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ঐশী নেতৃত্বের উপস্থিতি থাকতে হবে। হাদিসে সাকালাইন১০ এবং বার নেতা, ইমাম ও খলিফা সম্পর্কিত হাদিস১১ আর এরূপ নেতৃত্ব অব্যাহত থাকার প্রমাণ বহন করছে। যাদের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন সকল প্রকার বিকৃতি থেকে মুক্ত থাকবে।
দ্বীন-পরিপূর্ণতার আয়াত সম্পর্কিত দলীলঃ- আহলে বায়েতের ইমামদের (আ.) বক্তব্যে দ্বীন-পরিপূর্ণতার আয়াতের দলীল পাওয়া যায়, উদাহরণ স্বরূপ সংক্ষেপে এ রকম একটা ঘটনার প্রতি ইশারা করছি-
"ইমাম রেযা (আ.) এর এক বক্তব্যে এসেছে- আল্লাহ-তায়ালা তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ-রূপ প্রদান না করা পর্যন্ত তাঁর নবিকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেননি। আল্লাহ কোরআন কে প্রত্যেক বিষয়ের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা সহ তাঁর রাসুলের উপর নাযিল করেন। প্রতিটা হালাল-হারাম-বিষয় এবং পুরস্কার ও শাস্তির পরিসীমাগুলোর সাথে মানুষের প্রয়োজনীয় সকল প্রকার হুকুম-আহকাম সার্বিকভাবে কোরআনে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে বলেছেন-
"আমরা (এ কোরআনে) কোন কিছু বাকি রাখিনি।”
রাসুল (সা.) এর জীবনের শেষ-দিনগুলোতে তাঁর সর্ব-শেষ-সফর ছিল বিদায়-হজ্জের সফর। এটার পরপরই গাদীরে-খুম নামক স্থানে, আল্লাহর নির্দেশে নিজের স্থলাভিষিক্ত কে পরিচয় করিয়ে দেন। এটাই আল্লাহর নাযিল করা সর্বশেষ ফরজ ছিল, যা তিনি মানুষের কাছে যথার্থ ভাবে পৌছে দেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসুলের (সা.) কাছে এভাবে ওহি পাঠান-
ٱلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلْإِسْلَٰمَ دِينًا
(আজ তোমাদের দিন কে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ........ মনোনীত করলাম)।
এ আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট মূলত: আলী (আ.) এর ইমামত প্রচার করার সাথে সম্পর্কিত। এর ফলে ফরজ-নির্দেশগুলি পরিপূর্ণতা পায় এবং এর পরে আর কোন ফরজ-নির্দেশ নাযিল হয়নি। রাসুলে আকরাম (সা.) দ্বীনের নির্দেশ ও সেগুলো বোঝার পদ্ধতিগুলো পরিষ্কার ভাবে তুলে না ধরে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেননি। উম্মতের প্রয়োজনীয় কোন বিষয় ব্যাখ্যা না করে ছেড়ে দেননি। অত:পর সত্যে-পথ ও তার হাকিকত নিদ্রিষ্ট করেন এবং হযরত আলী (আ.) কে সত্য-পথের প্রতীক হিসাবে, ইমাম নিযুক্ত করেন। এখন যদি কেউ মনে করে যে, আল্লাহ তাঁর দ্বীন কে পূর্ণতা দেননি তাহলে মূলত: সে আল্লাহর কিতাব কে গ্রহন করেনি।১২
প্রশ্নঃ- কেন কোরআনে গাদীরের সাথে সম্পর্কিত আয়াতগুলো পরস্পর থেকে দূরে রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ভিন্ন বিষয়ক অনেক আয়াত অবস্থান করছে? যেমন গাদীর সম্পর্কিত সুরা মায়েদার প্রথম আয়াত হলো- তিন নং আয়াত ও দ্বিতীয় আয়াত হলো উক্ত সুরার-৬৭ নং আয়াত।
জবাবঃ প্রথমত, বলা যায় যে, যদি কোরআনের আয়াতগুলো নাযিলের তারিখ অনুসারে সাজানো হতো, তবে এ অভিযোগ গ্রহণ যোগ্য হতো।
দ্বিতীয়ত, হালাল ও হারাম খাদ্য-সামগ্রীর মধ্যে গাদীরের আয়াত থাকার অপর একটা কারণ এটা হতে পারে যে, অত্যন্ত সতর্কতামূলক কৌশলের অংশ হিসাবে এরূপ করা হয়েছে। যাতে করে সঙ্কলনের সময় মুনাফিকরা এ আয়াতগুলোকে বাদ দিয়ে কোরআনে কোনরূপ পরিবর্তন, বিকৃতি ও হ্রাস ঘটাতে না পারে এবং এভাবে ঐশী গ্রন্থকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। তারা যে এরূপ করতে পারত তার প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, রাসুলের জীবনের সর্ব শেষ সময়ের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়- যেখানে দেখা যায় যে, রাসুল (সা.) এর জীবদ্দশায় তাঁর উপস্থিতিতেই অসিয়াতনামা লেখার ক্ষেত্রে কিছু লোক বাধার সৃষ্টি করে। এমনকি স্বয়ং রাসুল (সা.) কে প্রলাপ বকার অপবাদ দেওয়া হয়।১৩ কিছু লোক রাসুল (সা.) এর পরবর্তী খলিফা বা স্থলাভিষিক্ত নিয়োগের বিষয়ে বিশেষ ভাবে স্পর্শকাতর ছিল। এরূপ অবস্থায় ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে, খেলাফাত সম্পর্কিত সনদ বা দলীল গুলোর সংরক্ষণের জন্য, ঐ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। আর এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে মিশে থাকার কারণে কোরআনের ঐ আয়াতগুলোর ভিন্নরূপ ব্যাখ্যার সুযোগ থাকায় কোরঅনকে বিরোধীদের সংবেদনশীলতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। ১৪
1. আল-মায়িদাহ : ৩।
1. উসদুল গাবাতি ফী মা’রিফাতিস সাহাবা, মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ শাইবানী, বৈরুত, দারুল ইহইয়াউত তুরাছিল আরাবী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৮। আল জা’মেয়ু লী আহকামিল কুরআন, বৈরুত, দারুল আহইয়ায়িল তুরাছিল আরাবী, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ২৭৮, ১৪০৫ হি.। শাওয়াহেদুত তানযিল, খণ্ড-১, পৃ-২০১; ইহকাকুল হাক, খণ্ড-৩, পৃ-৩১০; আয়াতে গাদীর, পৃ-২৪২ ও ২৬৮; ইমামতে আমিরুল মুমিনীন, পৃ-২০৭; বারাহিন ও নুসুসে ইমামাত পৃ-৩১৪; তাশঈদুল-মুরাজায়াত, খণ্ড-২, পৃ-২৬৯। মুসনাদে ইবনে হাম্বাল, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৮২, হা. ১৯৩২১। খাসায়েছু আমিরিল মুমেনীন, পৃ. ১৭৩, হাদিস ৯৩; আল বিদায়া ওয়াল নিহায়া, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২১১ এবং ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৭ ও ৩৫০।
2. নাহজুল হাক ও কাশফুসসিদক, পৃ-১৯২; দালায়েল আস-সাদুক, খণ্ড-৫, পৃ-১৬৪; আল-গাদীর, খণ্ড-১, পৃ-৩৫; আয়াতে বেলায়াত দার কোরআন, পৃ-৪১।
3. দুররুল মানসুর, খণ্ড-২, পৃ-২৫৮
4. গাদীর, খণ্ড-১, পৃ-২৩০; মায়া এমকানিল জামই বে-নুযুলিল আয়াত মাররাতাইন কামা এহতেমালাহু সিবতু ইবনুল জাওযি- অর্থাৎ সিবতে ইবনে জাওযি এ দু বর্ণনার মধ্যে এভাবে সমন্বয়ের কথা বলেছেন যে, তা দু’বার নাযিল হয়েছে।
5. বারাহিন ও নুসুসে ইমামত, পৃ-৩১৯
6. বাররেসি-এ তাতবিকি তাফসিরে আয়াত ও বেলায়াত দ্বার দিদগহে ফারিকাইন, পৃ-১৮০।
7. তাফসিরে তাবারি, খণ্ড-৬, পৃ-৫৪; আল-মানার, খণ্ড-৬, পৃ-১৫৫।
8. তাফসিরুল মিজান, খণ্ড-৫, পৃ-১৬৮
9. মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে ‘হুজ্জাতুল বিদা’র ‘গাদীরীয়া খুতবা’য় রাসূল (সা.) থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন : ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি, যার প্রথমটি হলো আল্লাহর কিতাব... এবং আমার আহলে বাইত।’ অতঃপর ‘আমি আমার আহলে বাইতের কথা তোমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি’ বাক্যটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন।Ñ মুসলিম, সহীহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৮৭, হাদিস ২৪০৮ এবং ইবনে হাম্বাল, আহমাদ, মুসনাদ, ৩২ তম খণ্ড, পৃ. ১০, হাদিস ১৯২৮; ইবনে শাহরে অশুব, মানাকিব, পৃ. ২২৬, হাদিস ২৮৪; আহমাদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী হাদিসটি ‘হুজ্জাতুল বিদার পর গাদীরের খুতবা’য় এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী বস্তু রেখে গিয়েছি, তার একটি অপরটি হতে বড়, আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধর ও আহলে বাইত; এ দু’টির প্রতি কীরূপ আচরণ করবে তার প্রতি লক্ষ্য রেখ, যেহেতু এ দু’টি হাউযে কাওসারে আমার সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’ (নাসায়ী, আহমাদ, খাসায়িস, পৃ. ১১২, হাদিস ৭৮; ইবনে মাগাযিলী, মানাকিব, পৃ. ২৩০, হাদিস ২৮৩; আবু ইয়ালী, মুসনাদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯৭, হাদিস ১০২১; ইবনে আবি আসিম, কিতাবুস সুন্নাহ, পৃ. ৬৩০, হাদিস ১৫৫৫; ইবনে হাম্বাল, মুসনাদ, ১৭ তম খণ্ড, পৃ. ২১১, হাদিস ১১১৩১; তাবরানী, সুলাইমান, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৬৯, হাদিস ৯৮০ ও ৪৯৮১। তিরমিযী, মুহাম্মাদ, সুনানে তিরমিযী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৬২২, হাদিস নং ৩৭৮৬ ও পৃ. ৬৬৩, হাদিস নং ৩৭৮৮; হাকিম নিশাবুরী, মুসতাদরাক, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৯ ও ১১০; ইবনে আসিম, কিতাবুস সুন্নাহ, পৃ. ৬২৯, হাদিস ১৫৫৩ এবং পৃ. ৬৩০, হাদিস ১৫৫৮; ইবনে হাম্বাল, মুসনাদ, ১৭তম খণ্ড, পৃ. ১৬১, হাদিস ১১১০৪; তাবরানী, সুলাইমান, আল মু’জামুল কাবির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৫-৬৭, হাদিস ২৬৭৮, ২৬৮০ ও ২৬৮১ এবং ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৬৬, হাদিস ৪৯৭১; ইবনে হামিদ, মুসনাদ, পৃ. ১০৭-১০৮, হাদিস ২৪০; ‘কিতাবুল্লাহ ওয়া আহলুল বাইত ফি হাদিসিস সাকালাইন মিন মাসাদিরি আহলিস সুন্নাহ’ গ্রন্থে এই হাদিসটির সূত্রসমূহ মোটামুটিভাবে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
10. إن هذا الأمر لا ينقضي حتى يمضي فيهم اثنا عشر خليفة - তাদের মধ্যে বারজন খলিফা না আসা পর্যন্ত এ বিষয়টি (ইসলাম ও নবুও্রয়াতের মিশন) শেষ হবে না। (ফাতহুল বারি ফি শারহি সাহিহ বুখারী, ইবনে হাজার আসকালানী, খন্ড-১৩, পৃ: ২১২, গবেষণা: মোহিব উদ্দিন আল-খাতিব, প্রকাশক: দারুল মারেফা - বৈরুত। সুয়ুতি, জালাল উদ্দীন আবুল ফাজল আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (মৃত: ৯১১ হিঃ), তারিখুল খালিফা, খন্ড-১, পৃ ১০, গবেষণা: মুহাম্মাদ মহিউদ্দিন আবদুল হামিদ, প্রকাশক: মাতবায়াতুস-সাআদাহ- মিশর, সংস্করণ: প্রথম ১৩৭১ হিঃ; নিশাবূরী আল-কুশাইরী, আবুল হোসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (মৃত: ২৬১ হিঃ), সহীহ মুসলিম, খন্ড- ৩, পৃ: - ১৪৫২, হাদিস নং- ১৮২১, পৃ: - ১৪৫৩, হাদিস নং- ১৮২২, গবেষণা: মোহাম্মদ ফুয়াদ আবদেল বাকী, প্রকাশক: দারে এহিয়াইউত-তুরাছিল-আরাবি, বৈরুত। সাজেস্তানি আল-আজদি, আবু-দাউদ সুলায়মান ইবনুল আসআস (মৃত: ২৭৫ হিঃ), সুনান আবু দাউদ, খন্ড-৪, পৃ ১০৬, হাদিস নং ৪২৮০, গবেষণা: মুহাম্মাদ মহিউদ্দিন আবদুল হামিদ, প্রকাশক: দারুল ফিকর্। এ হাদিসটি মহান আলেমে দ্বীন, হাম্বলী মাযহাবের প্রধান, আহমদ ইবনে হাম্বল তাঁর "মুসনাদ” বইয়ের ৮৬ পৃষ্ঠা থেকে ১০৭ পৃষ্ঠায় এবং হাকেম নিশাবুরী তাঁর মুসতাদারাকে ৩ নং খন্ডে, ৭১৫-৭১৬ নং পৃষ্ঠায়, হাদিস নং ৬৫৮৬ ও ৬৫৮৯ সহ অন্যান্যরাও নিয়ে এসেছেন। সনদের দিক থেকে এই হাদিসের মান হাসান। আসকালানি আশ-শাফেয়ী, আহমেদ বিন আলী বিন হাজর আবুল ফাজল (মৃত: ৮৫২ হিঃ),খন্ড- ৯, পৃ- ৫৭৭, মাতালেব আল-আলিয়াহ বেযাওয়ায়িদিল-মাসানিদ আস-সামানিয়া, গবেষণা: ড: সাদ বিন নাসের বিন আব্দুল আজিজ আশ-শাতরি, প্রকাশক: দারুল আসমাহ দারুল গাইয়াস, প্রথমত সংস্করণ, সৌদি আরব– ১৪১৯ হিঃ।
11. মাআনি আল আখবার, পৃ-৯৬; আল কফি, খণ্ড-১, পৃ-১৯৯।
12. সাহিহ বুখারী, খণ্ড-১, পৃ-৩৭, ও খণ্ড-৫, পৃ-১৩৮, ও খণ্ড-৮,পৃ-১৬১; মুসনাদে আহমদ, খণ্ড-১, পৃ-৩২৫।
13. তাফসিরে নেমুনে, খণ্ড-৪, পৃ-২৭০।
14. মিনহাজুল কারামাত ফি মারেফাতিল ইমামাহ, পৃ-১১৮, আয়াতুল-গাদীর, পৃ-২৮৬, পায়ামে কোরআন, খণ্ড-৯, পৃ-১৮৬।