bayyinaat

Published time: 29 ,November ,2018      22:50:20
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রাম
কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রাম মূল : আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী সংগ্রহে: আবুল কাসেম আমরা যদি আরবদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারপূর্ণ সব আচার-আচরণকে (জাদু-টোনা, ঝাড়ফোঁক ইত্যাদি) ইসলামের সুদৃঢ় বিধিবিধানের সাথে তুলনা করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, এই শরীয়ত তদানীন্তন আরব সমাজে প্রচলিত চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। মহানবী (সা.) তাঁর সকল শক্তি নিয়োগ করে জাহেলিয়াতের নিদর্শনসমূহ যা ছিল বিভিন্ন ধরনের অসার কল্প-কাহিনী, অলীক ধ্যান-ধারণা ও কুসংস্কার তা মূলোৎপাটন করার চেষ্টা করেছেন।
সংবাদ: 139

কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রাম

মূল : আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী                     

সংগ্রহে: আবুল কাসেম

আমরা যদি আরবদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারপূর্ণ সব আচার-আচরণকে (জাদু-টোনা, ঝাড়ফোঁক ইত্যাদি) ইসলামের সুদৃঢ় বিধিবিধানের সাথে তুলনা করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, এই শরীয়ত তদানীন্তন আরব সমাজে প্রচলিত চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। মহানবী (সা.) তাঁর সকল শক্তি নিয়োগ করে জাহেলিয়াতের নিদর্শনসমূহ যা ছিল বিভিন্ন ধরনের অসার কল্প-কাহিনী, অলীক ধ্যান-ধারণা ও কুসংস্কার তা মূলোৎপাটন করার চেষ্টা করেছেন।

ট্যাগ: ইসলাম, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি, কুসংস্কার, অসার কল্প-কাহিনী, অলীক ধ্যান-ধারণা,

জাহেলিয়াত যুগের আরবদের বিশ্বাসে কুসংস্কার

বিশ্বের সকল জাতি ও সমাজের আকীদা-বিশ্বাস ইসলামের সূর্যোদয়ের সময় বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার ও অলীক উপাখ্যান দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। গ্রীক ও সামানীয় অলীক উপাখ্যান ও কল্প-কাহিনীসমূহ সে যুগের সবচেয়ে সভ্য ও উন্নত জাতিসমূহের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখনও প্রাচ্যের উন্নত জাতিসমূহের মধ্যে অনেক কুসংস্কার বিদ্যমান রয়েছে যা আধুনিক সভ্যতা জনগণের জীবন থেকে দূর করতে পারে নি। জ্ঞান ও কৃষ্টিসমূহের অনুপাতে কল্প-কাহিনী ও কুসংস্কারের প্রসার ও বিলুপ্ত হয়ে থাকে। সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে যত পশ্চাদপদ ও অনগ্রসর  হবে ঠিক সেই অনুপাতে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসও তাদের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে।

ইতিহাস আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের প্রচুর কুসংস্কার ও কল্প-কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছে। ‘বুলূগুল আরবে ফী মারেফাতি আহওয়ালিল আরাব’ গ্রন্থের রচয়িতা এ সব কুসংস্কার ও কল্প-কাহিনীর অনেকাংশ কতগুলো কবিতা ও গল্প আকারে ঐ গ্রন্থে সংগ্রহ করেছেন। যে কোন ব্যক্তি এ গ্রন্থ ও অন্যান্য গ্রন্থ পাঠ করার পর নানারূপ কুসংস্কারের সাথে পরিচিত হবেন যা জাহেলী আরবদের মন-মস্তিষ্ক ভর্তি করে রেখেছিল। আর এ সব ভিত্তিহীন বিষয়বস্তু ছিল অন্যান্য জাতি থেকে আরব জাতির অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ হওয়ার কারণ। ইসলাম ধর্মের অগ্রগতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ঐ সব কল্প-কাহিনী ও কুসংস্কার।

আর এ কারণেই মহানবী (সা.) তাঁর সকল শক্তি নিয়োগ করে জাহেলিয়াতের নিদর্শনসমূহ যা ছিল বিভিন্ন ধরনের অসার কল্প-কাহিনী, অলীক ধ্যান-ধারণা ও কুসংস্কার তা মূলোৎপাটন করার চেষ্টা করেছেন। মহানবী (সা.) যখন মায়ায ইবনে জাবালকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেছিলেন তখন তিনি তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, "হে মায়ায! জনগণের মধ্য থেকে জাহেলিয়াতের সকল চিহ্ন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস উচ্ছেদ করবে এবং ইসলামের যাবতীয় প্রথা ও আদর্শ যা হচ্ছে চিন্তা-ভাবনা এবং গভীর অনুধাবন ও উপলব্ধির দিকে আহ্বান তা পুনরুজ্জীবিত করবে।”২

و أمت امر الجاهلية إلّا ما سنّهُ الإسلام و أظهر أمر الإسلام كلّه صغيره و كبيره

যে আরব জাতির ওপর বহু বছর যাবত জাহেলী চিন্তাধারা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল তাদের সামনে তিনি এ রকম বলেছিলেন,

كلّ مأثرة في الجاهلية تحت قدمي

"(ইসলামের আবির্ভাবের সাথে সাথে) সব ধরনের অলীক আচার-অনুষ্ঠান, আকীদা-বিশ্বাস, মিথ্যা অহমিকা ও গর্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং তা আমার পদতলে রাখা হলো।”৩

যাতে করে ইসলাম ধর্মের উচ্চাঙ্গের তত্ত্বজ্ঞান স্পষ্ট হয়ে যায় সেজন্য এখানে কতিপয় উদাহরণ পেশ করব :

১. বৃষ্টি বর্ষণের জন্য আগুন জ্বালানো : আরব উপদ্বীপ বছরের বেশিরভাগ সময়ই শুষ্ক থাকে; সেখানকার অধিবাসীরা বৃষ্টিপাতের জন্য ‘সালা’ (سلع) নামের এক প্রকার নিমজাতীয় বৃক্ষের কাঠ এবং ‘ওসর’ (عشر) নামের অপর একটি দ্রুত দহনশীল বৃক্ষের কাঠ একত্র করে সেগুলোকে গরুর লেজের সাথে বেঁধে গরুকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যেত। তারপর ঐ কাঠগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিত। ওসর বৃক্ষের কাঠের মধ্যে দগ্ধকারী উপাদান থাকার কারণে ঐ কাঠগুলো থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত। আর গরুটি দগ্ধ হওয়ার কারণে ছুটোছুটি ও উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার শুরু করত। তারা এ ধরনের কাপুরুষোচিত কাজকে পূর্বপুরুষদের প্রাচীন রীতিনীতির অনুসরণ হিসাবে আকাশের বিদ্যুৎ চমকানি ও বজ্রপাতের সাথে তুলনা করত। তারা অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে বিদ্যুৎ এবং গরুর চিৎকারকে বজ্রপাতের শব্দের স্থলে বিবেচনা করত; তারা তাদের এ কাজকে বৃষ্টি বর্ষণে কার্যকর প্রভাব রাখে বলে বিশ্বাস করত।

২. যদি গাভী পানি না খেত তাহলে তারা ষাঁড়কে প্রহার করত। পানি পান করানোর জন্য গাভী ও ষাঁড়গুলোকে পানির নালার ধারে নিয়ে যাওয়া হতো। মাঝে মধ্যে এমন হতো যে, ষাঁড়গুলো পানি খেত, কিন্তু গাভীগুলো পানি স্পর্শও করত না। আরবরা মনে করত যে, গাভীগুলোর পানি পান করা থেকে বিরত থাকার কারণ হচ্ছে ঐ সব শয়তান যা ষাঁড়ের দু’শিংয়ের মাঝখানে স্থান নিয়েছে এবং গাভীগুলোকে পানি পান করতে দিচ্ছে না। তাই ঐ শয়তানগুলোকে তাড়ানোর জন্য ষাঁড়ের মাথা ও মুখমণ্ডলে প্রহার করত।৪

৩. নীরোগ উটের মাথায় আগুনের ছ্যাঁকা দেয়া হতো যাতে করে অপরাপর উট সুস্থ হয়ে ওঠে: কোন উট যদি অসুস্থ হয়ে পড়ত অথবা উটের ঠোঁট ও মুখে ক্ষত ও ঠোসা দেখা যেত তাহলে অন্যান্য উটের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ রোধ করার জন্য একটি সুস্থ উটের ঠোঁট, বাহু ও ঊরুতে ছ্যাঁকা দেয়া হতো, কিন্তু তাদের এ কাজের কারণ স্পষ্ট নয়। কখনো কখনো ধারণা করা হয় যে, এ ধরনের কাজের রোগ-প্রতিষেধক দিক আছে এবং এটি এক ধরনের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাপদ্ধতিও হতে পারে। কিন্তু যেহেতু অনেক উটের মধ্য থেকে কেবল একটি উটের ওপর এ ধরনের বিপদ নেমে আসত তাই বলা যায় যে, তা এক ধরনের কুসংস্কার।

৪. একটি উটকে কোন কবরের কাছে আটকে রাখা হতো যাতে করে কবরবাসী কিয়ামত দিবসে পদব্রজে (কবর থেকে) উত্থিত না হয় (অর্থাৎ উক্ত উটের ওপর সওয়ার অবস্থায় উত্থিত হয়)

যদি কোন মহান ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করত তখন ঐ ব্যক্তির কবরের পাশে একটি গর্ত খুঁড়ে তাতে একটি উট আটকে রাখা হতো এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঐ উটকে দানা-পানি ও খড়কুটা কিছুই খেতে দেয়া হতো না যাতে করে কিয়ামত দিবসে মৃত ব্যক্তি ঐ উটের ওপর সওয়ার হয় এবং দ-ায়মান অবস্থায় তার পুনরুত্থান না হয়।

৫. কবরের পাশে উট জবাই করা হতো। যেহেতু মৃত ব্যক্তি জীবদ্দশায় তার প্রিয় ব্যক্তি ও অতিথিদের জন্য উট জবাই করত তাই মৃতকে সম্মান ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তার আত্মীয়স্বজন তার কবরের কাছে বেদনাদায়কভাবে উট বধ করত।

কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রাম

এ ধরনের কাজ যা যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাথে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ আগুন জ্বালানোর কারণে বৃষ্টিপাত হয় না, ষাঁড়কে প্রহার করলে গাভীর মধ্যে এর কোন প্রভাবই পড়ে না, আর নীরোগ উটকে ছ্যাঁকা দিলে তা রোগাক্রান্ত উটের সুস্থতা ও রোগমুক্তির কারণ হয় না এবং...) পশুগুলোর প্রতি অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যদি এ সব আচার-আচরণকে ইসলামের সুদৃঢ় বিধিবিধান- যা জীবজন্তু সংরক্ষণ করার ব্যাপারে প্রবর্তিত হয়েছে সেগুলোর সাথে তুলনা করি তাহলে আমাদের বলতে হবে : এই শরীয়ত তদানীন্তন আরব সমাজে প্রচলিত চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা এখানে ইসলামের অগণিত বিধানের মধ্য থেকে কেবল একটি ছোট বিধান উল্লেখ করব :

মহানবী (সা.) বলেছেন, "প্রতিটি বাহক পশুর আরোহীর ওপর ছয়টি অধিকার আছে : ১. যে অবতরণস্থলে অবতরণ করবে সেখানে পশুটিকে কিছু খাদ্য খেতে দেবে, ২. যদি পানি বা জলাধারের পাশ দিয়ে গমন কর, তাহলে ঐ পশুটিকে পানি পান করাবে, ৩. পশুর মুখের ওপর চাবুক মারবে না, ৪. দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সময় পশুর পিঠের ওপর বসে থাকবে না, ৫. ক্ষমতার বাইরে পশুর ওপর অধিক বোঝা চাপাবে না, ৬. যে পথে চলার সামর্থ্য পশুটির নেই সে পথে পশুকে চালনা করবে না।”৫

৬. রোগীদের চিকিৎসাপদ্ধতির ক্ষেত্রে কুসংস্কার : যদি কোন ব্যক্তিকে বিচ্ছু বা সাপ দংশন করত তাহলে উক্ত ব্যক্তির ঘাড়ে স্বর্ণালংকার ঝোলানো হতো এবং বিশ্বাস করা হতো যে, যদি দংশিত ব্যক্তির সাথে তামা ও টিন থাকে তাহলে সে মারা যাবে। জলাতঙ্ক রোগ- যা সাধারণত উক্ত রোগে আক্রান্ত কুকুরের দংশনে সংক্রমিত হয়- দংশিত স্থানের ওপর গোত্রপ্রধানের অল্প রক্ত মাখিয়ে চিকিৎসা করা হতো। আর নিম্নোক্ত কবিতায় তা প্রতিফলিত হয়েছে :

أحلامكم لسقام الجهل شافية    كما دماءكم تشفى من الكلب

"যেমন (জলাতঙ্ক ব্যাধিবাহী) কুকুর হতে আরোগ্য দেয় তোমাদের রক্ত

ঠিক তেমনি তোমাদের স্বপ্নগুলোও অজ্ঞতা (জনিত) ব্যাধির আরোগ্যদানকারী।”

আর যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে উন্মাদনার আলামত প্রকাশ পেত তাহলে অপবিত্র আত্মা দূর করার জন্য নোংরা কার্যকলাপের আশ্রয় নেয়া হতো। নোংরা ন্যাকড়া এবং মৃত ব্যক্তিদের হাড় পাগলের গলায় ঝুলানো হতো। যাতে করে শিশুরা শয়তানের কুপ্রভাব দ্বারা প্রভাবিত না হয় (অর্থাৎ শয়তানের প্রভাব তাদের ওপর না পড়ে) সেজন্য শিয়াল ও বিড়ালের দাঁত সুতার সাথে বেঁধে শিশুদের গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হতো। যখন শিশুদের ঠোঁট ও মুখ বিষফোঁড়ায় ভরে যেত তখন শিশুর মা একটি চালুনী মাথার ওপর বসিয়ে গোত্রের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে রুটি ও খেজুর জমা করত এবং তা কুকুরকে খেতে দিত যাতে করে নিজ সন্তানের ঠোঁট ও মুখের ফোঁড়া সেরে যায়; গোত্রের মহিলারা সজাগ দৃষ্টি রাখত যে, তাদের সন্তানরা ঐ সব রুটি ও খেজুর থেকে কিছু না খায়, পাছে তারা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

চর্মরোগ, যেমন দেহের চামড়া ঝরে পরার চিকিৎসা করার জন্য মুখের লালা চর্মরোগাক্রান্ত স্থানে মালিশ করত। যদি কোন ব্যক্তির (চর্ম) রোগ এতে ভালো না হতো এবং অব্যাহত থাকত তাহলে ভাবা হতো রোগী যে সব প্রাণী, যেমন সাপ, শয়তানদের (অপদেবতা) সাথে যুক্ত সেগুলোর কোন একটিকে হত্যা করেছে। তারা শয়তানদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য কাদামাটি দিয়ে উটের মূর্তি নির্মাণ করত। এরপর যব, গম ও খেজুর ঐ মূর্তিগুলোর ওপরে রেখে সেগুলো পাহাড়ের গুহার সামনে রেখে চলে আসত এবং পরের দিন তারা উক্ত স্থানে ফিরে যেত। যদি তারা দেখতে পেত যে, বোঝাগুলো খোলা হয়েছে, তাহলে তারা একে নজরানা কবুল হওয়ার নিদর্শন বলে গণ্য করত এবং বলত যে, রোগীটি সুস্থ হয়ে যাবে। আর এর অন্যথা হলে তারা বিশ্বাস করত, যেহেতু এ নজরানা তুচ্ছ ও নগণ্য তাই তা অপদেবতারা গ্রহণ করে নি।

ইসলাম বিভিন্ন পদ্ধতিতে এ সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। একদল মরুচারী আরব বেদুইন যারা যাদুর কর্ণফুল, যাদুর তাবীজ, মাদুলী এবং হার- যার মধ্যে পাথর ও হাড় বেঁধে রাখা হতো তা দিয়ে রোগীর রোগের চিকিৎসা করত তারা যখন মহানবী (সা.)-এর কাছে গমন করত এবং উদ্ভিদ ও ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করত তখন মহানবী (সা.) বলতেন, "প্রতিটি রোগীর জন্য ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ যে আল্লাহ্ ব্যথা ও রোগযন্ত্রণা সৃষ্টি করেছেন তিনিই রোগের ঔষধও তৈরি করেছেন।”৬  অর্থাৎ এ সব কর্ণফুল, তাবীজ, মাদুলী ও মালা রোগ নিরাময় করার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। এমনকি যখন সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস হৃদরোগে আক্রান্ত হন তখন মহানবী (সা.) তাঁকে বলেছিলেন, "সাকীফ গোত্রের প্রসিদ্ধ ডাক্তার হারিস কালদার কাছে তোমরা অবশ্যই যাবে।”৭ এরপর তিনি তাঁকে একটি বিশেষ ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিলেন।

অধিকন্তু যাদুর কর্ণফুল, তাবীজ ও মাদুলী যেগুলোর আসলে কোন কার্যকর প্রভাব নেই সেগুলো সংক্রান্ত বেশ কিছু বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে। এখানে আমরা দু’টি বর্ণনা উল্লেখ করাই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করছি :

এক ব্যক্তি যার সন্তান গলাব্যথা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল সে যাদুর মাদুলী ও তাবীজসহ মহানবীর সামনে উপস্থিত হলো। মহানবী (সা.) বললেন, "তোমরা তোমাদের সন্তানদের যাদুর এ সব কর্ণফুল, তাবীজ ও মাদুলী দিয়ে ভয় দেখিও না। এই অসুস্থ রোগীকে ভারতীয় চন্দন কাঠের নির্যাস সেবন করানো প্রয়োজন।”৮

ইমাম সাদেক (আ.) বলতেন, إنّ كثيرا من التّمائم شرك "বহু বাজুবন্দ, কর্ণফুল ও মাদুলী হচ্ছে শিরক।”৯

মহানবী (সা.) এবং তাঁর সম্মানিত ওয়াসিগণ (নির্বাহী প্রতিনিধিগণ) জনগণকে অসংখ্য ঔষধ সম্পর্কে অবহিত করার মাধ্যমে যে সব অলীক ধারণা ও কুসংস্কার জাহেলী যুগের আরব জাতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেগুলোর ওপর জোরালো আঘাত হেনেছেন। তাঁদের বর্ণিত এ সব ঔষধ-পথ্য বড় বড় হাদীসশাস্ত্রবিদ কর্তৃক ‘তিব্বুন নবী’ (নবীর চিকিৎসাপদ্ধতি), ‘তিব্বুর রেযা’ (ইমাম রেযার চিকিৎসাপদ্ধতি) ইত্যাদি শিরোনামে সংকলিত হয়েছে।

৭. আরো কিছু কুসংস্কার : দুশ্চিন্তা ও ভীতি দূর করার জন্য আরবরা নিম্নোক্ত মাধ্যমগুলো ব্যবহার করত :

ক. যখন তারা কোন গ্রামে প্রবেশ করত এবং কলেরা রোগ অথবা অপদেবতার ভীতি তাদের পেয়ে বসত তখন ভীতি দূর করার জন্য তারা গ্রামের ফটকের সামনে ১০ বার গাধার ন্যায় চিৎকার করত। আবার কখনো কখনো এরূপ চিৎকার করার সময় শিয়ালের হাড় ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখত।

খ. যখন তারা কোন মরুপ্রান্তরে হারিয়ে যেত তখন তারা তাদের পরিধেয় বস্ত্র উল্টে-পাল্টে পরত। সফর করার সময় যখন তারা তাদের স্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতা করার আশংকা করত তখন তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোন গাছের কা-ে বা ডালে একটি সুতা বেঁধে রাখত। ফেরার সময় যদি তারা দেখতে পেত, সুতা অক্ষত ও পূর্বের অবস্থায় আছে তাহলে তারা নিশ্চিত হতো যে, তাদের পত্নীরা বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আর যদি তারা দেখতে পেত, সুতাটি নেই অথবা খুলে গেছে তাহলে তারা তাদের স্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করত।

যদি তাদের সন্তানদের দাঁত পড়ে যেত তাহলে তারা ঐ দাঁতটিকে দু’আঙ্গুল দিয়ে ধরে সূর্যের দিকে ছুঁড়ে দিত ও বলত, "হে সূর্য! এ দাঁতের চেয়ে উত্তম দাঁত দাও।” যে নারীর সন্তান বাঁচত না সে যদি কোন বয়স্ক মানুষের নিহত লাশের ওপর দিয়ে সাত বার হাঁটত, তখন তারা বিশ্বাস করত যে, তার সন্তান জীবিত থাকবে।

এগুলো হচ্ছে অগণিত কুসংস্কারের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র যা জাহেলী যুগের বেদুইন আবরদের জীবনধারাকে প্রগাঢ়ভাবে তিমিরাচ্ছন্ন করেছিল এবং তাদের চিন্তা-ভাবনাকে উন্নতির সুউচ্চ শিখরে উড্ডয়ন করা থেকে বিরত রেখেছিল।

1.    সাইয়্যেদ মাহমূদ আলূসীর রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৬-৩৬৯।

2.    তুহাফুল উকূল, পৃ. ২৫; সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪১২।

3.    সীরাতে ইবনে হিশাম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪১২।

4.    গাভীগুলো পানি না খাওয়ার অপরাধে ষাঁড়গুলোকে যে প্রহার করা হতো এ প্রসঙ্গে এক আরব কবি বলেছেন,فإنّي إذا كالثور يضرب جنبه        إذا لم يعف شربا و عافت صواحبه

   "অতঃপর আমি এখন ঐ ষাঁড়ের ন্যায় যার পার্শ্বদেশে প্রহার করা হয় তখন

      যখন তা পান করা থেকে থাকেনি বিরত এবং গাভীগুলো থেকেছে বিরত।”

5.    মান লা ইয়াহ্দুরুহুল ফাকীহ্, পৃ. ২২৮; জীবজন্তুর অধিকার সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার জন্য আশ্শুয়ুনুল ইকতিসাদিয়াহ্ গ্রন্থ, পৃ. ১৩০-১৫৯।

6.    আত্তাজ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭৮।

7.    আত্তাজ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭৯।

8.    আত্তাজ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৮৪।

9.    সাফীনাতুল বিহার, رقي ধাতু।

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: