bayyinaat

Published time: 29 ,November ,2018      00:22:15
পবিত্র কোরআনে ইবাদতের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য
পবিত্র কোরআনে ইবাদতের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য অনুবাদ: আবুল কাসেম সারাংশ: ইবাদত হল কোন সত্তার সামনে বিশ্বজগতের অথবা তার একাংশের প্রভু ও নিরঙ্কুশ পরিচালক অথবা স্বাধীনভাবে ঐশ্বরিক কর্মের অনুরূপ কর্মসম্পাদনে সক্ষম হওয়ার বিশ্বাস নিয়ে বিনয়ী ও নত হওয়া।
সংবাদ: 137

পবিত্র কোরআনে ইবাদতের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য

মূল: জাফর সুবহানী

অনুবাদ: আবুল কাসেম                            وَٱخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحْمَةِ

সারাংশ: ইবাদত হল কোন সত্তার সামনে বিশ্বজগতের অথবা তার একাংশের প্রভু ও নিরঙ্কুশ পরিচালক অথবা স্বাধীনভাবে ঐশ্বরিক কর্মের অনুরূপ কর্মসম্পাদনে সক্ষম হওয়ার বিশ্বাস নিয়ে বিনয়ী ও নত হওয়া।

ট্যাগ: ইবাদত, শিরক, রুবুবিয়্যাত, আল্লাহ, ইলাহ, বিনয়াবনত হওয়া

এ প্রবন্ধে আমরা ইবাদতের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করব যার সঠিক অর্থ না জানলে ইবাগতগত তাওহীদের ক্ষেত্রে মহাবিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। আমরা এ বিষয়টি এখানে স্পষ্ট করব যে, ইবাদত অর্থ কখনই সম্মান ও বিনয় প্রদর্শন, স্বীয় ক্ষুদ্রতা প্রকাশ ও নম্রতার সাথে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন নয়। এমনকি কারো সামনে চরম হীনতার সাথে মাথা নত করাও ইবাদত বলে গণ্য হয় না। এ বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আমরা দুটি শিরোনামে আলোচনার অবতারণা করছি। এক. চূড়ান্ত বিনয় ও হীনতার প্রকাশ ইবাদত নয়; দুই. কোন কিছু ইবাদত হওয়ার আবশ্যক শর্ত হল উপাস্যের ব্যাপারে স্বাধীন ও সর্বভৌম রব ও ইলাহ হওয়ার বিশ্বাস পোষণ।

১. ইবাদত অর্থ হীনতা ও বিনয় প্রকাশ নয় : যদিও বিভিন্ন গ্রন্থে ‘ইবাদত’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ক্ষুদ্রতা ও বিনয় প্রকাশ। কিন্তু এ অর্থটি ‘ইবাদত’ শব্দের সার্বিক ও আবশ্যিক অর্থ- প্রকৃত অর্থ নয়। আমরা সবাই জানি, পিতা-মাতার সামনে ক্ষুদ্রতা প্রকাশের দ্বারা বিনয় দেখানো, শিক্ষকের সামনে ছাত্রদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য মাথা নত করা কখনই তাঁদের ইবাদত বলে গণ্য হয় না। পবিত্র কোরআন থেকেও এ দাবির সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, وَٱخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحْمَةِ এবং তাঁদের (পিতা-মাতা) সম্মুখে বিনয়-নম্র হয়ে নিজের বাহু নত করে দেবে। (সূরা বনি ইসরাঈল : ২৪)

কেউ বলতে পারে, শুধু বিনয় প্রকাশ ইবাদত বলে গণ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং ব্যক্তিকে কোন পূর্ণতার বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মনে করে তার সামনে চরম মাত্রায় বিনয় প্রদর্শন হল ইবাদত। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, ফেরেশতাগণ যখন হযরত আদম (আ.)-এর মহান মর্যাদার বিষয়টি বুঝতে পেরে তাঁর সামনে সিজদাবনত হলেন তদুপরি তা কেন ইবাদত বলে গণ্য হল না? বরং এটা তাঁর প্রতি সম্মানের প্রতীক বলে বিবেচিত হয়েছে।

পবিত্র কোরআন বর্ণনা করছে :

এবং যখন আমরা ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা কর। তখন ইবলিস ব্যতীত তাদের সকলেই সিজদা করল... (সূরা বাকারাহ : ৩৪)

যা কিছুই আকাশম-লী ও পৃথিবীতে আছে, আল্লাহর সামনে সিজদাবনত রয়েছে। (সূরা রাদ : ১৫)

সুতরাং বাহ্যিকভাবে হযরত আদমের সামনে ফেরেশতাদের সিজদার ধরনের সাথে আল্লাহর সামনে তাদের সিজদার ধরনের কোন পার্থক্য নেই। কারণ, আল্লাহ ও আদম (আ.) উভয়ের সামনে সিজদার উল্লেখ করতে কোরআন لام অক্ষর (لآدما فسجدوا) ও (لله يسجد) ব্যবহার করেছে। প্রথম ক্ষেত্রে ফেরেশতারা সিজদার মাধ্যমে চূড়ান্ত বিনয় প্রদর্শন করলেও তা ইবাদত বলে গণ্য হয়নি, অথচ দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আল্লাহর জন্য সিজদা ইবাদত বলে বিবেচিত হয়েছে। হযরত ইউসূফের জন্য তাঁর পিতা-মাতা ও ভ্রাতাদের সিজদার ক্ষেত্রেও এ কথাটি প্রযোজ্য।

কোরআন বর্ণনা করছে :

এবং সকলেই তার (ইউসূফের) সম্মুখে সিজদাবনত হল। সে (ইউসূফ) বলল, ‘হে আমার পিতা! এটা আমার পূর্বে দেখা স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমার প্রতিপালক যা বাস্তবায়িত করেছেন। (সূরা ইউসূফ : ১০০)

এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হল যে, ইবাদতকে ক্ষুদ্রতা, হীনতা, বিনয় ও সম্মান প্রদর্শন অর্থে গ্রহণ করা যায় না। আর যেহেতু এ অর্থগুলো থেকে ইবাদতের অর্থ ভিন্ন তাই ইবাদতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে অন্য আয়াতসমূহের সাহায্য নিতে হবে।

একটি অদ্ভুত উত্তর

কেউ কেউ পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত কর্মগুলো ইবাদত না হওয়ার যুক্তি হিসেবে এমন কিছু বলেছেন যা শুনে সকলেই বিস্মিত হবে। তাঁদের কথা হল, যেহেতু আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা হযরত আদমকে সিজদা করেছেন সেহেতু তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না। তাঁদের ভাষায়, আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য সিজদা করলে তা আল্লাহকে সিজদা করারই শামিল হবে। আমাদের প্রশ্ন হল, কিভাবে সম্ভব যে, আল্লাহ যদি এক সৃষ্টিকে (মাখলুক) অপর সৃষ্টির সামনে সিজদা করতে বলেন তবে তা ঐ (সিজদাকৃত) সৃষ্টির ইবাদত বলে গণ্য হবে না, অথচ এমনিতেই কোন সৃষ্টি অপর সৃষ্টিকে সিজদা করলে তা ইবাদত হয়ে যাবে? অর্থাৎ ফেরেশতাগণ কর্তৃক আদম (আ.)-কে সিজদা করার কাজটি যদি প্রকৃতই ইবাদত বা ইবাদতের একটি রূপ হয়ে থাকে তবে আল্লাহর নির্দেশের কারণে তা কিভাবে ইবাদতের দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ হওয়া থেকে মুক্ত হবে? যেহেতু এ সংজ্ঞা অনুযায়ী ইবাদত হল কাউকে সিজদা করা, সেহেতু যে কাউকে-আল্লাহ হোক বা মানুষ-সিজদা করা মাত্রই তা ইবাদত হয়ে যাবে। এ অবস্থায় এ সংজ্ঞাকে আল্লাহর নির্দেশের শর্তাধীন করার কোন সুযোগ নেই। কারণ, স্বয়ং এ কাজটি ইবাদত, তা আল্লাহ বলুন বা না বলুন। তা না হলে এ ইবাদতকে বৈধ ও অবৈধ এ দু’ভাগে করতে হবে। আল্লাহর নির্দেশে হলে তা বৈধ ইবাদত, আর না হলে অবৈধ ইবাদত। সেক্ষেত্রে বলতে হবে, ফেরেশতা ও মানুষরা অন্য কোন মানুষ বা সৃষ্টিকে সিজদা করার মধ্যে সত্তাগতভাবে ভালো বা মন্দ বলে কিছু নেই। কেবল আল্লাহর নির্দেশই তাকে ভালো ও মন্দত্ব দান করে। কিন্তু মূল বিষয় হল ইবাদত করাকে যদি সিজদা করা অর্থ করা হয় তবে এ ব্যাখ্যা ধোপে টিকে না। কারণ, তাহলে বিষয়টি এমন হয় যে, ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে হযরত আদমের উপাসনা করেছেন। অথচ আল্লাহ কখনই নিজ ভিন্ন কাউকে ইবাদতের নির্দেশ দিতে পারেন না। কারণ, তা ঐ উপাসিত সত্তাকে আল্লাহর সাথে অংশী করার শামিল যা মহাঅন্যায় ও বড় ধরনের পাপের কাজ। নিশ্চয় আল্লাহ কখনও মন্দ ও অন্যায় কর্মের নির্দেশ দান করেন না।

(হে রাসূল!) আপনি বলুন, নিশ্চয় আল্লাহ মন্দকর্মের নির্দেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহর ওপর এমন কিছু আরোপ কর যা তোমরা জান না। (সূরা আ’রাফ : ২৮)

কেউ কেউ বলে থাকেন, ফেরেশতারা আল্লাহকেই সিজদা করেছেন, কিন্তু হযরত আদমকে এক্ষেত্রে কিবলা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের এ উত্তর সঠিক নয় এজন্য যে, কোরআনে আল্লাহর জন্য ও হযরত আদমের জন্য সিজদা- উভয় ক্ষেত্রে তাঁদের উদ্দেশ্যে তা সংঘটিত হওয়া বুঝাতে لام অক্ষর (اسجدوا لادم...،اسجدوا للّه) ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়াও হযরত আদমের সিজদা সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায়, মহান আল্লাহ আদম (আ.)-এর জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁকে মর্যাদা দানের উদ্দেশ্যে ফেরেশতাদের নির্দেশ দেন সিজদা করার মাধ্যমে তাঁর প্রতি বিনয় ও সম্মান প্রদর্শন করতে। অন্যদিকে এ উত্তরটি হযরত ইউসূফকে যে হযরত ইয়াকুব ও তাঁর সন্তানরা সিজদা করেছেন সেক্ষেত্রে আদৌ সঠিক নয়। কারণ, পবিত্র কোরআন তাদের সিজদাকে হযরত ইউসূফের স্বপ্নের বাস্তব রূপ লাভ বলে উল্লেখ করেছে। কোরআন তাঁর স্বপ্নকে এভাবে বর্ণনা করেছে :

নিশ্চয় আমি এগারটি তারা ও চন্দ্র ও সূর্যকে আমার জন্য (প্রতি) সিজদা করতে দেখেছি। (সূরা ইউসূফ : ৪)

সুতরাং হযরত ইউসূফের পিতা-মাতারা প্রকৃতই তাঁকে সিজদা করেছেন। তাই এ ধরনের ব্যাখ্যা যাঁরা দেন তাঁরা বাস্তবে এখন পর্যন্ত ইবাদতের সঠিক সংজ্ঞা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা এখানে ইবাদতের সঠিক সংজ্ঞা দেয়ার মাধ্যমে এ বিতর্কের অবসান ঘটাতে চাই।

২. ইলাহ ও রব হওয়ার প্রতি বিশ্বাস রাখা ইবাদতের মূল শর্ত ও রোকন

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ইবাদতের একটি দিক ও রুকন হল কোন সত্তার সামনে কথা বা আচরণের দ্বারা বিনয় ও ক্ষুদ্রতা প্রকাশ। কিন্তু এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে রুকনটি ইবাদতের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে তা হল এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্বাসের দিকটি যার প্রকাশস্থল হল মানুষের হৃদয়। কোন সত্তার সামনে বিনয় প্রকাশ তখনই ইবাদত বলে গণ্য হবে যখন ব্যক্তি ঐ সত্তার প্রতি বিশেষ বিশ্বাস পোষণ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মনে যে সত্তার প্রতি ক্ষুদ্রতা ও বিনয় প্রকাশ করছে তার বিষয়ে ঐ বিশেষ বিশ্বাস না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না, এমনকি যদি তা সিজদার পর্যায়েও পৌঁছায়।  এখন দেখতে হবে, ঐ বিশেষ বিশ্বাসটি কী- যা পোষণ করলে তা ইবাদতের রূপ ধারণ করবে। অন্য ভাষায় বলা যায়, ইবাদত গঠনকারী আবশ্যক উপাদানটি কী?

এ প্রশ্নের উত্তর দানের জন্য আমাদেরকে প্রথমে আল্লাহ ও মূর্তির সামনে বিনয় ও ক্ষুদ্রতা প্রকাশের সময় একত্ববাদী ও মুশরিকদের বিশ্বাসের মধ্যকার পার্থক্য যাচাই করতে হবে। কারণ, এ দুয়ের একটি হল প্রকৃত ইবাদত ও অপরটি মিথ্যা ও বাতিল ইবাদত। সবাই এ বিষয়টি জানে ও স্বীকার করে যে, একজন মুমিন যখন আল্লাহর ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় তখন তার মনে এ বিশ্বাস নিয়েই দাঁড়ায় যে, তিনি বিশ্বজগতের প্রভু ও প্রতিপালক এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সর্বময় সত্তা (ইলাহ) হিসেবে তাঁর হাতেই তার জীবন, মৃত্যু ও সার্বিক বিষয় ন্যস্ত। অর্থাৎ আল্লাহকে সে সৃষ্টিজগতের রব ও ইলাহ মনে করে তাঁর প্রতি তার সত্তাগতভাবে মুখাপেক্ষিতাকে স্মরণ করে তাঁর সামনে নিজেকে আত্মসমর্পিত রূপে পেশ করে। এ ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট হয় যে, শুধু ক্ষুদ্রতা ও বিনয় প্রকাশই ইবাদত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং যখন বিনয় প্রকাশকারী যার সামনে বিনয় প্রকাশ করছে ও তার প্রশংসা করছে তাকে ইলাহ, রব, বিশ্বজগতের ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী এমন এক স্বাধীন পরিচালক- যার হাতে তার ভাগ্য নিহিত রয়েছে বলে বিশ্বাস করবে, তখনই তার ইবাদত ও উপাসনা করল। যদি কোন একত্ববাদী আল্লাহর প্রতি এমন বিশ্বাস না রেখে তাঁর সামনে নত হয় (যেমনটি মুনাফিকরা করে থাকে) তবে তার এ প্রশংসামূলক কথা ও আচরণ (বিনয় দেখানো) ইবাদত হবে না।

মুশরিকদের আচরণ (মূর্তির সামনে সিজদা ও মাথা নত করা) এজন্য ইবাদত বলে গণ্য হত যে, তারা মূর্তিকে সাধারণ একটি মাটির পুতুল মনে করত না; বরং বিশ্বাস করত বিশ্বজগতে এ মূর্তিদের স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতা রয়েছে। অন্য ভাবে বলা যায়, তাদের প্রত্যেককে স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র খোদা মনে করত যাদের হাতে বিশ্বের একেক অংশের পরিচালনার ভার ন্যস্ত রয়েছে এবং তারা স্বাধীনভাবে মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতা রাখে। তারা মূর্তিদের ব্যাপারে অন্তত এ বিশ্বাস রাখত যে, তারাই বৃষ্টিবর্ষণকারী, যুদ্ধে জয়দানকারী, অভাব পূরণকারী (সম্পদ দানকারী) এবং সম্মান দানকারী অর্থাৎ এক্ষেত্রে তারা আল্লাহর স্থলাভিষিক্ত। তাদের দৃষ্টিতে তারা হল বিশ্বের একেক অংশের স্বাধীন প্রভু এবং আল্লাহ হলেন তাদের সকলের প্রভু ও রব। তাই যেহেতু এ সকল প্রতিমার পরিচালনাধীন অংশকে আল্লাহ তাদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন সেহেতু তাঁর পাশাপাশি তারাও ইলাহ হিসেবে উপাস্য বলে বিবেচিত। কোন কোন মূর্তিপূজক দল যদিও সরাসরি এ কথা বলে না যে, প্রত্যেক মূর্তি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রভু, কিন্তু এ বিশ্বাস পোষণ করত যে, তাদের ভাগ্য এ প্রতিমাদের হাতে ন্যস্ত। তাই তারা বলত : ‘তাদের পাপমোচন ও পার্থিব প্রয়োজন পূরণের জন্য এরা আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ স্বাধীন সুপারিশকারী।’ অর্থাৎ তারা মূর্তিদের সুপারিশ পাওয়ার জন্য তাদের কল্পিত উপাস্যদের আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদন লাভের প্রয়োজন আছে বলে মনে করত না। এসকল ক্ষেত্রে তারা মূর্তিদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ ও একই রূপ সম্মানের অধিকারপ্রাপ্ত হওয়ার বিশ্বাস রাখত। কোরআন তাদের এরূপ বিশ্বাসকে বিভিন্ন আয়াতে তুলে ধরেছে। উদাহরণস্বরূপ :

‘মানুষের মধ্যে অনেকে আল্লাহর স্থলে (পরিবর্তে) অন্যদেরকে তাঁর সদৃশ (ও সমকক্ষ) গ্রহণ করে থাকে (এবং) তাদের প্রতি তেমন প্রীতি রাখে যেমন প্রীতি আল্লাহর প্রতি রাখা প্রয়োজন।’ (সূরা বাকারা : ১৬৫)

কিয়ামতের দিন মুশরিকরা স্বীকারোক্তি করবে :

আল্লাহর শপথ, নিশ্চয় আমরা স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় ছিলাম, যখন আমরা তোমাদের (উপাস্যদের) জগৎসমূহের প্রতিপালকের সমান (সমকক্ষ) জ্ঞান করেছিলাম।’ (সূরা শুয়ারা : ৯৭-৯৮)

আয়াতে যে বলা হয়েছে, তারা এ কথা স্বীকার করবে যে, তারা মূর্তিদেরকে আল্লাহর সমান বলে বিশ্বাস করত ও এজন্য তারা অনুশোচিত হবে, তার কারণ কী? নিঃসন্দেহে এর কারণ হল অদ্বিতীয়, অনুপম ও অসদৃশ আল্লাহর পাশাপাশি তাঁর অনুরূপ সত্তায় বিশ্বাসের মাধ্যমে তারা আল্লাহর একত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তারা যে ইবাদত ও উপাসনার ক্ষেত্রে মূর্তিদেরকে আল্লাহর মত গুরুত্ব দিয়েছে তার কারণ হল তারা সেগুলোকে (বিশেষ ক্ষেত্রে) আল্লাহর ন্যায় রব, ইলাহ ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করত। এরূপ বিশ্বাসের কারণেই তারা মূর্তিপূজার দিকে ধাবিত হয়েছিল। যদি তারা সেগুলোকে আল্লাহর সমকক্ষ বলে বিশ্বাস না করত তবে কখনই সেগুলোর সামনে এভাবে নত হত না। তবে কাউকে ইলাহ ও রব মানার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আবশ্যক নয় যে, সব দিক থেকে মূর্তি ও অন্যান্য উপাস্যকে আল্লাহর সমকক্ষ জ্ঞান করতে হবে; বরং কয়েকটি, এমনকি একটি ক্ষেত্রে সমরূপ হওয়ার বিশ্বাস র্শিকে পর্যবসিত হবে। যেমন আরবদের প্রায় সকলেই মূর্তিদের নয়, বরং আল্লাহকেই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা বলে মানত। কিন্তু তাদের একটি বড় অংশ সম্পূর্ণ বিশ্বের বা তার একাংশের পরিচালনাভার সম্পূর্ণরূপে তাদের কল্পিত উপাস্যদের হাতে ন্যস্ত বলে বিশ্বাস করত। মক্কায় মূর্তিপূজার প্রচলন রুবুবিয়্যাত বা প্রভুত্ব ও প্রতিপালনের বিষয়ে শিরক দিয়ে শুরু হয়েছিল। মুশরিকদের অপর অংশ রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে এরূপ বিশ্বাস না রাখলেও মূর্তিদেরকে তাদের সৌভাগ্য ও বিপর্যয়ের (দুর্ভাগ্য) নিয়ন্ত্রক বলে ধারণা করত।

অন্যভাবে বলা যায়, নবুওয়াতের প্রথম যুগের মুশরিকরা তাদের উপাস্যদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সাহায্যকারী, সম্মান ও অসম্মানের সর্বময় কর্তা ও নিয়ামক হওয়ার বিশ্বাস রাখত।

‘এবং তাদেরকে বলা হবে : আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে তোমরা উপাসনা করতে তারা কোথায়? তারা কি তোমাদের সাহায্য করবে, না তারা (নিজেরা)-ই (জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য) সাহায্য কামনা করবে? (সূরা শুয়ারা : ৯২-৯৩)

অন্যত্র বলা হয়েছে :

‘তাদের জন্য আমরা ভিন্ন কোন ইলাহ (সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্বাধীন সত্তা) আছে কি যে তাদের শাস্তি থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে? তারা নিজেদেরকেও সাহায্য করতে সক্ষম নয় এবং (শাস্তি থেকে রক্ষার জন্য) আমাদের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা পাবে না। (সূরা আম্বিয়া : ৪৩)

এ আয়াতগুলো ও বিশেষত ঐ আয়াতগুলো যেগুলোতে সাহায্য এবং কল্যাণ ও অকল্যাণ দানের ক্ষেত্রে মূর্তিদের অক্ষমতার কথা বর্ণিত হয়েছে সেগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মুশরিকরা তাদের উপাস্যদের বিষয়ে বিশেষ বিশ্বাস রাখত অর্থাৎ শুধু বিশ্বজগতের প্রতিপালক ও প্রভু আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বৈশিষ্ট্যগুলোকে তাদের উপাস্যদের ওপর আরোপ করত। যদিও তাদের অনেকে এ পার্থক্যে বিশ্বাসী ছিল যে, মূর্তিদের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলো আল্লাহর থেকে সীমিত। তবে মুশরিকদের সকলেই তাদের জীবনধারণের উপকরণসমূহ এ উপাস্যদের এখতিয়ারাধীন হিসেবে তাদের ভাগ্য সেগুলোর হাতেই ন্যস্ত বলে বিশ্বাস রাখত।

এ আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ইবাদতের প্রকৃত সংজ্ঞা হল : কোন সত্তার বিষয়ে নিরঙ্কুশ ভাগ্যনির্ধারক এবং ইলাহ ও রব হওয়ার বিশ্বাস নিয়ে তার প্রশংসা করা ও তার সামনে নত হওয়া। তাই এরূপ বিশ্বাস নিয়ে কেউ কারো সিজদা না করে কেবল তা সামনে মাথা নোয়ালেও তা ইবাদত বলে পরিগণিত হবে। এর বিপরীতে কেউ কারো সামনে এরূপ বিশ্বাস ছাড়া সিজদায় পতিত হলেও তা ইবাদত বলে গণ্য হবে না। আমরা এ সংজ্ঞাটিকে আরবি ভাষায় বর্ণনা করলে হবে :

العبادة خضوع امام من نعتبره الها او ربّا او مصدرا للاعمال الالهیّة

ইবাদত হল কোন সত্তার সামনে রব অথবা ইলাহ বা ঐশ্বরিক কর্মের (চূড়ান্ত) উৎস হওয়ার বিশ্বাস নিয়ে নত হওয়া।’

অতএব, ইবাদত হল কোন সত্তার সামনে বিশ্বজগতের অথবা তার একাংশের প্রভু ও নিরঙ্কুশ পরিচালক অথবা স্বাধীনভাবে ঐশ্বরিক কর্মের অনুরূপ কর্মসম্পাদনে সক্ষম হওয়ার বিশ্বাস নিয়ে বিনয়ী ও নত হওয়া।

উপরিউক্ত সংজ্ঞায় ঐশ্বরিক কর্ম বলতে কী বোঝায় তা স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। ঐশ্বরিক কর্ম হল এমন এক কর্ম যাতে কোন ব্যক্তি বা সত্তা নিজেই তার কর্মের একক উৎস এবং এক্ষেত্রে সে কারো থেকে সাহায্য গ্রহণ করে না। যদি কখনও সে কোন উপকরণ ও মাধ্যম ব্যবহার করে সে ক্ষেত্রেও স্বাধীন। সুতরাং স্বাধীন কর্মের অধিকারী অর্থ উপায় ও উপকরণকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করা নয়; বরং স্বাধীনতার অর্থ কর্তা তার কর্মের (কর্ম সম্পাদনের) ক্ষেত্রে অন্য কোন সত্তার ওপর নির্ভরশীল নয়; এখন সে কর্ম সম্পাদনের জন্য কোন উপকরণ ব্যবহার করুন বা না করুন, যেমন- লাঠিকে সাপে পরিণত করা। তাই তিনি তাঁরই সৃষ্ট প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করে কোন কর্ম সম্পাদন করতে পারেন। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য উদাহরণ হিসেবে আমরা পবিত্র কোরআনে যে আল্লাহ জন্ম ও মৃত্যুদানের বিষয় দুটি নিজের ওপর আরোপ করেছেন তার উল্লেখ করতে পারি। কারণ, তিনি জীবন দানের বিষয়টিকে নিজের প্রতি ছাড়াও হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর আরোপ করেছেন এবং মৃত্যুদানের বিষয়টিকেও ফেরেশতাদের ওপরও আরোপ করেছেন। কোরআন বলছে :

তিনিই (আল্লাহ) জীবিত করেন ও মৃত্যুদান করেন। (সূরা মুমিন : ৬৮)

অন্যত্র ঈসা (আ.)-এর ভাষায় বলেছেন :

আর আমি আল্লাহর অনুমতিক্রমে মৃতদেরকে জীবিত করি। (সূরা আলে ইমরান : ৪৯)

ফেরেশতাদের ব্যাপারে বলেছেন :

‘যখন তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় আসে তখন আমাদের প্রেরিতরা (ফেরেশতারা) তার মৃত্যুদান করে... (সূরা আনআম : ৬১)

সঠিক জ্ঞানশূন্য লোকেরা এ দুই ধরনের আয়াতের মধ্যে বৈপরীত্য দেখতে পায়। এক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হল তারা ধারণা করে যে, জীবন ও মৃত্যুদানের বিষয়টি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সাথে সম্পৃক্ত করা হলে তা আর আল্লাহর কর্ম থাকবে না; কারণ, অন্যের ওপর তা আরোপ করার অর্থ হল সে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং আল্লাহর সাহায্য ছাড়াই স্বয়ং কাজটি করেছে। অন্যভাবে বললে, তারা মনে করে যে, জীবন ও মৃত্যুদান শর্তহীনভাবে আল্লাহর কাজ। কারণ, তিনি নিঃশর্তভাবে কারো সাহায্য ছাড়াই তা সম্পাদন করে থাকেন; কিন্তু যখন তিনি তা সম্পাদনের জন্য তাঁরই সৃষ্ট কোন মাধ্যম ব্যবহার করবেন তখন আর তা তাঁর কর্ম বলে বিবেচিত হবে না; বরং যে মাধ্যমের সাহায্যে তিনি তা সম্পাদন করেছেন তার কাজ বলে গণ্য হবে। এজন্যই তাদের ধারণায় যখন কোন কর্তা এ কর্মগুলো আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিক্রমে সম্পাদন করবে তখন আর তা আল্লাহর কর্ম হবে না; বরং সে যেন নিজের কাজই সম্পাদন করল অর্থাৎ যদিও তাতে আল্লাহই মূল কারণ, তবুও তা তাঁর স্বাধীন কর্ম নয়।

এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে আমাদের দেখতে হবে, আল্লাহর কর্মসমূহের ব্যাপারে মুশরিকদের কীরূপ ধারণা ছিল। তারা বিশ্বজগতের একাংশের পরিচালনা, যেমন বৃষ্টিদান, মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য নির্ধারণ, সুপারিশ গ্রহণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের উপাস্যদের স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করত অর্থাৎ আল্লাহ তাদের উপাস্যদের হাতে বিশেষ কর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব এমনভাবে অর্পণ করেছেন যে, ঐ ক্ষেত্রে তাঁর আর হস্তক্ষেপের কোন ক্ষমতা নেই, ফলে তারা আল্লাহর সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কর্মসম্পাদন করতে পারে।  একারণেই শাফায়াত সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের অধিকাংশ আয়াতে শাফায়াত মহান আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে হওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে :

‘তাঁর অনুমতি ছাড়া কে তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? (সূরা বাকারা : ২৫৫)

একইরূপ পূর্বোল্লিখিত সূরা শুয়ারার ৯২-৯৩ নং আয়াতে (من دون اللّه هل ینصرونکم) ‘আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কেউ কি তোমাদের সাহায্য করতে পারে’ এবং সূরা আম্বিয়ার ৪৩ নং আয়াতে (من دوننا لا یستطیعون‏ نصر انفسهم) ‘আমাদের সাহায্য ব্যতীত কেউ তাদের সাহায্যের ক্ষমতা রাখে না’ বলা হয়েছে। সুতরাং ইবাদত হওয়ার আবশ্যক শর্ত হল যার সামনে বিনয়ী ও নত হবে তার ব্যাপারে আল্লাহর থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের জীবনের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়সমূহ তার (ঐ উপাস্যের) ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়াতে বিশ্বাস রাখা। কেবল এরূপ বিশ্বাসই কোন কর্মকে ইবাদতে পরিণত করে এবং এর অনুপস্থিতিতে তা ইবাদত বলে পরিগণিত হবে না।

আশা করি এ মানদণ্ডের ভিত্তিতে পাঠকরা কোন কর্ম ইবাদত হওয়া ও না হওয়ার বিষয়টি যাচাই করতে পারবেন।

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: