bayyinaat

Published time: 05 ,March ,2017      20:53:21
প্রবন্ধ
এ প্রবন্ধে আমরা জানব, কীভাবে কুরআন ও হাদীস আত্মোন্নয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং ধার্মিকতা (ঢ়রবঃু) ও আধ্যাত্মিকতা অর্জনে মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা ও সংগ্রামকে বর্ণনা করেছে...
সংবাদ: 14

এ প্রবন্ধে আমরা জানব, কীভাবে কুরআন ও হাদীস আত্মোন্নয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং ধার্মিকতা (ঢ়রবঃু) ও আধ্যাত্মিকতা অর্জনে মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা ও সংগ্রামকে বর্ণনা করেছে।

১. আধ্যাত্মিকতা : নিজ সত্তার সাথে যুদ্ধ করা

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মগঠন হলো নিজের মধ্যস্থিত একটি শত্রæর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। একটি সুপরিজ্ঞাত ও উৎসাহব্যঞ্জক হাদীসে বলা হয়েছে যে, মদীনায় মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের একটি দলকে যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসতে দেখলেন। তিনি তাঁদের বললেন : সাবাস! যারা ছোট যুদ্ধ সমাপন করেছ তাদের স্বাগতম এবং যাদের বড় যুদ্ধ এখনও দায়িত্বে রয়ে গেছে।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো : ‘বড় জিহাদ কোন্টি? তিনি জবাব দিলেন : ‘নিজের নাফ্্স এর সাথে যুদ্ধ।’১

সাহাবীরা একটি মহাযুদ্ধে তাঁদের শত্রæদের পরাজিত করেছিলেন এবং ইসলামের প্রতিরক্ষায় তাঁদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় তাঁদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। তাঁরা আশ্চর্যান্বিত এবং বিস্মিত হয়েছিলেন যে, কোন্্ বিষয়টি তার চেয়েও বড় হতে পারে। মহানবী (সা.) জবাব দিলেন : ‘জিহাদ আন্ নাফ্্স’ এর অর্থ হলো কারো নিজ সত্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাÑ নিজের সত্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।

অপর একটি প্রসিদ্ধ হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত আবু যার রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন : ‘কোন্্ জিহাদ সবচেয়ে বড়?’ মহানবী (সা.) জবাব দিলেন : ‘নিজ সত্তা এবং কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে জিহাদ করা।’২

আত্মোন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের বিষয়টির মূল অবশ্যই কুরআনে নিহিত। যেমন কুরআন মজীদ বলছে :

وَمَنْ جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ إِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ

আর যে কেউ চেষ্টা-সাধনা (জিহাদ) করে সে তো নিজের জন্যই চেষ্টা-সাধনা করে; নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্ববাসী হতে অমুখাপেক্ষী।’ (সূরা আনকাবুত : ৬)

কুরআনের অনেক তাফসীর অনুযায়ী এখানে চেষ্টা বা সংগ্রাম (জিহাদ) বলতে আধ্যাত্মিক জিহাদকে বুঝানো হয়েছে। তাফসীরকারগণ এটি প্রমাণ করার জন্য দু’টি দলিল ব্যবহার করেন। প্রথমত ‘নিজের জন্য’ শব্দটির ব্যবহার; এটি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেননা, একজন সৈন্য কোন একটি কারণে যুদ্ধ করেÑ এটা হতে পারে অত্যাচারিতদের পক্ষে অথবা হতে পারে ইসলামের সম্মানের জন্য অথবা তার দেশের জন্য। যা-ই হোক এ আয়াত কারণটিকে ‘নিজের জন্য’ বলে উল্লেখ করেছে। দ্বিতীয়ত, এ আয়াতের পূর্বে আল্লাহ্্ বলেন :

مَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ اللَّهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللَّهِ لَآتٍ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

যে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রত্যাশী (সে যেন প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কারণ,) আল্লাহর নির্ধারিত মেয়াদ অবশ্যম্ভাবী; এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আনকাবুত : ৫)

আল্লাহ্্র সাথে সাক্ষাতের এ ধারণাও একটি আধ্যাত্মিক বিষয়। আর এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী আয়াতটিও (সূরা আনকাবুত : ৬)Ñ যেটি নিজের জন্য জিহাদ করা সম্পর্কিত, সেটিও একটি আধ্যাত্মিক বিষয়। অবশ্য এটি এমন নয় যে, এ আয়াত সশস্ত্র যুদ্ধকে শামিল করে না, কিন্তু এটি আধ্যাত্মিক জিহাদকেও শামিল করে।

পবিত্র কুরআনের নি¤œাক্ত আয়াতগুলোও আধ্যাত্মিক জিহাদ সম্পর্কিত, যদিও এগুলো সশস্ত্র জিহাদকেও শামিল করতে পারে, যেহেতু সশস্ত্র জিহাদের ক্ষেত্রেও নিয়্যত ও আত্মার শুদ্ধতার প্রয়োজন রয়েছে।

وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ

এবং প্রকৃত জিহাদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহর পথে জিহাদ কর...’ (সূরা হজ : ৭৮)

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ

যারা আমাদের পথে সংগ্রাম করে আমরা তাদের অবশ্যই আমাদের পথসমূহের নির্দেশনা দান করব; এবং নিশ্চয় আল্লাহ পুণ্যকর্মশীলদের সাথী।’ (সূরা আনকাবুত : ৬৯)

অভ্যন্তরীণ শত্রæর সাথে যুদ্ধ সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। কারণ, এটি আরও কঠিন। যখন কোন শত্রæ অভ্যন্তরে খুঁজে পাওয়া যায় তখন তা আরও বিপজ্জনক এবং তাকে পরাজিত করা আরও কঠিন। একটি গৃহযুদ্ধ সীমান্তে বহিঃশত্রæর সাথে যুদ্ধ করার চেয়ে বেশি কঠিন। আমাদের  ঘরের বাইরে অবস্থানকারীদের বিতাড়ন করা অপেক্ষা আমাদের ঘর জবর-দখলকারীদের বিতাড়ন করা কঠিন। যদি আমাদের শত্রæ আমাদের মধ্যে থাকে, তাহলে সে আমাদের সকল গোপন বিষয় জানে। সে আমাদের দুর্বল ও শক্তিশালী বিষয়গুলো জানে এবং সে জানে কীভাবে আমাদের সাথে খেলতে হবে। অভ্যন্তরীণ শত্রæ সবসময় আমাদের সাথে থাকে এবং আমাদেরকে কোন অবসর দেয় না। আমরা হয়ত বহিঃশত্রæর সাথে সন্ধি করার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি করতে পারি, কিন্তু অভ্যন্তরীণ শত্রæর সাথে দিবারাত্রি বিরামহীনভাবে সংঘাত চলতে থাকে। আর দুর্ভাগ্যবশত আমরা এ শত্রæকে ভালোবাসি আর সম্মানও করি, কারণ, এটা আমাদের নিজেদেরই আত্মা। সে আমাদের জন্য অনেক খারাপ কাজ করেছে, তারপরও আমরা তাকে ভালোবাসি। অতএব, এটি একটি খুবই কঠিন ও জটিল সংগ্রাম। তাই আমাদেরকে দৃঢ়চিত্ত এবং পুরোপুরি সতর্ক হওয়া উচিত। যদি আমরা এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারি, তবেই আল্লাহ্্ আমাদের ওপর দয়া করবেন।

আমাদের জানা উচিত যে, এ সংগ্রামে সকল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্তে¡ও পরিশেষে তা এতটা কঠিন নয়। যারা সত্যিই এ যুদ্ধে জিততে চায়, আল্লাহ্্ তাদের পথনির্দেশ করবেন এবং তাদের জন্য বিষয়টি সহজ করে দেবেন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, যখন আমরা কিছু জানি তখন অবশ্যই আমাদের তা অনুশীলন করা প্রয়োজন। যদি আমরা আমাদের জ্ঞানের ব্যবহার করি, তাহলে আল্লাহ্ আমাদেরকে আমরা যা জানি না, সে বিষয়ের জ্ঞান আমাদের দান করবেন। যদি আমরা আমাদের স্বল্প জানা বিষয়গুলোকে অনুশীলন করি,  তাহলে তা আমাদের সামনের পথকে আলোকিত করে দেবে।

২. ঔষধ হিসাবে আধ্যাত্মিকতা

আরেকটি দৃষ্টিকোণ হলো আধ্যাত্মিকতাকে আমাদের আত্মার জন্য এক ধরনের ঔষধ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। আধ্যাত্মিক সমস্যাগুলোকে অসুস্থতা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে আর তাই আমাদের জন্য বিশেষ ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা রোগগ্রস্ত হলে আমাদের নিরাময়ের প্রয়োজন রয়েছে, আমাদের ওষুধের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের শরীরের মতো আমাদের আত্মাও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। দুর্ভাগ্যবশত অসুস্থতার সবচেয়ে কঠিন অবস্থা হলো যখন আমরা (অন্তরের) গভীর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ি। পবিত্র কুরআন দশটি আয়াতে মানুষের একটি দল সম্পর্কে বলেছে যাদের হৃদয়ে রোগ রয়েছে। এই রোগ আল্লাহ্্ কর্তৃক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কারণ, তারা এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে চায় না এবং অসুস্থ থাকাতেই সন্তুষ্ট থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমরা কুরআন মজীদে পাঠ করি :

  فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

তাদের অন্তরসমূহে ব্যাধি (পূর্ব থেকেই) রয়েছে, অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছেন।’ (সূরা বাকারা : ১০)

পবিত্র কুরআন সুস্থ ও পবিত্র হৃদয় সম্পর্কেও কথা বলে:

آیه ﴿ ﴾

এবং যেদিন তারা (মানুষ) পুনরুত্থিত হবে সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত কর না, যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকার সাধন করবে না, তার জন্য ব্যতীত যে (সেদিন) বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আল্লাহর সমীপে উপস্থিত হবে।’ (সূরা শুআরা : ৮৭-৮৯)

এটি ছিল হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রার্থনা। সূরা সাফফাত-এর ৮৩ এবং ৮৪ নং আয়াতে আল্লাহ্্ আমাদের জানাচ্ছেন যে, এ প্রার্থনা কবুল করা হয়েছে : ‘এবং নিশ্চয় ইবরাহীম তার (হযরত নূহের) অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন সে তার প্রতিপালকের নিকট বিশুদ্ধ চিত্তে উপস্থিত হয়েছিল।’

সুতরাং, আমরা বুঝতে পারি যে, একটি সুস্থ ও পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর মতো নবী, যিনি একেশ্বরবাদী সকল ধর্মের পিতা, তিনি আল্লাহ্্র কাছে এর জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। নিশ্চয়ই, এটাই একমাত্র জিনিস যা কিয়ামতের দিন উপকারে আসবে যখন আর কোন কিছুই কোন উপকারে আসবে নাÑ না সন্তান, না অর্থ। ইমাম আলী (আ.) বলেন :

أَلَا وَ إِنَّ مِنَ الْبَلاَءِ الْفَاقَةَ وَ أَشَدُّ مِنَ الْفَاقَةِ مَرَضُ الْبَدَنِ وَ أَشَدُّ مِنْ مَرَضِ الْبَدَنِ مَرَضُ الْقَلْبِ

একজন মানুষের ওপর অন্যতম যে বিপদ আপতিত হয় তা হলো দারিদ্র্য, কিন্তু দারিদ্র্যের চেয়েও কঠিন হলো অসুস্থতা। আর শারীরিক অসুস্থতার চেয়েও কঠিন হলো অন্তরের অসুস্থতা।’ (নাহজুল বালাগা, ৩৮৮ নং খুতবা)

সুতরাং সবচেয়ে খারাপ দারিদ্র্য হলো ধর্মানুরাগের ঘাটতি। এ প্রসঙ্গে ‘ঔষধ মতবাদ’ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইমাম আলী (আ.) তাঁর ভাষণে ধার্মিকদের সম্পর্কে বলেন :

أَمَّ اللَّيْلَ فَصَافُّوْنَ أَقْدَامَهُمْ تَالِيْنَ لِأَجْزَاءِ الْقُرْآنِ يُرَتِّلُونَهَا تَرْتِيْلاً يُحَزِّنُوْنَ بِهِ أَنْفُسَهُمْ وَ يَسْتَثِيْرُوْنَ بِهِ دَوَاءَ دَائِهِمْ

(ধার্মিক  লোকেরা হলো) তারা যারা রাত্রিতে দÐায়মান হয় (নামায পড়ে) এবং কুরআন পাঠ করে এবং তারা নিজেদেরকে ব্যথিত করার চেষ্টা করে। তারা তাদের অসুস্থতার জন্য কুরআন থেকে ঔষধ হিসাবে চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করে।’৩

জাবির ইবনে ইয়াযীদ জু’ফীকে ইমাম বাকের (আ.) বলেন :

وَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا عِلْمَ كَطَلَبِ السَّلاَمَةِ وَ لَا سَلَامَةَ كَسَلاَمَةِ الْقَلْبِ

এবং জেনে রাখ যে, সুস্থতা কামনা করার জ্ঞানের মতো কোন জ্ঞান নেই এবং আত্মার সুস্থতার মতো কোন সুস্থতা নেই।’৪

আধ্যাত্মিক ঔষধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো : আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের আত্মায় রোগ প্রবেশে প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে এবং একইভাবে আমাদেরকে অসুস্থ লোকদের থেকেও দূরত্ব বজায় রাখতে হবে যেন সেই রোগ আমাদের সংক্রমিত না করে; তাদের সান্নিধ্যে আমরা আমাদের শরীরকে বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ করব। যা হোক, আমাদের রোগ থেকে মুক্তির পথ রয়েছে, যেহেতু আল্লাহ্্ হলেন পরম ক্ষমাশীল। উপরন্তু আমাদের একজন পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন রয়েছে, যিনি আমাদের কী করতে হবে, কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করতে হবে অথবা অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে হবে, তা দেখাতে পারেন। ইমাম আলী (আ.) হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। আর তা হলো, তিনি একজন ডাক্তার, কিন্তু তিনি অসুস্থ মানুষের জন্য অপেক্ষা করেননি; বরং তিনি তাঁর উপায়-উপকরণ সাথে নিয়ে নিজেই তাদের কাছে গিয়েছেন।

طَبِيْبٌ دَوَّرٌ بِطِبِّهِ قَدْ أَحْكَمَ مَرَاهِمَهُ وَ أَحْمَى مَوَاسِمَهُ يَضَعُ حِيْثُ الْحَاجَةُ إِلَيْهِ مِنْ قُلُوْبِ عُمْيٍ وَ آذَانٍ صُمٍّ وَ اَلْسِنَةٍ بُكْمٍ مُتَتَبِّعٌ بِدَوَائِهِ مَوَاضِعَ الْغَفْلَةِ وَ مَوَاطِنَ الْحَيْرَةِ

মহানবী (সা.) একজন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসকের মতো ছিলেন যিনি তাঁর মলম প্রস্তুত রেখেছিলেন এবং যন্ত্রপাতি উত্তপ্ত রেখেছিলেন। যখনই কোন অন্ধ হৃদয়, বধির কান এবং মুক জিহŸার সুস্থতার প্রয়োজন হয়েছে তিনি সেগুলো ব্যবহার করেছেন। তিনি তাঁর ঔষধসহ গাফলতি ও জটিলতার স্থলে উপস্থিত হতেন।’৫

সে সময় এমন মানুষ ছিল যারা বধির, অন্ধ অথবা এমন যারা সত্য বলতে পারত না এবং মহানবী (সা.) তাদেরকে সুস্থ করার জন্য উপযুক্ত ঔষধ ব্যবহার করতেন। আমাদের যুগের নেতা ইমাম মাহদী (আ.)-এরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর যদি আল্লাহ্্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা চান, তাহলে আমরা তাঁর কাছ থেকেও পথনির্দেশনা ও উপশম লাভ করতে পারব।

৩. ভ্রমণ হিসাবে আধ্যাত্মিকতা

ইসলামী সাহিত্যে আধ্যাত্মিকতাকে একটি ভ্রমণ হিসাবেও বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা আমাদেরকে একজন আধ্যাত্মিক ভ্রমণকারী বলে মনে করতে পারি। আমরা সবাই আল্লাহ্্র নিকট থেকে দূরে যাত্রা শুরু করেছিলাম (বি যধাব ধষষ বসনধৎশবফ ড়হ ধ লড়ঁৎহবু ধধিু ভৎড়স এড়ফ) এবং তারপর আমরা আবার তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। আমরা সকলেই আল্লাহ্্ কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছি এবং এই সৃষ্টি আমাদের মূল থেকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। আমরা সৃষ্টির আগে আল্লাহ্্ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম না, কিন্তু এখন আমরা বিচ্ছিন্ন। যা হোক, আল্লাহ্্ আমাদের তাঁর দিকে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছেন। কুরআন বলছে :

الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ

নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্যই এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাগমনকারী।’ (সূরা বাকারা : ১৫৬)

যখন আমরা মৃত্যুবরণ করব, তখন আমাদের গন্তব্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের দিক সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। যদি আমরা সঠিক পথে থাকি, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছব। কিন্তু যদি আমরা ভুল পথে থাকি, তাহলে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারব না এবং তা থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যাব। আসলে আমরা কোন একটি অবস্থানে স্থির নই। প্রতি দিন এবং প্রতি ঘণ্টায় আমরা পথ চলছি এবং আমাদের গন্তব্যের নিকটে যাচ্ছি অথবা দূরে সরে যাচ্ছি। পবিত্র কুরআন বলছে :

يَا أَيُّهَا الْإِنْسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيهِ

হে মানুষ! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট পৌঁছা পর্যন্ত কঠোর সাধনা করে থাক এবং তুমি তার সাক্ষাৎ লাভ করবে।’ (সূরা ইনশিকাক : ৬)

এ আয়াত পাঠে কেউ হয়ত মনে করতে পারে যে, চিন্তিত হওয়ার কোন কিছু নেই, কারণ, আমরা সকলেই একটি ভালো জায়গা থেকে এসেছি এবং সামনে একটি ভালো গন্তব্যস্থল রয়েছে। কিন্তু যখন আমরা আল্লাহ্্র সাথে মিলিত হব তখন আমাদের অবস্থাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ্্র নিকট পৌঁছানোর দু’টি অবস্থা রয়েছে : তাঁর কাছে এমন অবস্থায় পৌঁছানো যখন তিনি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং যখন তিনি আমাদের ওপর রাগান্বিত। মানুষ হলো সেসব অল্পসংখ্যক সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত যাদের পূর্ণতার স্তর স্থির নয়; তাদেরকে নিজেদের অবস্থাকে উন্নীত করা বা অবনমিত করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

সুতরাং, আধ্যাত্মিক সফর গঠিত হয় আমাদের আল্লাহ্্র নৈকট্য বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টার দ্বারা। এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আল্লাহ্্ সবসময় আমাদের নিকট রয়েছেন, কিন্তু আমরা তাঁর কাছাকাছি নই। আমরা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে একটি অবস্থানে পৌঁছতে পারি যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ্্র নিকট থেকে আরও নিকটবর্তী হতে পারি এবং পবিত্র কুরআনের বর্ণনা মতো তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারি। আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা সাধারণভাবে নিজ সত্তাকে আল্লাহতে বিলীন করার কথা বলেন। আমি এখানে এ মতবাদ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করব না। কিন্তু  যে কোন দিক থেকেই এটি নিশ্চিত যে, আমরা আল্লাহ্্র নিকট থেকে নিকটবর্তী হতে পারি এমনভাবে যে, যেখানে তাঁর আর আমাদের মধ্যে কোন কিছুই থাকবে না এবং আমরা আল্লাহ্্র দিকে প্রত্যাবর্তন বলতে এটাই বুঝি।

সুতরাং এ জীবনটা একটা সফর এবং আমরা বলতে পারি না যে, আমরা এ সফরে যেতে চাই না। আমরা সকলেই এ সফরে রয়েছি এবং আমাদের দায়িত্ব হলো অনেক সঞ্চিতি তৈরি করা। আত্মগঠনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো আল্লাহ্র দিকে যাত্রার মাধ্যমে এ দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করা। তাঁর পথে যাত্রা হলো অসীম এবং চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। যা হোক, যারা এ সফরে যাত্রা শুরু করেছে, তাদের জন্য সব ধরনের সমর্থন এবং পথনির্দেশনা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন:

سُبْحَانَكَ مَا اضيق الطرق على من لم تكن دليله و ما اوضح الحق عند من هديته سبيله

আপনি কত পবিত্র! কত সংকীর্ণ পথ তার জন্য যাকে আপনি পথ প্রদর্শন করেন না এবং কত স্পষ্ট একটি পথ তাদের জন্য যাদেরকে আপনি পথ প্রদর্শন করেছেন।’৬

উপসংহার : এ অংশে আমরা আধ্যাত্মিকতাকে অথবা আত্মগঠনকে একটি যুদ্ধ হিসাবে, একটি ঔষধ হিসাবে এবং একটি সফর হিসাবে আলোচনা করেছি। মহান আল্লাহ্্ আমাদের সামনে নানা উপমা উপস্থাপন করে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং পথনির্দেশ করছেন। তিনি আমাদের দেখাচ্ছেন যে, তাঁর নৈকট্য লাভের আশা সবসময়ই রয়েছে এবং তিনি নানাভাবে আমাদেরকে তাঁর নৈকট্য লাভের ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছেন। তিনি পরম ক্ষমাশীল।

মূল: মোহাম্মাদ আলী সোমালী

অনুবাদ : মিকদাদ আহমেদ

তথ্যসূত্র :

১.     আল-কাফি, ৫ম খÐ, পৃ. ১২, নং ৩ এবং শেখ সাদূক সংকলিত আল-আমালি, অধ্যায় ৭১, পৃ. ৩৭৭, নং ৮।

২.     নাহজুল বালাগা,

৩.     নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১৯৩

৪.     তুহাফুল উকূল, পৃ. ২৮৪

৫.     নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১০৭

৬.     মাফাতিহুল জিনান, মুনাজাতে মুরিদীন।

(তেহরান থেকে প্রকাশিত ম্যাসেজ অব সাকালাইন, ভলিউম ১০, নং ৩, অটাম ১৪৩০/২০০৯ থেকে অনুবাদিত।)
 
 
মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: