bayyinaat

Published time: 03 ,December ,2018      21:19:57
সাকালাইনের হাদীস মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত
সাকালাইনের হাদীস মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত সারাংশ: অধিকাংশ হাদীস সংকলক সাকালাইনের হাদীসটি তাদের গ্রন্থ সমূহে এনেছেন। এজন্যই এ হাদীসের সূত্র মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌছেছে। নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) তাঁর উম্মতের কল্যাণ ও অকল্যাণের বিষয়ে অন্যদের থেকে অধিক অবগত। স্বয়ং তিনি উম্মতের কল্যাণ ও মুক্তি কোরআন ও তাঁর ইতরাতকে (রক্ত সম্পর্কিত নিকটাত্মীয়) আঁকড়ে ধরার মধ্যে নিহিত বলেছেন।
সংবাদ: 155

সাকালাইনের হাদীস মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত      

 সাকালাইনের হাদীস মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত

সারাংশ: অধিকাংশ হাদীস সংকলক সাকালাইনের হাদীসটি তাদের গ্রন্থ সমূহে এনেছেন। এজন্যই এ হাদীসের সূত্র মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌছেছে নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) তাঁর উম্মতের কল্যাণ ও অকল্যাণের বিষয়ে অন্যদের থেকে অধিক অবগত। স্বয়ং তিনি উম্মতের কল্যাণ ও মুক্তি কোরআন ও তাঁর ইতরাতকে (রক্ত সম্পর্কিত নিকটাত্মীয়) আঁকড়ে ধরার মধ্যে নিহিত বলেছেন।

ট্যাগ: সাকালাইনের হাদীস, মুতাওয়াতির হাদীস, সহীহ হাদীস,

প্রবন্ধ: হাদীস সংকলকরা সাকালাইনের হাদীসটি অনেক সূত্রে তাদের গ্রন্থ সমূহে এনেছেন। মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে মহানবী (সা.) এর গাদীরে খুমের হাদীসটির একাংশ যাইদ ইবনে আরকামের সূত্রে (খণ্ডিত ভাবে) বর্ণনা করেছেনতাতে উল্লেখ করেছে যে, মহানবী (সা.) বলেছেন:

و انا تارک فيکم کتاب الله الهدي و النور فخروا بکتاب الله واستمسکوا به... و اهل بيتي اذکرهم الله في اهل بيتي

আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান ও ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব যাতে হেদায়েত ও নূর রয়েছে। (অত:পর তিনি মানুষকে কোরআনকে আঁকড়ে ধরতে উৎসাহিত করেন)... এবং  আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে আমি তোমাদের আল্লাহকে স্মরণ করাচ্ছি।১

তিরমিযীও যাইদ ইবনে আরকাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন: আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি ভারী ও মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছিযদি তোমরা এই দু’টিকে আঁকড়ে ধর কখনই বিভ্রান্ত হবে না। তাদের একটি অপরটি থেকে বড়আল্লাহর কিতাব যা আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত ঝুলন্ত ও প্রসারিত রয়েছে এবং আমার বংশধর আহলে বাইত। এ দু’টি একে অপর থেকে পৃথক হবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত না আমার সাথে হাউজে কাওসারে মিলিত হবে। সুতরাং লক্ষ্য রেখ, কিভাবে আমার আহলে বাইতের সাথে আচরণ করবে।২

আহমাদ ইবনে হাম্বাল, আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণনা করছেনে যে, মহানবী (সা.) বলেছেন: নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে দুইটি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব আমার বংশধর আহলে বাইত এদুটি হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না

আবু সাঈদ খুজরী থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে নবী (সা.) বলেছেন: অতি শীঘ্রই আমাকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) ডাকা হবে এবং আমি তাতে সাড়া দিব আর আমি তোমাদের মাঝে দুটি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব আমার বংশধ আমার আহলে বাইত নিশ্চয় সুক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞাত আমাকে জানিয়েছেন দুটি আমার সাথে হাউজে কাওসার মিলিত হওয়া পর্যন্ত একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না সুতরাং লক্ষ্য রেখ দুয়ের ব্যাপারে আমার পর তোমরা কিরূপ আচরণ করবে

বাগাভী তারমাসাবিহুস সুন্নাহ গ্রন্থে এবং কাজী আয়াজ তার আশশিফা’৬ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন

খতিব বাগদাদী, হুজাইফা ইবনে উসাইদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) বলেন: হে লোকসকল! আম তোমাদের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করব (অথবা হাউজে পৌছাব) আর তোমরা হাউজের নিকট আমার সাথে মিলিত হবে যখন তোমরা আমার নিকট আসবে তখন আমি তোমাদের সাকালাইন (দুই মূল্যবান বস্তু) সম্পর্কে প্রশ্ন করব সুতরাং ভালভাবে খেয়াল রেখ যে, দুয়ের সাথে কিরূপ আচরণ করবে বড় য়াকাল (মূল্যবান বস্তু) হল আল্লাহর কিতাব যা একটি রশি যার এক প্রান্ত রয়েছে আল্লাহর হাতে, আর অপর প্রান্ত রয়েছে তোমাদের হাতে সুতরাং তা আঁকড়ে ধর

হাকিম তার মুসতাদরাক গ্রন্থে বর্ণনাটি যাইদ ইবনে আরকাম সূত্রে বর্ণনা করেছেন আল্লামা সুয়ুতী হাদীসটি তিনটি (যাইদ ইবনে আরকাম, যাইদ ইবনে সাবতি আবু সাইদ খুজরী) সূত্রে, হারামাইনের ফকীহ মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ শাফেয়ী তাঁর কিফায়াতুত তালিব’১০ গ্রন্থ এবং মুহিব্বুদ্দীন তাবারী তার যাখায়ের১১ গ্রন্থে হাদীসটি যাইদ ইবনে আরকাম সূত্রে বর্ণনা করেছেন

ইবনে হাজার তার আস সাওয়ায়েকুল মুহরিকা গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনাধারায় তা উল্লেখ করেছেন অতঃপর বলেছেন: হাদীসটি বিশের অধিক সাহাবা থেকে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে১২ শেখ আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ শাবরাভী তারআল ইতহাফ বিহুব্বিল আশরাফ১৩ গ্রন্থে এবং সুয়তী তার ইহইয়াউল মাইয়েত বিফাজায়িলী আহলি বাইত গ্রন্থে যাআল ইতহাফ১৪ গ্রন্থের টীকায় ছাপা হয়েছে শেখ আদভী তারমাশারিকুল আনওয়ারগ্রন্থের ফাজায়েলু আহলিল বাইত সম্পর্কিত আলোচনায় তা এনেছেন১৫ আল্লামা সাইয়েদ খাইরুদ্দীন আবিল বারাকাত নেমান আফেন্দী আলুসী তারগালিয়াতুল মাওয়ায়িজ১৬ গ্রন্থে হাদীসটি বিভিন্ন বর্ণনাধারায় উল্লেখ করেছেন

ইবনে হাজার তারশারহুল হামজিয়াগ্রন্থে আলে মুহাম্মাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: আমার প্রাণ যার হাতে নিবদ্ধ তার শপথ, আল্লাহর কোন বান্দা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না যতক্ষণ না আমার প্রতি ভালবাসা পোষণ করে আর কেউ আমার রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা পোষণ ব্যতীত আমাকে ভালবাসতে পারে না যে তাদের সাথে যুদ্ধ করে আমিও তাদের সাথে যুদ্ধ করি আর যে তাদের সাথে সন্ধি স্থাপন করে আমিও তার সাথে সন্ধি স্থাপন করি যে তাদের সাথে শত্রুতা করে আমিও তাদের সাথে শত্রুতা করি জেনে রাখ, যে আমার নিকটাত্মীয়দের কষ্ট দিল সে আল্লাহকেই কষ্ট দিল অতঃপর তিনি সাকালাইনের হাদীসটি বর্ণনা করে তা যে রাসুল (সা.)এর আহলে বাইতের জন্য নির্দিষ্ট তা উল্লেখ করেছেন১৭

ইবনে কাসির যাইদ ইবনে আরকাম সূত্রে সাকালাইনের হাদীস ভাবে বর্ণনা করেছেন: একদিন আল্লাহর রাসূল (সা.) মক্কা মদীনার মধ্যবর্তীখুমনামক স্থানে একটি খুতবা দেন প্রথম তিনি আল্লাহর প্রশংসা গুণকীর্তন করেন অতঃপর জনসাধারণকে উপদেশ দিয়ে বলেন: পর সমাচার, জেনে রাখ হে লোক সকল! নিশ্চয় আমি মানুষ অচিরেই আমার প্রভুর প্রেরিত দূত আমার কাছে আসবে আমি তার আহবানে সাড়া দিব আর আমি তোমাদের মাঝে দুটি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব যা হিদায়াত নূর সুতরাং আল্লাহর কিতাবকে ধারণ কর এবং দৃঢ়ভাবে তার সাথে সংযুক্ত হও অতঃপর তিনি জনতাকে কোরআনের বিষয়ে উৎসাহিত করলেন এরপর বললেন: আমার আহলে বাইত আমার আহলে বাইতের বিষয়ে আমি তোমাদের আল্লাহকে স্মরণ করাচ্ছি পুনরায় আমি আমার আহলে বাইতের বিষয়ে আল্লাহকে স্মরণ করাচ্ছি আর আমার আহলে বাইতের সম্পর্কে আমি তোমাদের আল্লাহকে স্মরণ করাচ্ছি১৮

শেখ আব্দুর রহমান নাকশবান্দী তারআল ইকদুল ওয়াহিদগ্রন্থে আহলে বাইতকে স্মরণ করে বলেন: তাঁরা হলেন আমাদের ধর্মের তারকা, আমাদের শরীয়তের উৎস এবং সাহাবাদের মধ্যে দৃঢ় স্তম্ভ স্বরূপ ইসলাম তাদের মধ্যে আবির্ভূত প্রকাশিত হয়েছে ইসলামের ভিত্তি তাদের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত বস্তার লাভ করেছে একারণেই মহানবী (সা.) বলেছেন: নিশ্চয় আমি তোমাদের মধ্যে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি যা তোমরা আঁকড়ে ধরলে কখনও বিপথগামী হবে না : আল্লাহর কিতাব আমার বংশধর আহলে বাইত সুতরাং লক্ষ্য রেখ আমার পর কিভাবে দুয়ের সাথে আচরণ করবে তিনি আরো বলেন: দরুদ সালাম পড়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় সাওয়াব লাভে সন্তুষ্ট হতে চায় যে যেন বলে: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলিহী ইমাম শাফেয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নামাজের শেষ রাকাতের তাশাহুদের শেষে দরুদ পাড়া ওয়াজিব তাঁর থেকে নিম্নোক্ত কবিতাটি বর্ণিত হয়েছে

يا آل بيت رسول الله حبکم

فرض من الله في القران انزله

کفي کم من عظيم القدرانکمگ

من لم يصل عليکم لا صلاة له

হে আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইত আপনাদের প্রতি ভালোবাসাকে আল্লাহ কোরআনে ফরজ করেছেন।আপনাদের মর্যাদার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, আপনাদের ওপর যদি দরূদ পাড়া না হয় তবে নামাজই বাতিল হয়ে যাবে।১৯

‘আলমুসলিম’ পত্রিকায় এসেছে: আহলে বাইত হলেন ইসলামের প্রহরী ও রক্ষক এবং মহত্ব ও গর্বের অধিকারী... (কিন্তু) আহলে বাইত সর্ব প্রকার বিদ্রূপ ও কষ্টের শিকার এবং শত্রুদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। এমনকি ইতিহাসের সকল পর্যায়ে -ইমাম আলী (আ.)এর যুগ থেকেই তারা চেষ্টা চালিয়েছে তাঁদের মর্যাদাকর অবস্থানকে সম্পূর্ণ রূপে মুছে ফেলতে। তাঁদের শত্রুরা তাঁদের পিতামহ রাসুলুল্লাহ (সা.)এর ওপর যে ধর্মকে (তাদের নিজেদের ধারণায় সঠিক) আরোপ করেছিল তার ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ইতিহাস এ ক্ষেত্রে তিক্ত অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। আহলে বাইতের প্রতি এতটা জুলুম করা হয়েছে এমনকি তাদের বংশকে নির্মূল তাদের ভূমিসমূহ ও অধিকারভুক্ত সম্পদসমূহ থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এরূপ কত যে কষ্ট ও নির্যাতন তাদের ওপর চালানো হয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহ তা জানেন। অথচ এসকল অত্যাচার নিপীড়ন ইসলামের নামে করা হয়েছে (ও হচ্ছে)। এ ক্ষেত্রে তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং এতটা নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছে যে, তাঁদের প্রতি রূঢ়তা অসৌজন্যতা,২০ অধার্মিকতা ও গোপন বিদ্বেষ দেখিয়েছে। আর এ কাজগুলি তারা সুন্নাতের পুনরুজ্জীবনের নামে এমন গ্রন্থ সমূহ রচনা করে সম্পাদন করেছে এবং তাতে তারা আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইতের সদস্য ও পবিত্র ইমামগণের প্রতি অবমাননা করেছে।২১

আরবি অভিধান গ্রন্থ ‘কামুস’-এ বর্ণিত হয়েছে: "النقل" বা ‘সিকাল’ শব্দের পঠন রূপ "عنب" এর ন্যায়। ‘সিকাল’ শব্দটির অর্থ ভারী যা ‘হালকা’ শব্দের বিপরীত। এজন্য মুসাফিরের বোঝা ও গৃহের সরঞ্জামকে ‘সাকাল’ বলা হয়। তেমনি কোন সংরক্ষিত মূল্যবান বস্তুকেও সাকাল বলা হয়। হাদীসে যখন বলা হয়েছে: اني تارک فيکم الثقلين کتاب الله و عترتي তখন তা এ দু’টি বস্তুর মূল্যকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।২২

মুহিব্বুদ্দীন এ হাদীসটির "نقل” শব্দটির মূল কি তা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন: তাদের উচ্চ মর্যাদা ও মহান অবস্থানকে ইঙ্গিত করতে "نقل” বলা হয়েছে। সা’লাব বলেন: কোরআন ও ইতরাতকে "نقل” বলা হয়েছে এজন্য যে এ দু’টিকে আঁকড়ে ধরা এবং তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন অত্যন্ত ভারী বিষয়।২৩ আবাহারী বলেন: শারিক, রাকিন থেকে, তিনি কাসিম থেকে, তিনি হাস্সান থেকে, তিনি যাইদ ইবনে সাবিত থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন: اني تارک فيکم الثقلين کتاب الله و عترتي اهل البيت এ হাদীসে আহলে বাইত বলতে রাসূল (সা.) নিজের বংশধরদের বুঝিয়েছেন। আবুল আব্বাস, ইবনুল আরাবি থেকে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন: ব্যক্তির বংশ হল তার বংশধর ও সন্তান-সন্ততিরাসুতরাং রাসুল (সা.)এর ইতরাত হলেন ফাতিমা বাতুল (আ.)এর সন্তানগণ।২৪

ইবনে আবু মানযুর বর্ণনা করেছেন: মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তার জীবনের শেষ দিকে বলেন: اني تارک فيکم الثقلين کتاب الله و عترتي অতঃপর তিনি স’লাবের বক্তব্যটি বর্ণনা করে বলেন: "نقل” শব্দটির উৎপত্তি এভাবে ঘটেছে যে আরবরা যে কোন মূল্যবান ও সংরক্ষিত বস্তুকে "نقل” বলে। সুতরাং [মহানবী (সা.)}] এ দু’টি বস্তুকে "نقل” বলেছেন যাতে করে উত্তম ঐ দু’টিকে সম্মান করে এবং তাদের মর্যাদাকে রক্ষা করে। তেমনি যে কোন সম্মানিত ও পছন্দের ব্যক্তিকেও ‘সাকাল’ বলা হয়...।২৫

ইবনে আসিরও উল্লিখিত হাদীসটি বর্ণনার পর বলেন: রাসূল (সা.) এ দু’টিকে "نقل” বলেছেন কারণ এ দু’টিকে আঁকড়ে ধরা ও এ অনুযায়ী আমল করা অত্যন্ত ভারী (কঠিন) বিষয়। তেমনি যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বস্তুকেও "نقل” বলা হয়।২৬ ‘আলমিসবাহুল মুনির’ গ্রন্থে বলা হয়েছে ‘ইতরাত’ হল ব্যক্তির বংশধর। আজহারী বলেছেন স’লাব, ইবনুল আরাবি থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ব্যক্তির ইতরাত হল তার বংশধর, সন্তান ও সন্ততি। আরবরবুঝো ইতরাত বলতে এর বাইরের কিছু বুঝে না।২৭

সাইয়েদ মুহাম্মাদ সিদ্দিক হাসান বুখারী তার ‘আদদীনুল খালিস’ গ্রন্থে এ হাদীসটি যাইদ ইবনে আরকাম সূত্রে বর্ণনার পর বলেছেন: এ হাদীসটিতে আহলে বাইতের ফজিলত (মর্যাদা) এবং ইসলামে তাদের মহান অধিকারের কথা বলা হয়েছে যেমন তাঁরা মর্যাদা ও সম্মানের ক্ষেত্রে কোরআনের সমকক্ষ (কোরআনের ন্যায় মর্যাদা ও সম্মান পাওয়ার যোগ্য)আর এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল (সা.)এর পর অন্য কারো কথা বলার অধিকার নেই কারণ তাঁর কথাই চূড়ান্ত... আমার দৃষ্টিতে ‘আহলে বাইত’ শব্দটি সর্ব প্রথম তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যারা নবুওয়াতের সমকালে ছিলেন। কিন্তু তাঁর (মৃত্যুর) পর এ পরিভাষাটি যে সকল ব্যক্তি জ্ঞান ও ঈমানের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন, তাদের মধ্যে তাঁর বংশের বার ইমামও অন্তর্ভুক্ত হবেন। অতঃপর  তিনি বলেন: এ হাদীসে বর্ণিত আহলে বাইত শব্দটি বিশেষ ভাবে মহানবী (সা.)এর পবিত্র বংশধারা ও সন্তান-সন্ততিদের বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর স্ত্রীদের বুঝাতে নয়।২৮

যদি আমরা চাই একটি একটি করে এ হাদীসের বিষয় বস্তু পর্যালোচনা করে এ সম্পর্কিত আলোচনা চালিয়ে যেতে তবে গ্রন্থের কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই হাদীসটির সূত্র ও বর্ণনাধারার কয়েকটির উল্লেখ করেই এ আলোচনার সমাপ্তি টানছি। হাদীসের হাফিজ মুহাম্মাদ ইবনে তাহের ইবনে আলী (কাইসারানী নামে প্রসিদ্ধ) এ হাদীসটির বিভিন্ন বর্ণনাধারার উল্লেখ করে বলেছেন: সাতাশ জন সাহাবী থেকে এটা বর্ণিত হয়েছে।২৯

এখানে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি তা হল হাদীস বিবৃত কারীদের অপতৎপরতা এখনও বন্ধ হয়নি। সকল যুগেই তারা প্রচেষ্টা চালিয়েছে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যা রচনা করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে। বিকৃতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে অপরাধযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তা হল ‘কিতাবুল্লাহ ও ইতরাতি’ শব্দ দু’টির স্থানে ‘কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতি’৩০ নামে হাদীস জাল করা হয়েছে। এভাবে তারা চেয়েছে হাদীসের অর্থকে বিকৃত করতে। অথচ মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসে সাকালাইনে কোরআন ও ইতরাতকে পাশাপাশি স্থান দেয়ার মাধ্যমে (এবং দু’টিকেই ভারী ও মূল্যবান বস্তু আখ্যায়িত করে) তাদের উভয়কে আঁকড়ে ধরতে ও তদনুযায়ী আমল করতে বলা হয়েছে। কারণ এ দু’টিই কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান থাকবে। শরীফ সামহুদী বলেছেন: এ হাদীস থেকে বোঝা যায় পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মহানবী (সা.)এর বংশধরের মধ্যে (এমন) এক ব্যক্তি অবশ্যই থাকবেন (যাতে তাঁকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে নিরাপদ থাকা যায়) নতুবা উম্মতকে তিনি যে কোরআন ও ইতরাত উভয়কে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন তা বাস্তবরূপ লাভ করবে না এবং এ নির্দেশ অর্থহীন হয়ে পড়বে। (যেমনি ভাবে কোরআন পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে)। একারণেই বলা হয়েছে আহলে বাইত হলেন পৃথিবীর নিরাপত্তা যদি তারা না থাকেন পৃথিবী বাসী ধ্বংস হয়ে যাবে।২৯

শেখ যারকানী আলোচ্য হাদীসটি ব্যাখ্যা করার পর বলেছেন: কোরআন এজন্য গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা লাভ করেছে যে, তা ধর্মীয় জ্ঞান ও শিক্ষা, ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধান এবং বিশ্বের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য জগতের বাস্তবতা ও রহস্যকে ধারণ করছে। মহানবী (সা.) এর আহলে বাইতও এ দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বের অধিকারী যে যখন কোম সত্তা পবিত্র হয় তা ধর্মীয় বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। মানুষের সত্তার পবিত্রতা তাকে সুন্দর বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রে সজ্জিত করে। আর সুন্দর চরিত্র আত্মিক পরিশুদ্ধতা ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত থাকার গুণে পর্যবসিত হয়। মহানবী (সা.) তাঁর অসিয়তে (শেষ উপদেশে) এ বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন: "সুতরাং লক্ষ্য রেখ আমার (মৃত্যুর) পর এ দু’য়ের সাথে আচরণের বিষয়ে। (কারণ আমি হাউজে তোমাদের প্রশ্ন করব ও দেখব যে,) তোমরা কি এ দু’য়ের ব্যাপারে আমার নির্দেশ পালন করে আমাকে সন্তুষ্ট করেছো, না কি আমাকে কষ্ট দিয়েছো?”

নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) তাঁর উম্মতের কল্যাণ ও অকল্যাণের বিষয়ে অন্যদের থেকে অধিক অবগত। আর তিনি উম্মতের কল্যাণ ও মুক্তি কোরআন ও ইতরাতকে আঁকড়ে ধরার মধ্যেই দেখেছেন। সুতরাং তাঁর দৃষ্টিতে তাদের সৌভাগ্যও সফলতা এ দু’য়ের অনুসরণের মধ্যেই নিহিত। এ কারণেই তিনি বিভিন্ন পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটে আহলে বাইতের অনুসরণের বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং তাঁদেরকে জনগণের নেতৃত্বের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে পরিচিত ও উপস্থাপন করেছেন। এর ভিত্তিতেই তিনি তাদের নুহ (আ.)এর তরণীর সাথে তুলনা করেছেন। অবুজর গিফারী বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সা.) কাবাঘরের দরজা ধরে বলেছেন:

مثل اهل بيتي فيکم مثل سفينة نوح من رکبها نجا و من تخلف عنها غرق

আমার আহলে বাইতের দৃষ্টান্ত তোমাদের মাঝে নুহ (আ.)এর নৌকার ন্যায়। যে তাতে আরোহণ করবে মুক্তি পাবে আর যে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে যে নিমজ্জিত হবে।

আহমাদ ইবনে হাম্বাল,৩১ হাকিম নিশাবুরী ও অন্য হাদীস সংকলকগণ এ হাদীসটি তাদের গ্রন্থে এনেছেন। তাবরানী আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা.) বলেছেন: নিশ্চয় আমার আহলে বাইত তোমাদের মধ্যে বনি ইসরাইলের বাবুল হিত্তাহ (ক্ষমার দ্বার) এর ন্যায়। যে কেউ তাতে প্রবেশ করবে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে।৩২

সহীহ সূত্রে বর্ণিত এরূপ হাদীসের সংখ্যা এত অধিক যে, বিশ্ববাসীর কর্ণ তাতে পূর্ণ হয়েছে এবং বংশপরম্পরায় তা বর্ণিত হয়েছে। হাদীসবিদ ও আলেমগণের মুখে মুখে তা প্রচারিত হয়েছে। এ সকল বিষয় আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরা ও তাঁদের অনুসরণের অপরিহার্যতাকে (ফরয হওয়াকে) প্রমাণ করে। (কারণ) এ বংশ মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করে, তাদেরকে সত্যপথে পরিচালিত করে এবং তাদের পূর্ণতা দানকারী হিসাবে তাদের ওপর দায়িত্বশীল নেতা

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যদি মুসলমানদের স্বাধীন ভাবে তাদের মত ব্যক্ত করতে দেয়া হয় এভাবে যে, তারা শাসকগোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কোনরূপ ভয়-ভীতি ও হুমকির আশঙ্কা ছাড়া নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে ও মুসলিম সমাজের সৌভাগ্য এবং সর্বজনীন কল্যাণকে নিজেরাই বেছে নেয়ার অধিকার প্রাপ্ত হবে। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় তারা আল্লাহর রাসূল (সা.)এর আহলে বাইত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে না। বরং তারা এ ক্ষেত্রে তাঁর অসিয়তকে পূর্ণরূপে মেনে নিয়ে বাস্তবায়ন করত। যেহেতু খেলাফতের জন্য প্রয়োজনীয় সকল যোগ্যতা পূর্ণরূপে কেবলমাত্র এ বংশের মধ্যেই সমবেত হয়েছে এবং তাঁরা শাসন কর্তৃত্ব এবং হেদায়াতের সকল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সেহেতু কেউই তাদের ভুল ধরতে ও ত্রুটি বের করতে সক্ষম নয় এমনকি তাদের সাঙ্গে যুদ্ধরত শত্রুরাও (অপবাদ ও মিথ্যা অভিযোগ ব্যতীত) তাদের বিরুদ্ধে কোন আপত্তি উত্থাপন করতে পারবে না।

1.    সহীহ মুসলিম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১২২।

2.    সুনানুত তিরমিযী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৮।

3.    মুসনাদে আহমাদ, ২য় খণ্ড, পৃ. প্রথম প্রকাশনা

4.    মাসাবহিুস সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭-২৬

5.    মাসাবহিুস সুন্নাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৪

6.    আশশিফা, কাজী আয়াজ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪০

7.    তারিখে বাগদাদ, খতিব বাগদাদী, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৪৩

8.    আলমুসতাদরাক, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১০৯

9.    আলজামেউস সাগীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৬৩

10. কিফায়াতুত তালব, পৃ. ৫৩

11. যাখায়িরুল ওকবা, মুহিব্বুদ্দীন তাবারী, পৃ. ২৬

12. আসসাওয়ায়িকুল মুহরিকা, আসকালানী, পৃ. ১৩৬

13. আল ইতহাফ বিহুব্বিল আশরাফ, পৃ. ২২

14. আলইতহাফের হাশিয়াতে ছাপা গ্রন্থের বাব হুসনুত তাওয়াসসুল ফি আদাবি যিয়ারাতে আহসানির রাসূল, পৃ. ২৪৭

15. মাশারিকুল আনওয়ার, পৃ. ১৪৬

16. গালিয়াতুল মাওয়ায়িজ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৭

17. আলমানাহুল মাক্কিয়া ফি শারহলি হামজিয়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৫৪

18. তাফসীরে ইবনে কাসির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৮৬

19. আল ইকদুল ওয়াহিদ, পৃ. ৭৮

20. তাহজীবুল লুগাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৬৪।

21. ‘আল মুসলিম’ পত্রিকা, প্রথম সংখ্যা, পৃ. ৮, ১৩৭১ ও ১৩৭২ হিজরি।

22. কামুসুল মুহিত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫০২, ‘نقل’ শব্দ সম্পর্কে।

23. তাজুল আরুস, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৫, "نقل” ধাতু মূল

24. তাহজীবুল লুগাত, ২য় খণ্ড পৃ. ২৬৪।

25. লিসানুল আরাব, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৪, "نقل” ক্রিয়ামূল।

26. আননিহায়া, ইবনে আসির, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৬, "نقل” ক্রিয়ামূল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ইবনে আসির ভুল করেছেন যে, তিনি ইতরাত বলতে তাদেরকে বুঝিয়েছেন বানি হাশিম বংশে যাদের ওপর সদকা হারামঅথচ এটি ফিকাহ শাস্ত্রের পরিভাষায় আহলে বাইত, হাদীসের পরিভাষায় ইতরাত ন্যায়।

27. আল মিসবাহুল মুনির, পৃ. ৮৩, "نقل” ক্রিয়ামূল।

28. আদদীনুল খালেস, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫১১ ও ৫১৪।

29.  অথচ তারা চিন্তাও করেনি সুন্নাতকে রাসূলের নামে জাল হাদীস রচনা করে বিকৃত করা সম্ভব। এ কারণে কোন ক্রমেই তা অবিকৃত কোরআনের পাশেওতা সমকক্ষ হিসাবে স্থান লাভ করতে পারে না। আর সুন্নাত যেহেতু বিকৃত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে সেহেতু তা কখনই উম্মতের বিচ্যুতির পথকে রুদ্ধ করতে সক্ষম নয়। -অনুবাদক

30. জাওয়াহিরুল ইকদাইন ফি ফাদ্বলিল মুশরিফিন, পৃ. ২২৪।

31. আহমাদ বিন হাম্বাল, ফাজায়িলুস সাহাবা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭৮৫, হাদীস নং ১৪০২।

32. আল মোজামুল আওসাত, তাবরানী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪০৬, ৫৮৬।

 

মূল: আল্লামা আসাদ হায়দার

অনুবাদ: আবুল কাসেম

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: