bayyinaat

Published time: 29 ,November ,2018      22:26:47
আরবের সামাজিক অবস্থা ও ইসলামের সংস্কার
আরবের সামাজিক অবস্থা ও ইসলামের সংস্কার মূল: আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী সংগ্রহে: আবুল কাসেম সারাংশ: পাশ্চাত্যের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মেসিয়োর ন্যাঁ তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “এই বিস্ময়কর সুমহান ঘটনা (ইসলাম) --যা আরব জাতিকে দিগ্বিজয়ী এবং উন্নত চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার উদ্ভাবকের পোশাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে তা --ঘটার সময়কাল পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের কোন অঞ্চলই না বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ বলে গণ্য হতো, আর না বিজ্ঞান বা ধর্মের দৃষ্টিতে সেখানে সভ্যতার কোন নিদর্শন বিদ্যমান ছিল।”
সংবাদ: 138

আরবের সামাজিক অবস্থা ও ইসলামের সংস্কার  

   টমাস কারলাইল বলেছেন,

মূল: আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী

সংগ্রহে: আবুল কাসেম

সারাংশ: পাশ্চাত্যের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মেসিয়োর ন্যাঁ তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, "এই বিস্ময়কর সুমহান ঘটনা (ইসলাম) --যা আরব জাতিকে দিগ্বিজয়ী এবং উন্নত চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার উদ্ভাবকের পোশাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে তা --ঘটার সময়কাল পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের কোন অঞ্চলই না বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ বলে গণ্য হতো, আর না বিজ্ঞান বা ধর্মের দৃষ্টিতে সেখানে সভ্যতার কোন নিদর্শন বিদ্যমান ছিল।”

ট্যাগ: জাহেলী যুগ, আরবদের সামাজিক অবস্থা, ইসলামের সংস্কার কর্মকাণ্ড, ইসলামী সভ্যতা

মূল প্রবন্ধ: মানব জাতি সামাজিক জীবনের দিকে প্রথম যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা ছিল গোত্রীয় জীবন। গোত্র ছিল কতগুলো পরিবার ও আত্মীয়ের সমষ্টি যারা গোত্রের শেখ বা নেতার নেতৃত্বাধীনে জীবনযাপন করত। আর এভাবে গোত্রের মাধ্যমে সমাজের আদিমতম চিত্র বা রূপ অস্তিত্ব লাভ করে। সে সময়ের আরব জাতির জীবনযাত্রা এমনই ছিল। প্রতিটি গোত্র অন্য গোত্রের সাথে যোগ দিয়ে ছোট একটি সমাজ গঠন করত। গোত্রের সকল সদস্য গোত্রপতির আদেশ মেনে চলত। যে বিষয়টি তাদের পরস্পর সম্পর্কিত করে রেখেছিল তা ছিল তাদের গোত্রীয় বন্ধন ও আত্মীয়তা। এ সব গোত্র সব দিক থেকেই পরস্পর পৃথক ছিল; তাদের আচার-প্রথাও পৃথক ছিল। কারণ অন্য সকল গোত্র মূলত একে অপর থেকে আলাদা ও অপরিচিত বলে গণ্য হতো। প্রতিটি গোত্র অন্য গোত্রের কোন অধিকার ও সম্মান আছে- এ কথার স্বীকৃতি দিত না। প্রতিটি গোত্র অন্য গোত্রের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন, সদস্যদের হত্যা এবং নারীদের অপহরণ করা তাদের আইনসংগত ন্যায্য অধিকার বলে গণ্য করত। তবে কোন গোত্রের সাথে যদি চুক্তি থাকত সে ক্ষেত্রে ছিল অন্যকথা। অন্যদিকে প্রতিটি গোত্র যখনই আগ্রাসন ও আক্রমণের শিকার হতো তখন সকল আগ্রাসনকারীকে হত্যা করা তাদের ন্যায্য অধিকার বলে গণ্য হতো। কারণ তারা বিশ্বাস করত যে, একমাত্র রক্ত ব্যতীত অন্য কিছু রক্তকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে সক্ষম নয়।

আরব জাতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার মাধ্যমে গোত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পদার্পণ করে। মহানবী (সা.) বিক্ষিপ্ত আরব গোত্রগুলোকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে যে সব গোত্র সুদূর অতীতকাল থেকে পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আক্রমণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল এবং একে অন্যের রক্ত ঝরাত তাদের অল্প সময়ের মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করা সত্যি একটি বড় কাজ এবং একটি অতুলনীয় সামাজিক মুজিযা (অলৌকিক বিষয়) বলে গণ্য। কারণ এ ধরনের বিশাল পরিবর্তন যদি কতগুলো স্বাভাবিক পরিবর্তন ও রূপান্তরেরই ফল হতো তাহলে এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ এবং অগণিত মাধ্যম ও উপায়-উপকরণের প্রয়োজন হতো।

টমাস কারলাইল বলেছেন, "মহান আল্লাহ্ ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে আরব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পরিচালিত করেছেন। সে জাতি স্থবির ছিল, যাদের ধ্বনি শোনা যেত না, যাদের কর্মতৎপরতা ও প্রাণচাঞ্চল্য অনুভূত হতো না তাদের থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হয় যারা অখ্যাতি থেকে খ্যাতির দিকে, অলসতা ও শৈথিল্য থেকে জাগরণের দিকে, হীনতা ও দীনতা থেকে উচ্চ মর্যাদার পানে, দুর্বলতা ও অক্ষমতা থেকে শক্তি ও ক্ষমতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। তাদের থেকে আলো পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর একশ’ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই মুসলিম উম্মাহ্ এক পা ভারতে ও অপর পা আন্দালুসিয়ায় (বর্তমান স্পেন) রাখতে সক্ষম হয়েছিল।” ১

পাশ্চাত্যের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মেসিয়োর ন্যাঁ তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন,

"এই বিস্ময়কর সুমহান ঘটনা (ইসলাম) যা আরব জাতিকে দিগ্বিজয়ী এবং উন্নত চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার উদ্ভাবকের পোশাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে- তা ঘটার সময়কাল পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের কোন অঞ্চলই না বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ বলে গণ্য হতো, আর না বিজ্ঞান বা ধর্মের দৃষ্টিতে সেখানে সভ্যতার কোন নিদর্শন বিদ্যমান ছিল।” ২

হ্যাঁ, জাহেলিয়াত যুগের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তগণ অর্থাৎ বিভিন্ন আরব গোত্র না কোন সভ্যতার আলো প্রত্যক্ষ করেছে, আর না তাদের কোন শিক্ষা-দীক্ষা, নিয়ম-কানুন ও আচার-প্রথার প্রচলন ছিল। যে সকল সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য উন্নতি ও সভ্যতা বিকাশের কারণ সেগুলো থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত ছিল। অতএব, কখনই আশা করা যেত না যে, এই জাতি এত অল্প সময়ের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের শীর্ষে আরোহণ করবে এবং সংকীর্ণ গোত্রীয় জীবনের গ-ি পেরিয়ে মানবতার সুবিস্তৃত জগতের পানে অগ্রসর হবে।

পৃথিবীর জাতিসমূহ আসলে ইমারতসদৃশ। যেমনভাবে একটি মৌলিক ইমারত মজবুত উপাদানের মুখাপেক্ষী যা সঠিক পদ্ধতি অনুসারে এবং পূর্ণ শৃঙ্খলার সাথে নির্মিত হয়েছে যাতে করে তা ঝড়-ঝঞ্ঝা ও বৃষ্টি-বাদলের প্রভাব থেকে টিকে থাকতে এবং স্থায়ী হতে পারে, ঠিক তেমনি একটি সাহসী ও নৈতিক গুণসম্পন্ন জাতির গঠন-কাঠামো ও দৃঢ় ভিত্তিসমূহ অর্থাৎ মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস, পূর্ণাঙ্গ রীতি-নীতি এবং উন্নত মানবীয় স্বভাব-চরিত্রের মুখাপেক্ষী যাতে তা অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও প্রগতির পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়।

এ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত যে, কোথা থেকে এবং কিভাবে জাহেলী বেদুইন আরবদের ক্ষেত্রে এত আশ্চর্যজনক পরিবর্তন সাধিত হলো? যে জাতি গতকাল পর্যন্তও নিজেদের সার্বিক শক্তি মতবিরোধ ও কপটতার মধ্যে ব্যবহার করে নিঃশেষ করত এবং সব ধরনের সমাজব্যবস্থা থেকে বহু দূরে ছিল, এত অত্যাশ্চর্যজনক দ্রুতগতিতে সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও ঐক্যের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে গেল এবং একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করল যে, সেই সময়ের বিশ্বের বৃহৎ জাতিসমূহকে তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও রীতিনীতির সামনে নতজানু ও একান্ত আনুগত্যশীল করতে সক্ষম হয়েছিল।

সত্যিই যদি নির্ধারিত হয়ে থাকে যে, হিজায অর্থাৎ আরব উপদ্বীপের আরব জাতি এত উন্নতি করবে এবং এত বড় সম্মান ও গৌরবের অধিকারী হবে তাহলে ইয়েমেনের আরবগণ যারা (পূর্ব হতে) সভ্যতা ও কৃষ্টির অধিকারী ছিল তারা বছরের পর বছর ধরে রাজত্ব করেছে এবং বড় বড় শাসনকর্তাকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছে তারা কেন এ ধরনের উন্নতি ও প্রগতির অধিকারী হতে পারে নি? শামদেশের প্রতিবেশী গাস্সানী আরবগণ যারা সভ্য রোমীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে জীবনযাপন করত তারা কেন উন্নতি ও বিকাশের এ পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয় নি? হীরার আরবগণ যারা গতকালও বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাস করত তারা কেন এ ধরনের উন্নতি করতে সক্ষম হয় নি? প্রাগুক্ত জাতিসমূহ যদি এ ধরনের সাফল্য অর্জন করত তাহলে তা আশ্চর্যজনক বিষয় বলে বিবেচিত হতো না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এটিই যে, হিজাযের আরবগণ যাদের নিজেদের কোন ইতিহাসই ছিল না তারাই সুমহান ইসলামী সভ্যতার উত্তরাধিকারী হয়েছে।

1.    ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদের নীলনকশাসমূহ, পৃ. ৩৮।

2.    তামাদ্দুনে ইসলাম ওয়া আরাব, পৃ. ৮৭।

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: