bayyinaat

Published time: 03 ,December ,2018      11:10:25
মহানবী (সা.) কী নির্ভুল?
মহানবী (সা.) কী নির্ভুল? লেখক: আবুল কাসেম সারাংশ: পবিত্র কোরআন রাসূল (সা.) এর সমগ্র জীবনকে বিশেষত তাঁর নবুওয়াতী জীবনের প্রতি মুহূর্তকে নিঃশর্তভাবে সকল যুগের জন্য ও সর্বাবস্থায় মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করেছে। (সূরা আহযাব:২১) যেহেতু তিনি এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ ভিন্ন কিছু বলতেন না এবং করতেন না, সেহেতু আল্লাহ তাঁকে সকল ক্ষেত্র ও অবস্থায় আদর্শ বলে ঘোষণা করেছেন যা তার নির্ভুলতার অকাট্য এক প্রমাণ।
সংবাদ: 150

মহানবী (সা.) কী নির্ভুল?

লেখক: আবুল কাসেম   মহানবী (সা.) কী নির্ভুল

সারাংশ: পবিত্র কোরআন রাসূল (সা.) এর সমগ্র জীবনকে বিশেষত তাঁর নবুওয়াতী জীবনের প্রতি মুহূর্তকে নিঃশর্তভাবে সকল যুগের জন্য ও সর্বাবস্থায় মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করেছে(সূরা আহযাব:২১) যেহেতু তিনি এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ ভিন্ন কিছু বলতেন না এবং করতেন না, সেহেতু আল্লাহ তাঁকে সকল ক্ষেত্র ও অবস্থায় আদর্শ বলে ঘোষণা করেছেন যা তার নির্ভুলতার অকাট্য এক প্রমাণ

ট্যাগ: মহানবী (সা.), নির্ভুলতা, নিষ্পাপতা, ঐশী নিশ্চিত জ্ঞান, খোদায়ী পৃষ্ঠপোষকতা  

মূল প্রবন্ধ: কোরআন মহানবী (সা.)-এর জ্ঞানগত ও চারিত্রিক মর্যাদাকে সমুন্নতরূপে উপস্থাপন করেছে। মহান আল্লাহ রাসূল (সা.) যে সকল সময় ও সকল অবস্থায় ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ বা সরল সঠিক পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকেন তার নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছেন:

اِنَّكَ عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ 

নিশ্চয় তুমি সরল পথের ওপর (প্রতিষ্ঠিত) আছ।’ (সূরা যুখরূফ : ৪৩)

সূরা ইয়াসীনের শুরুতেও মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের শপথ করে তাঁর রাসূলের সার্বক্ষণিক সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার স্বীকৃতি দিয়েছেন। (সূরা ইয়াসীন : ১-৪) যদি রাসূল (সা.) কোন একটি ক্ষেত্রে অথবা কোন এক মুহূর্তে ভুল করেন তবে সে মুহূর্তে আর ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ এর ওপর থাকবেন না। উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে তাঁর ক্ষেত্রে এরূপ ভুলের সম্ভাবনাকেই সম্পূর্ণরূপে নাকচ করা হয়েছে।

কখনই আল্লাহ কোনরূপ ব্যতিক্রম ছাড়াই রাসূল (সা.)-এর সমগ্র জীবনকে মানবজাতির জন্য সকল (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক) ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন:

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّـهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّـهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّـهَ كَثِيرًا

‘নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে (অনুসরণীয়) উত্তম আদর্শ রয়েছে, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সূরা আহযাব: ২১)

এ আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবির উত্তম আদর্শ হওয়ার নিরঙ্কুশ ঘোষণা থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর রাসূল কোন অবস্থাতেই তাঁর নির্দেশের পরিপন্থী কথা বলেন না ও কাজ করেন নাকেননা, তিনি কোন ক্ষেত্রে ভুল করলে সেক্ষেত্রে তাঁর অনুসরণ মানুষকে ভুলে পতিত করবে। তখন আর তিনি আদর্শ থাকবেন না। সুতরাং আয়াতটিতে তাঁর বিষয়ে এমন ঘটার সম্ভাবনা নেই বলেই তাঁকে নিঃশর্তভাবে আদর্শ ঘোষণা করা হয়েছে।

কোরআনে রাসূল (সা.)-কে সত্য থেকে বিচ্যুত করার জন্য কাফেরদের সর্বাত্মক চেষ্টার বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, এক্ষেত্রে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন:

وَإِن كَادُواْ لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ ٱلَّذِى أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ لِتفْتَرِىَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذاً لاَّتَّخَذُوكَ خَلِيلاً وَلَوْلاَ أَن ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدتَّ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئاً قَلِيلاً

‘আমরা তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ (ওহী অনুযায়ী চলার যে নির্দেশ দান) করেছি তারা তা হতে তোমাকে বিচ্যুত করার নিকটবর্তী হয়েছিল যাতে তুমি তার (প্রত্যাদেশের) পরিবর্তে (তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে) অন্য কিছুকে আমাদের ওপর মিথ্যা আরোপ কর এবং তাহলে তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত। আমরা যদি তোমাকে (নিষ্পাপত্বের বৈশিষ্ট্য দানের মাধ্যমে) দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত না রাখতাম, তবে নিঃসন্দেহে তুমি তাদের দিকে সামান্য কিছু ঝুঁকে পড়ার নিকটবর্তী হতে। (সূরা বনি ইসরাইল: ৭৩-৭৪)

উপরিউক্ত আয়াতদ্বয়ে ওহী মোতাবেক কাজ করার ক্ষেত্রে রাসূলের অবিচলতার মাত্রা তুলে ধরা হযেছে। কারণ, আয়াতে চারটি পর্যায়ের উল্লেখ রয়েছে যা বাহ্যিক কর্মজগতেই শুধু নয়, মনোজগতেও তাঁর জন্য তা ঘটা অসম্ভব গণ্য করা হয়েছে।

যথা :

১.    ركون বা ঝোঁকা

২.    شَيْ ركون কিছু ঝোঁকা

৩.    شَيْ قَلِيل ركون সামান্য কিছু (ইষৎ বা অতি সামান্য) ঝোঁকা

৪.    تَرْكَنُ شَيْئاً قَلِيلاً كِدتَّ বা সামান্য কিছু (ইষৎ) ঝোঁকার নিকটবর্তী হওয়া

আয়াতে আল্লাহ তাঁর থেকে মানসিকভাবেও কোরআনের নির্দেশের পরিপন্থী কোন কর্মের দিকে ঝুঁকে পড়া বা কিছুটা ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনাকেই শুধু বাতিল করেন নি; বরং সামান্য কিছু (অতি সামান্য) ঝোঁকার নিকটবর্তী হওয়াকেও নাকচ করেছেন। অর্থাৎ ঐশী পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে, কোন ক্ষেত্রে ও কোন অবস্থাতেই তাঁর মুখ থেকে কোরআন সমর্থন করে না এমন কোন কথা বের হওয়া ও তাঁর দ্বারা ঐরূপ কোন কর্ম সম্পাদিত হওয়া অসম্ভব।

কেউ কেউ নিম্নোক্ত আয়াতের ভিত্তিতে মহানবী (সা.)-এর নির্ভুলতার বিষয়টি প্রমাণ করতে চেয়েছেন:

এবং সে প্রবৃত্তির বশে (মনগড়া) কোন কথা বলে না, এতো কেবল প্রত্যাদেশ (ওহী), যা (তার প্রতি) প্রত্যাদেশ করা হয়, তাকে মহাশক্তিধর (আল্লাহ) শিক্ষাদান করেন।’ (সূরা নাজম: ৩-৫)

যেহেতু আয়াতটিতে শুধু রাসূল (সা.)-এর নিজের থেকে বা প্রবৃত্তির তাড়নায় কিছু বলার সম্ভাবনাকেই নাকচ করা হয় নি; বরং সেই সাথে তাঁর প্রতিটি কথাকে ‘ওহী’ বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোরআন ও তাঁর অন্যান্য কথার মধ্যে পার্থক্য করা হয় নি অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই তিনি প্রবৃত্তির বশে কথা বলেন না। আর এক মহাশক্তিধর শিক্ষক তাঁকে শিক্ষা দেয়াকে তাঁর সকল কথা ওহী হওয়ার যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আয়াতটিতে যদিও শুধু তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী এরূপ বৈশিষ্ট্যের বলা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে আয়াতটি সূরা ক্বাফ-এর নিম্নোক্ত আয়াতের ন্যায় যেখানে মানুষের সকল কথা ফেরেশতারা লিখে রাখেন বলা হয়েছে; কিন্তু শুধু কথা উদ্দেশ্য নয়; বরং সকল কর্ম ও আচরণকে তা অন্তর্ভুক্ত করে : مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ اِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ অর্থাৎ সে যে কথাই উচ্চারণ করুক না কেন, তার নিকট একজন প্রহরী (তা লিপিবদ্ধ করার জন্য) সদাপ্রস্তুত থাকে। (সূরা ক্বাফ : ১৮) নিঃসন্দেহে ফেরেশতাগণ শুধু ব্যক্তির কথাকে লিপিবদ্ধ করেন না, তার সকল কর্মকে সংরক্ষণ করেন। তাই وَ مَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ اِنْ هُوَ اِلَّ اوَحْيٌ يُوحَىٰ Ñআয়াতে নিঃশর্তভাবে রাসূল (সা.)-এর সকল বাণী ও কর্ম ওহী উৎসারিত বলে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।

অন্য যে আয়াতটিকে রাসূল (সা.)-এর নির্ভুলতার দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা যায় তা হলো সূরা তূরের ৪৮ আয়াত যেখানে আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন : وَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ فَإِنَّكَ بِأَعْيُنِنا ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের হুকুম ও বিধানের (প্রচার ও বাস্তবায়নের) ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ কর। কেননা, তুমি আমাদের (ঐশী) তত্ত্বাবধানে রয়েছ।’Ñ এ আয়াতেও আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তাঁর বাণীÑযা কোরআন ও সুন্নাহর সমম্বয় এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল বিধানকে অন্তর্ভুক্ত করেÑপ্রচার ও বাস্তায়নের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার পরিচয় দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তিনি যেহেতু তাঁর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন বলা হয়েছে, সেহেতু কখনও ভুল করতে পারেন না।

 

মহানবীর নির্ভুলতার উৎস ও কারণ

কোন মানুষই সত্তাগতভাবে নির্ভুল ও মাসুম নয়। যদি কারো মধ্যে নির্ভুলতার বৈশিষ্ট্য থাকে নিঃসন্দেহে তা আল্লাহ প্রদত্ত। একারণেই মহামহিম আল্লাহ যখন তাঁর নবীকে পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন এ বিষয়টিকে স্বীয় রহমত ও করুণার ফলশ্রুতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাই তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন:

وَلَوْلاَ فَضْلُ ٱللَّهِ عَلَيْكَ وَرَحْمَتُهُ لَهَمَّتْ طَّآئِفَةٌ مِّنْهُمْ أَن يُضِلُّوكَ وَمَا يُضِلُّونَ إِلاَّ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَضُرُّونَكَ مِن شَيْءٍ وَأَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَيْكَ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ ٱللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيماً

‘(হে রাসূল!) যদি তোমার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর করুণা না থাকত, তবে (মুনাফিক ও বিশ্বাসঘাতকদের) একদল তোমাকে পথভ্রষ্ট করার দৃঢ় সংকল্প করেছিল; অথচ তারা কেবল নিজেদেরই পথভ্রষ্ট করছে এবং তারা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এবং আল্লাহ তো (দয়া করে) তোমার ওপর নিজ কিতাব (গ্রন্থ) ও প্রজ্ঞা (বিশেষ জ্ঞান) অবতীর্ণ করেছেন এবং যা তুমি জানতে সক্ষম ছিলে না তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর তোমার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ আছে।’ (সূরা নিসা : ১১৩) আয়াতে আল্লাহ চক্রান্তকারীদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও যে রাসূল (সা.)-কে বিচলিত ও তাঁর মর্যাদাকর অবস্থানের কোন ক্ষতি করতে পারে নি তা উল্লেখ করে বলেছেন : وَمَا يُضِلُّونَ إِلاَّ أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَضُرُّونَكَ مِن شَيْءٍ ‘তারা কেবল নিজেদেরই পথভ্রষ্ট করছে এবং তারা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

আয়াতটিতে মহান আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে এমন তিন ধরনের (কিতাব, হিকমত এবং নিজের প্রচেষ্টায় অনর্জনীয়) জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন বলেছেন যে জ্ঞানের কারণে তিনি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভুল করেন না।

উল্লিখিত আয়াতে ‘কিতাব’ বলতে শরীয়তের বিধিবিধান যা মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ নিরসনের জন্য ওহীরূপে প্রেরিত হয়েছে। যেমনটি সূরা বাকারার ২১৩ আয়াতে এভাবে উল্লিখিত হয়েছে: ‘(প্রথমে) সমুদয় মানুষ একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল, পরে (পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হলো), তখন আল্লাহ (মুক্তির) সুসংবাদদাতা এবং (শাস্তির) সতর্ককারীরূপে নবিগণকে প্রেরণ করলেন এবং তাদের সাথে সত্যের প্রতি আহ্বানকারী কিতাব (গ্রন্থ) অবতীর্ণ করলেন; যাতে তার (গ্রন্থ) দ্বারা যেসব ব্যাপারে (মানুষ) মতবিরোধ করেছিল, মীমাংসা করে দেয়।’

আর ‘হিকমত’ বলতে ওহী বর্ণিত এমন ঐশী জ্ঞান যা দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর তা বোঝানো হয়েছে। আর আয়াতে ‘যা তুমি জানতে সক্ষম ছিলে না তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন’ বলতে ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ কোরআন ও হিকমত ভিন্ন অন্য কোন জ্ঞান উদ্দিষ্ট হয়েছে যা তিনি ইলহামের মাধ্যমে মহান আল্লাহ থেকে লাভ করতেন। এ জ্ঞানটি কখনই সাধারণ মানুষের জন্য অর্জনীয়Ñযা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হস্তগত করার যোগ্যÑনয়। সাধারণত এ জ্ঞানটি তিনি কোন বিবাদ মীমাংসা এবং কোন ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নেয়ার সময় ব্যবহার করতেন। কেননা, বিবাদ মীমাংসার জন্য শুধু কোন বিষয়ে কী বিধান জারি হবে তা জানা যথেষ্ট নয়। এর পাশাপাশি সত্যপক্ষ ও মিথ্যাপক্ষ, দাবির ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ও অবিশ্বস্ত, দোষী ও নির্দোষ কে, তা নির্ণয়ের যোগ্যতা থাকতে হবে। 

এ ঐশীপ্রদত্ত জ্ঞানটিই হলো তাঁর নির্ভুলতার রক্ষাকবচ। অর্জনীয় বিভিন্ন জ্ঞান যেমনভাবে প্রবৃত্তির কামনা, ক্রোধ এবং অলীক ধারণা ও কল্পনার বশবর্তী হয় তা এমন নয়। বরং এ জ্ঞানটিই তাঁকে এগুলো থেকে রক্ষা করে। যে অতীন্দ্রিয় সত্তার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.) এ জ্ঞানটি লাভ করতেন পবিত্র কোরআনে তাকে ‘রূহ’ বলে অভিহিত করে বলা হয়েছে:

এরূপে আমরা আমাদের নির্দেশ (এর জগৎ) থেকে তোমার প্রতি রূহ প্রেরণ করেছি; তুমি নিজের থেকে অবগত (জানতে সক্ষম) ছিলে না, গ্রন্থ কী এবং ঈমান কী?’ (সূরা শূরা : ৫২)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা রূহকে রাসূলের জন্য শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যেমনভাবে সূরা আম্বিয়ার ৭৩ আয়াতে আল্লাহর মনোনীত ইমামদের প্রতি উত্তম কর্ম ওহী হতো  (وَ اَوْحَيْنا اِلَيهِم فِعلَ الْخَيْراتِ)  বলা হয়েছে। এ আয়াতে বলা হয় নি যে, وَ اَوْحَيْنا اِلَيهِم ان یفعل الْخَيْراتِ (অর্থাৎ তাদের প্রতি ওহী করেছিলাম যেন তারা উত্তম কর্মসমূহ সম্পাদন করে) বরং বলা হয়েছে : তাদের প্রতি উত্তম কর্মসমূহ ওহী করেছি। এ দুই উক্তির মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। কারণ, প্রথমটি থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর মনোনীত ইমামরা যা করেন তা-ই কল্যাণ অর্থাৎ তাঁদের থেকে কল্যাণ ব্যতীত কিছুই উৎসারিত হয় না এজন্য যে, তাঁদের কর্ম ঐশীভাবে সমর্থিত। অন্যভাবে বলা যায়, আয়াতটিতে আল্লাহ তাঁদের থেকে সম্পাদিত কর্ম ওহী মোতাবেক হতো বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন বা তাঁদের কর্ম যে পূর্ণরূপেই শরীয়ত-সমর্থিত ওহী দ্বারা তা ঘোষণা করেছেন। এজন্যই আল্লাহ পরবর্তী আয়াতে তাঁরা যে পূর্ব থেকেই তাঁর ইবাদতকারী ছিলেন ও তাঁদের ওপর আরোপিত শরীয়তের নির্দেশ পালন করতেন তার প্রতি ইশারা করে বলেছেন : (کانوا لنا عابدین) ‘তারা কেবল আমাদেরই ইবাদতকারী ছিল।’ (আলমিযান, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবায়ী, আলোচ্য আয়াতের আলোচনা দ্রষ্টব্য)

সুতরাং এ আয়াতে যে ওহীর কথা বলা হয়েছে তা শরীয়ত পালনের নির্দেশ দিয়ে নয়; বরং এখানে ওহী তাঁদের উত্তম কর্মের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং এ কারণেই সবসময় তাঁদের থেকে উত্তম কর্ম উৎসারিত হয় তা বলা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্য ও উক্তি (وَ اَوْحَيْنا اِلَيهِم ان یفعل الْخَيْرٰتِ অর্থাৎ তাঁদের প্রতি ওহী করেছিলাম যেন উত্তম কর্ম সম্পাদন করে) থেকে বোঝা যায় যে, তাঁদের প্রতি উত্তম কর্ম সম্পাদনের ওহী হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তাঁরা তা সম্পাদন করেছেন কিনা তা উহ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষও শামিল যে, তাদের প্রতিও উত্তম কর্মের আদেশ পৌঁছেছেÑ এখন তারা সম্পাদন করুক বা না করুক। তাই আল্লাহর মনোনীত ইমামদের সাথে সাধারণ মানুষের পার্থক্য নির্দেশ করতেই বলা হয়েছে যে, তাঁরা পবিত্র আত্মা বা রূহুল কুদ্স দ্বারা সমর্থিত যা তাঁদের অন্তরের মধ্য থেকে উত্তম কর্ম সম্পাদনের আহ্বান জানায় ও তাঁদেরকে সেদিকে পরিচালিত করে। এই পবিত্র আত্মার মাধ্যমে তাঁরা আল্লাহ থেকে বাতেনিভাবে হেদায়াতপ্রাপ্ত হন। তা-ই তাঁদেরকে আল্লাহর থেকে উদাসীন হওয়া থেকে বিরত রাখে। (আলমিযান, সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবায়ী, আলোচ্য আয়াতের আলোচনা দ্রষ্টব্য)

এজন্যই আল্লাহ হেদায়াতের সকল দিক ও ক্ষেত্রে তাঁর নবীর নিরঙ্কুশ সঠিকতার গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন:

নিঃসন্দেহে তুমি সরল পথ প্রদর্শন কর।’ (সূরা শূরা: ৫২)

নৈতিকভাবেও রাসূল (সা.) এমন এক সুমহান চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেনوَاِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ  (সূরা কালাম: ৪) যে, স্বয়ং আল্লাহ তাঁর জীবনের ওপর কসম করেছেন: لَعَمْرُكَ (সূরা হিজর: ৭২)

এরূপ মহান মর্যাদার কারণেই আল্লাহ স্বীয় নামের পাশে অসংখ্যবার তাঁর নবীর উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর আনুগত্যকে নিজের আনুগত্য (সূরা নিসা: ৮০) এবং তাঁর নির্দেশের বিরোধিতাকে নিজের বিরোধিতা বলে ঘোষণা করেছেন। (সূরা আহযাব: ৩৬)

এছাড়া অনেক আয়াতে তিনি তাঁর আনুগত্যের পাশাপাশি তাঁর রাসূলের আনুগত্যকে নিঃশর্তভাবে ফরয করেছেন।  কখনই আল্লাহ তা‘আলা ভুল-ভ্রান্তির শিকার হতে পারে এবং তাঁর নির্দেশের পরিপন্থী কোন হুকুম -তা যে কোন বিষয়েই হোক- দিতে পারে এমন ব্যক্তির নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ দিতে পারেন না। কারণ, সেক্ষেত্রে তাঁর বান্দারা পাপে পতিত হবে এবং আল্লাহর এ উদ্দেশ্য যে, বান্দারা পুণ্যকর্মের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করবে ও তাদের বিকাশ ও পূর্ণতায় পৌঁছবে, সে লক্ষ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। বরং এ নবীর নিঃশর্ত অনুসরণ যেহেতু তাঁর বান্দাদের অবধারিতভাবে তাঁর নৈকট্য দান করে সেহেতু তিনি তাঁর অনুসরণকে তাঁর প্রতি ভালোবাসার দাবি প্রমাণের অনিবার্য শর্ত হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন :

তুমি বল: ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে তোমরা আমার অনুসরণ কর, আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সূরা আলে ইমরান: ৩১)

এ আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথা, কর্ম ও আচরণ আল্লাহর ইচ্ছারই প্রতিফলন বৈ নয়। যেখানে আল্লাহ মুমিনদের তাদের পারস্পরিক মতবিরোধের বিষয়ে তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সেখানেও তাঁর মীমাংসাকে নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তের সামনে পূর্ণ আত্মসমর্পণের আদেশ জারি করেছেন ও মন থেকে তা গ্রহণ না করাকে ঈমানহীনতার প্রকাশ বলে গণ্য করেছেন। (সূরা নিসা : ৬৫)

এ বিষয়গুলো তাঁর নির্ভুলতার সাক্ষ্য হওয়া ছাড়াও আল্লাহর নিকট তাঁর মহান মর্যাদার প্রমাণ বহন করে।

পরিশেষে দ্বীনের জ্ঞানের বিষয়ে আল্লাহ তাঁকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে বলেছেন :

রাসূল (সা.) যা কিছু তোমাদের জন্য এনেছেন (নির্দ্বিধায়) তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। (সূরা হাশ্র: ৭)

এ আয়াতের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) যা কিছু বলবেন, করবেন এবং তাঁর থেকে প্রকাশিত হবে, তা নির্ভুল ও কোরআনের আয়াতের মতোই প্রামাণ্য। আর এ নির্ভুলতার কারণেই তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ নির্দ্বিধায় সেনে নিতে হবে।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন, এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীনের অনেক বিষয়ে রাসূলকে বিধান প্রণয়নের অনুমতি দান করা হয়েছে।  রাসূল (সা.) কর্তৃক যোহর, আসর ও এশার দু’রাকআত ফরয নামাযের সাথে অতিরিক্ত দুই রাকআত ও মাগরিবের নামাযের সাথে অতিরিক্ত এক রাকআত নামায সংযোজন এ অনুমতির পরিপ্রেক্ষিতেই ছিল। যেহেতু তাঁর এ সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হয়েছে সেহেতু তিনিই তা সমর্থন করেছেন। (কুলাইনী, উসূলে কাফি, ১ম খ-, পৃ. ১৩৮৮, হাদিস ৩৬৬৯)

পূর্ববর্তী নবীদের কারো কারো ক্ষেত্রে আল্লাহ এরূপ অনুমতি দিয়েছেন। যেমন, হযরত ইয়াকুব (আ.) যা নিজের জন্য হারাম করে নিয়েছিলেন, আল্লাহ বনি ইসরাইলের জন্যও তা হারাম ঘোষণা করে বলেছেন:

তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে ইসরাইল (ইয়াকুব) যা কিছু নিজের ওপর নিষিদ্ধ করে নিয়েছিল সেসব ব্যতীত বনি ইসরাইলের জন্য সব খাদ্য বৈধ ছিল।’ (সূরা আলে ইমরান: ৯৩)[i]

নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর নিকট হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর উচ্চ মর্যাদার কারণেই এরূপ করা হয়েছিল। মহানবী (সা.) মহাস্রষ্টার নিকট বিশেষ প্রশংসনীয় মর্যাদার অধিকারী যার ঘোষণা পবিত্র কোরআনে তিনি এভাবে দিয়েছেন :

অচিরেই তোমার প্রতিপালক (এরূপে) তোমাকে বিশেষ প্রশংসিত (মর্যাদার) স্থানে পৌঁছে দেবেন।’ (বনি ইসরাইল: ৭৯)

مَّحْمُود বা প্রশংসিত হওয়া মহান আল্লাহর একটি বিশেষ গুণ। কারণ, সমগ্র সৃষ্টিজগৎ তাঁরই প্রশংসা করে। তাঁর রাসূলের (সা.) প্রতিও তিনি এতটা সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, তিনি চেয়েছেন তাঁর ফেরেশতা ও অন্যান্য সৃষ্টির নিকট তাঁর এ প্রিয় বান্দাও প্রশংসিত গণ্য হোক। আর এ মর্যাদার স্থানকেই তিনি তাঁর গ্রন্থে ‘মাকামে মাহমুদ’ বা ‘প্রশংসিত (মর্যাদার) স্থান’ বলে উল্লেখ করেছেন। বন্দেগি ও দাসত্বের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছার বদৌলতেই তিনি আল্লাহর নিকট এ মর্যাদাকর অবস্থান লাভ করেছেন। আর তাঁর পথে মহানবী (সা.)-এর নির্ভুল কর্ম ও আচরণই তার এ দাসত্বকে পূর্ণতা দিয়েছে এবং তাঁকে আল্লাহর নিরঙ্কুশ সন্তুষ্টির পাত্র করেছে। এজন্যই তিনি তাঁর এ হাবিব ও বন্ধুর সন্তুষ্টিকে নিজের জন্য আবশ্যিক ঘোষণা করে বলেছেন : ‘এবং তোমার প্রতিপালক তোমাকে এতটা দান করবেন যাতে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।’ (সূরা আদ দ্বুহা : ৫)

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে মহানবী (সা.)-এর নিরঙ্কুশ নির্ভুলতা ও নিষ্পাপতার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। দ্বীনি ও পার্থিব সকল বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের (কথা, কর্ম ও আচরণ) নির্ভুলতাও এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।



[i] মহান আল্লাহ যখন কোন নবিকে বিধান প্রণয়নের অনুমতি দেন অবশ্যই তাকে বিধানসমূহ প্রণয়নের পেছনে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এবং যে কল্যাণের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তা প্রণীত হবে সেসম্পর্কে তাকে সম্যক জ্ঞান দান করেন। এ কারণে তারা স্বেচ্ছাচার ও প্রবৃত্তির বশে কোন বিধি প্রণয়ন করেন না। তাই নবিগণ এবং আল্লাহ মনোনীত তাদের স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত অন্য কারো এমন করার অনুমতি নেই। সূরা নাহলের ১১৬ আয়াতের ভিত্তিতে কেউ এরূপ করলে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপের অপরাধে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হবে।

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: