bayyinaat

Published time: 04 ,December ,2018      23:19:32
ফাদাক এবং আহলে বাইত (আ.)-এর ইমামগণ
হযরত আলী (আ.) ফাদাককে কোন আয়ের উৎস ও অর্থনৈতিক প্রকল্প হিসেবে মনে করতেন না। রাসূল (সা.) এর মৃত্যুর পর যখন তাঁর ও তাঁর সহধর্মিণীর পক্ষ থেকে ফাদাকের দাবী তোলা হয়েছিল, মূলতঃ তা ছিল তাঁর বেলায়েতের বিষয়টি প্রমাণ এবং রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীর ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্টতা হতে পরিত্রাণ দেওয়া। কিন্তু তখন সে পর্যায় অতিবাহিত হয়েছিল এবং ফাদাকের কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দিকটি অবশিষ্ট ছিল, ফলে তা ফেরত নেওয়াতে কি লাভ?
সংবাদ: 161
ফাদাক এবং আহলে বাইত (আ.)-এর ইমামগণভূমিকা
     এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, প্রথমবার ফাদাক দখল হওয়ার পর থেকে আহলে বাইত (আ.)-এর কোন ইমাম (আ.) কখনও ফাদাকের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন নি। ইমাম আলী (আ.)-এর শাসনকালে এবং অপর ইমাম (আ.) গণের সময়ে তাঁরা ফাদাকের ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেন নি। অন্যান্যরা যেমন : উমর  ইবনে আব্দুল আজিজ, এমনকি আব্বাসী খলিফা মামুন প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, আহলে বাইত (আ.)-এর কোন একজন ইমাম (আ.)-এর নিকট ফাদাক ফেরত দেওয়া হোক। এটা বাস্তবিক অর্থে প্রশ্নের বিষয় যে, ফাদাকের ক্ষেত্রে এরূপ অবস্থানের কারণ কি ?
     যখন সমগ্র ইসলামী দেশের শাসন ক্ষমতা ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে ছিল, তখন তিনি কেন ফাদাককে সেটির প্রকৃত হকদারের নিকট ফেরত দেন নি ? অথবা কেন খলিফা মামুন, যে ইমাম আলী ইবনে মুসা আর রেজা (আ.)-এর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন (যদিও তা লোক দেখানো ছিল) করতেন কিন্তু ফাদাককে তাঁর নিকট ফেরত দেন নি? অথবা কেনইবা সে যায়েদ বিন আলী বিন হুসাইন (আ.)-এর ক'য়েকজন নাতীদের নিকট বনী হাশিমের প্রতিনিধি হিসেবে ফাদাক ফেরত দেন।
     এ সব ঐতিহাসিক প্রশ্নের জবাবে বলব : আমিরুল মূ’মিনীন আলী (আ.) তাঁর উক্তিতে প্রয়োজনীয় বলার বিষয়টি বলেছেন। তিনি বলেছেন : হ্যাঁ, এ পৃথিবীতে আসমানের নিচে যা কিছু আছে তন্মধ্যে শুধুমাত্র ফাদাক আমাদের অধীনে ছিল। কিন্তু কিছু ব্যক্তিরা সেটার ক্ষেত্রে কার্পণ্যতার পরিচয় দেয়।  অপরপক্ষে অন্যরা (সেটির প্রকৃত হকদার) সেটির ক্ষেত্রে বদন্যতার পরিচয় দেয় এবং তা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।  আল্লাহ্ সর্বোত্তম বিচারক। ফাদাক থাকা অথবা না থাকায় আমাদের কিছু যায় আসে না, যখন আগামীকাল কবরস্থ হব।
     তিনি বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ফাদাককে কোন আয়ের উৎস ও অর্থনৈতিক প্রকল্প হিসেবে চান না। সেদিন যখন তাঁর ও তাঁর সহধর্মিণীর পক্ষ থেকে ফাদাকের দাবী তোলা হয়েছিল, মূলতঃ তা ছিল বেলায়েতের বিষয়টি সুপ্রমাণ এবং রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারীর ক্ষেত্রে মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্টতা হতে পরিত্রাণ দেওয়া। কিন্তু তখন সে পর্যায় অতিবাহিত হয়েছিল এবং ফাদাকের কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দিকটি অবশিষ্ট ছিল, ফলে তা ফেরত নেওয়াতে কি লাভ?
     প্রখ্যাত শিয়া আলেম ও গবেষক সাইয়্যেদ মূর্তাজা আলামুল হুদা (রহঃ) এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করেছেন। তিনি বলেন : যখন খেলাফতের দায়িত্বভার আলী (আ.)-এর উপর অর্পিত হয় এবং ফাদাক ফেরত দেওয়ার বিষয়টি তাঁর নিকট উত্থাপিত হয়, তখন তিনি বলেন,
«اني لاَستحيي من الله ان اردّ شيئاً منع منه ابوبكر وامضاهُ عمر»
"আমি আল্লাহ থেকে লজ্জাবোধ করছি যে, আবু বকর যা ফেরত দিতে নিষেধ করেছিল এবং ওমরও তার উপর বহাল ছিল, আমি তা সেটির প্রকৃত হকদারের নিকট ফেরত দিব।”১  
     তিনি এ উক্তির মাধ্যমে নিজের মহানুভবতা এবং একটি আর্থিক ও আয়ের উৎস হিসেবে ফাদাকের প্রতি অনাগ্রহতার পরিচয় দিয়েছেন। সাথে সাথে সেটার প্রকৃত দোষীদেরকেও চি‎হ্নিত করেছেন । ২
     কিন্তু কিছু কিছু খলিফা যারা প্রকাশ্যে দেখাতে চেয়েছেন যে, তারা আহলে বাইত (আ.)-এর প্রতি ভক্তিপোষণ করেন। তারা কেন আহলে বাইত (আ.)-এর ইমাম (আ.) গণের নিকট ফাদাককে ফেরত দেন নি, যেমনঃ বনী ফাতেমা (আ.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে যায়েদ বিন আলীর নাতীবৃন্দ ও অন্যান্যদের নিকট ফাদাক ফেরত দেওয়া হয়েছিল? এ বিষয়ের সম্ভাব্য দু’টি কারণ হচ্ছে :
    (১) পবিত্র ইমাম (আ.) গণ কখনও ফাদাক গ্রহণে সম্মত ছিলেন না। কেননা, সে সময় এটি আধ্যাত্মিক অপেক্ষা পার্থিক দিক থেকে বেশি প্রাধান্য ছিল ।  হয়তোবা তখন সেটা গ্রহণ করলে তাদের আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যাবলীকে প্রশ্নের সম্মুখীন করত এবং শত্রুরা দেখাতো তাঁদের আখেরাত অপেক্ষা দুনিয়ার প্রতি অধিক আগ্রহ রয়েছে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, এ ক্ষেত্রে ফাদাক দখলকারীদের সমর্থকবৃন্দের পক্ষ ধেকে নানাবিধ অজুহাত সৃষ্টির সম্ভাবনাও ছিল।
ইমাম (আ.) গণের জন্য তখন সেটা গ্রহণ ছিল গুরুত্বহীন।
     এছাড়া অত্যাচারী শাসককদের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামের ক্ষেত্রে সেটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। কেননা, যখনই তাঁরা সংগ্রাম করত তখনই তাঁদের থেকে ফাদাক হরণ করা হত। (যেমনভাবে বনী হাসান থকে আব্বাসী খলিফা আবু জাফরের ফাদাক কেড়ে নেওয়ার ঘটনায় ইতিহাসে উল্লেখিত হয়েছে যে, যখন তারা খেলাফতের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তখন তাদের থেকে ফাদাক কেড়ে নেওয়া হয়।)
     (২) অত্যাচারী শাসকরাও সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতো যাতে আহলে বাইত (আ.)-এর আর্থিক অবস্থার উন্নতি না ঘটে। যেমনভাবে খলিফা হারুনের ঘটনাতে উল্লেখিত আছে যে, যখন সে মদীনাতে আসে, তখন হযরত ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)-এর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে, যা তার পুত্র মামুনের কাছে আশ্চর্যকর মনে হয়।
     কিন্তু যখন উপঢৌকনের পালা আসে, তখন ইমাম (আ.)-এর জন্য অত্যন্ত স্বল্পমূল্যের একটি  উপঢৌকন পাঠায়। এমনটি দেখে মামুন বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে। যখন সে তার পিতার কাছে এর কারণ জিজ্ঞাসা করে, তখন উত্তরে হারূন যে  মন্তব্য করে তা ছিল এরূপ : আমরা এমন কিছু করব না যাতে তারা শক্তি অর্জন করে এবং আগামীতে আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
1.    ইবনে আবিল হাদীদ রচিত শারহে নাহজুল বালাগাহ, খণ্ড নং ১৬ পৃ:২১৭।
2.    ইবনে আবীল হাদীদ রচিত "শারহে নাহজুল বালাগা, খণ্ড ১৬, পৃঃ ২৫২।
 
মূল: হযরত আয়াতুল্লাহ আল উযমা মাকারেম শিরাজী
ভাষান্তর: মোহাম্মাদ মিজানুর রহমান

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: