bayyinaat

Published time: 13 ,December ,2018      22:10:22
ইসলামের বিরুদ্ধে মদীনার ইহুদিদের ষড়যন্ত্র (৩)
বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ইহুদীরা কিছু দিন আগে মহানবীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে, যদি তারা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাওহীদী ধর্ম ও আদর্শের শত্রুদের সাহায্য করে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুদের উস্কানী দেয়, তা হলে মুসলমানরা তাদেরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে।
সংবাদ: 171

পঞ্চম বাহিনীর পরিণতি

ইসলামের বিরুদ্ধে মদীনার ইহুদিদের ষড়যন্ত্র (৩) 

একদিন ইহুদী শাস বিন কাইস বনী কুরাইযার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হয়ে দুর্গ থেকে বের হয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং আবেদন করে, তিনি যেন বনী কুরাইযাকে অন্যান্য ইহুদীর ন্যায় অস্থাবর সম্পত্তি সাথে নিয়ে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন। মহানবী তার এ প্রস্তাব গ্রহণ না করে বললেন : "বনী কুরাইযার উচিত বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করা।” শাস তখন তার প্রস্তাব পরিবর্তন করে বলল : "বনী কুরাইযাহ্ তাদের সমস্ত ধন-সম্পদ মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে মদীনা ত্যাগ করতে প্রস্তুত রয়েছে।” কিন্তু মহানবী এবারও তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না।

এখানে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, মহানবী (সা.) কেন বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের প্রতিনিধির প্রস্তাব গ্রহণ করেন নি? এর কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। তা এজন্য যে, বনী নাযীর গোত্রের মতো এ গোত্র যখন মুসলমানদের নাগালের বাইরে চলে যেত, তখন তারা মুশরিক আরব সামরিক শক্তিগুলোকে পুনরায় উস্কানি দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে বড় বড় বিপদ ও হুমকির সম্মুখীন এবং এক বিপুল সংখ্যক লোকের রক্তপাতের কারণ হতে পারত। এ কারণেই মহানবী বনী কুরাইযার প্রেরিত প্রতিনিধির প্রস্তাব মেনে নেন নি। তাই শাস ফিরে গিয়ে বিষয়টা বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ঊর্ধ্বতন নেতাদের অবহিত করে।

বনী কুরাইযাহ্ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তারা বিনা শর্তে মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে বা কতিপয় ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে, বনী কুরাইযাহ্ তাদের মিত্র সা’দ ইবনে মায়ায তাদের ব্যাপারে যে ফয়সালা দেবেন, তা বিনা বাক্যে মেনে নেবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্গের ফটকগুলো খুলে দেয়া হলে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) একটি বিশেষ সেনাদল নিয়ে দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করে তাদের সবাইকে নিরস্ত্র করলেন এবং তাদেরকে বনী নাজ্জার গোত্রের ঘর-বাড়িতে অন্তরীণ করে রাখা হলো, যাতে তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়।

ইসলামী সেনাবাহিনী এর আগে বনী কাইনুকা গোত্রের ইহুদীদের বন্দী করেছিল। কিন্তু খাযরাজ গোত্র, বিশেষ করে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাইয়ের হস্তক্ষেপের কারণে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং মহানবী (সা.) তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান থেকে বিরত থাকেন। এ কারণেই খাযরাজ গোত্রের সাথে পাল্লা দিয়ে এবার আউস গোত্র বনী কুরাইযার সাথে তাদের পুরনো মিত্রতা থাকার কারণে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার ব্যাপারে মহানবীকে তাকীদ দিতে থাকে। কিন্তু মহানবী তাদের আবেদনের বিরোধিতা করে বললেন : "এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার তোমাদের গোত্রের প্রধান ও নেতা সা’দ ইবনে মায়াযের ওপর অর্পণ করছি। তিনি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমি তা গ্রহণ করব।” তখন উপস্থিত সবাই মহানবীর প্রস্তাব মেনে নিল।

এখানে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, সা’দ ইবনে মায়াযের ফয়সালা প্রদানের বিষয়টি বনী কুরাইযার কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। তাই ইবনে হিশাম ও শেখ মুফীদের বর্ণনানুসারে, বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ইহুদীরা মহানবীকে এ বার্তা পাঠিয়েছিল : ننزل علي حكم سعد معاذ "সা’দ ইবনে মায়ায আমাদের ব্যাপারে যে রায় প্রদান করবেন, আমরা তা মেনে নেব।

হাতে তীর বিদ্ধ হয়ে আহত হবার কারণে ঐ সময় সা’দ ইবনে মায়ায অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে পারদর্শী ‘ফীদা’ নামের মহিলার সেবা ও তত্ত্বাবধানে তাঁর তাঁবুতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আর মহানবী (সা.) তাঁকে দেখার জন্য কখনো কখনো সেখানে যেতেন। আউস গোত্রের যুবকরা উঠে চলে গেল এবং গোত্রপতিকে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা সহকারে মহানবীর কাছে নিয়ে আসল। সা’দ রাসূলের দরবারে হাজির হলে মহানবী (সা.) বললেন : "সবার উচিত আউস গোত্রপ্রধানকে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা।” তখন উপস্থিত সবাই সা’দের সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করলেন। সা’দের সাথে যারা এসেছিল তারা তাঁকে মহানবীর কাছে আসার সময় বারবার অনুরোধ করছিল, তিনি যেন বনী কুরাইযার ব্যাপারে দয়া প্রদর্শন করেন এবং মৃত্যুর হাত থেকে তাদের প্রাণ রক্ষা করেন। কিন্তু তিনি তাদের এত অনুরোধ সত্বেও ঐ সভায় রায় প্রদান করলেন যে, বনী কুরাইযার যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে; তাদের ধন-সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন এবং তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করতে হবে।

সা’দ ইবনে মায়াযের দলিল অধ্যয়ন

এতে কোন বিতর্ক নেই যে, বিচারকের আবেগ-অনুভূতি যদি তার বিচার-বুদ্ধি ও বিবেকের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে, তা হলে সম্পূর্ণ বিচার ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগের উদ্ভব হবে; আর এর পরিণতিতে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে; গোটা সমাজের অস্তিত্বই তখন বিপন্ন হয়ে যাবে। আবেগ-অনুভূতি হচ্ছে কৃত্রিম ক্ষুধার মতো, যা ক্ষতিকর ও অনাকাক্সিক্ষত খাদ্য-সামগ্রীকে উপকারী হিসেবে দেখায়। তাই মানুষের বিবেক ও বিচার-বুদ্ধির ওপর এ ধরনের আবেগ-অনুভূতির প্রাধান্য ব্যক্তি ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য ক্ষতিকর।

সা’দ ইবনে মায়ায ছিলেন অত্যন্ত দয়ার্দ্র হৃদয় ও আবেগপ্রবণ মানুষ। অন্যদিকে বনী কুরাইযার নারী ও শিশুদের দিকে তাকালে স্বভাবতই যে কারো হৃদয়ে করুণার উদ্রেক হতো। তেমনি বন্দী শিবিরে অবস্থানরত পুরুষদের দিকে তাকালেও হৃদয়ে করুণার উদ্রেক হবার কথা। এ ছাড়া বিচারক যাতে তাদের অপরাধ উপেক্ষা করেন, এ জন্য আউস গোত্রের লোকেরা খুবই পীড়াপীড়ি করছিল। এসব বিষয়ের দাবী ছিল এটাই যে, উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে নিয়োজিত বিচারক সংখ্যাগুরুদের (মুসলিম জনগণের) স্বার্থের ওপরে একটি সংখ্যাস্বল্প সম্প্রদায়ের (বনী কুরাইযার) স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদান করে রায় দেবেন এবং বনী কুরাইযার অপরাধীদের কোন না কোনভাবে নির্দোষ ঘোষণা করবেন অথবা অন্তত তাদেরকে শাস্তি দানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নমনীয়তা প্রদর্শন করবেন বা পূর্ববর্তী পরিকল্পনাগুলোর যে কোন একটি মেনে নেবেন।

কিন্তু বিচারকের যুক্তি, বিবেক-বুদ্ধি এবং মুক্ত ও স¦াধীন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হওয়া, সর্বসাধারণের (মুসলিম জনতার) কল্যাণ ও স¦ার্থ বিবেচনা তাঁকে এমন এক দিকে পরিচালিত করল যে, তিনি অবশেষে সে দিকেই ধাবিত হলেন এবং বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের যোদ্ধা পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড, তাদের যাবতীয় ধন-সম্পদ জব্দকরণ এবং তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করার পক্ষে রায় প্রদান করলেন। তিনি নিম্নোক্ত দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁর এ ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছিলেন। যথা :

১.     বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের ইহুদীরা কিছু দিন আগে মহানবীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে, যদি তারা ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তাওহীদী ধর্ম ও আদর্শের শত্রুদের সাহায্য করে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুদের উস্কানী দেয়, তা হলে মুসলমানরা তাদেরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে।  বিচারক বললেন :

"আমি যদি এ চুক্তি মোতাবেক বনী কুরাইযার ইহুদীদের শাস্তি দিই, তা হলে আমি ন্যায়বিচার পরিপন্থী কোন রায় প্রদান করি নি।”

২.     চুক্তি ভঙ্গকারী গোষ্ঠীটি সম্মিলিত আরব বাহিনীর ছত্রছায়ায় বেশ কিছু কাল মদীনা নগরীতে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল এবং মুসলমানদের ভীত-সন্ত্রস্ত— করার জন্য তাদের বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। তবে মহানবী (সা.) যদি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করতেন এবং নগরীর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য একদল সৈন্যকে মদীনা নগরীর দিকে প্রেরণ না করতেন, তা হলে বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতো এবং তারা এ অবস্থায় যুদ্ধ করতে সক্ষম মুসলিম পুরুষদের হত্যা করত, তাদের ধন-সম্পদ জব্দ করত এবং তাদের নারী ও সন্তানদের বন্দী ও দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করত। সা’দ ইবনে মায়ায ভেবে দেখলেন, তিনি যদি তাদের ব্যাপারে এ ধরনের বিচার করেন, তা হলে তা সত্য ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী পদক্ষেপ বলে গণ্য হবে না।

৩. আউস গোত্রপ্রধান সা’দ ইবনে মায়ায বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন এবং তাদের সাথে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। ইহুদীদের দণ্ডবিধি সম্পর্কেও তাঁর জানার সম্ভাবনা ছিল। ইহুদীদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাতের মূল ভাষ্য নিম্নরূপ :

তুমি যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কোন শহরের দিকে অগ্রসর হলে প্রথমে তাদেরকে শান্তি ও সন্ধির দিকে আহ্বান জানাবে; আর তারা যুদ্ধ বাঁধিয়েই দিলে তাদের নগরী অবরোধ করবে এবং যখনই ঐ নগরীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, তখনই তাদের পুরুষদের হত্যা করবে। তবে নারী, শিশু, পশু এবং যা কিছু ঐ শহরের মধ্যে থাকবে, সেগুলো গনীমত হিসেবে নিজ অধিকারে আনবে।

সম্ভবত সা’দ ইবনে মায়াযের ধারণা ছিল এই যে, তিনি উভয় পক্ষের মনোনীত কাযী (বিচারক) এবং তিনি যদি আগ্রাসনকারীদের তাদের ধর্মীয় বিধান অনুসারে শাস্তি প্রদান করেন, তা হলে তাঁর এ কাজ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হবে না।

৪. আমরা মনে করি, এ ধরনের রায় প্রদান করার প্রধান কারণ ছিল সা’দ ইবনে মায়ায নিজ চোখে দেখেছিলেন, মহানবী (সা.) খাযরাজ গোত্রের অনুরোধের ভিত্তিতে বনী কাইনুকা গোত্রের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন এবং তাদের মদীনা নগরী ত্যাগ করাকেই যথেষ্ট মনে করেছিলেন। কিন্তু গোষ্ঠীটি তখনও ইসলামী ভূ-খণ্ড ত্যাগ করে নি, এ অবস্থায় (তাদের গোত্রপতি) কা’ব ইবনে আশরাফ মক্কা নগরী গিয়ে বদর যুদ্ধে নিহত কুরাইশ ব্যক্তিদের জন্য কুম্ভিরাশ্রু ঝরিয়েছিল এবং কুরাইশরা (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা পর্যন্ত সে নিশ্চুপ বসে থাকে নি। ফলে উহুদের যুদ্ধের আগুন জ্বলেছিল এবং ইসলামের সত্তর জন শ্রেষ্ঠ সন্তান এ যুদ্ধে শাহাদাতের শরবত পান করেছিলেন।

ঠিক একইভাবে বনী নাযীর গোত্রকেও মহানবী (সা.) ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা মহানবীর মহান এ কাজের বিপক্ষে একটি সামরিক জোট গঠন করে আহ্যাবের যুদ্ধ বাঁধিয়েছিল। যদি মহানবী দক্ষ সমর-কৌশল ও যুদ্ধ পরিচালনা এবং পরিখা খননের পরিকল্পনা প্রণয়ন না করতেন, তা হলে সেই প্রথম দিনগুলোয়ই তারা ইসলামের অস্তিত্ব মুছে ফেলত এবং পরবর্তী কালে ইসলামের আর কোন নাম-নিশানাই থাকত না এবং এভাবে হাজার হাজার লোক নিহত হতো।

সা’দ ইবনে মায়ায এ সব দিক খুব ভালোভাবে বিবেচনা করেছিলেন। অতীত অভিজ্ঞতাসমূহও তাঁকে আবেগ-অনুভূতির কাছে বশ্যতা স্বীকার এবং একটি অপরাধী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বন্ধুত্ব ও স্বার্থের অনুকূলে হাজার হাজার লোকের স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার অনুমতি দেয় নি। কারণ সন্দেহাতীতভাবে এ গোষ্ঠীটি ভবিষ্যতে আরো বৃহত্তর জোট গঠন করে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পৌত্তলিক আরব বাহিনী ও সামরিক শক্তিগুলোকে ক্ষেপিয়ে তুলত এবং যুদ্ধ করার জন্য উস্কানি দিত। এভাবে তারা বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রকেই হুমকি ও বিপদের সম্মুখীন করত। এ কারণেই তিনি এ গোষ্ঠীটির অস্তিত্বকে মুসলিম সমাজের জন্য পুরোপুরি বিপজ্জনক বলে চিিহ্নত করতে পেরেছিলেন এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যদি এ গোষ্ঠীটি মুসলমানদের নাগালের বাইরে চলে যায়, তা হলে এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকবে না এবং মুসলমানদের ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন করবে।

যদি এসব কারণ বিদ্যমান না থাকত, তা হলে সা’দ ইবনে মায়াযের জন্য সাধারণ জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবী পূরণ করে তাদেরকে সন্তুষ্ট করা গুরুত্ব পেত ও প্রাধান্য লাভ করত। আর একটি জাতি বা গোত্রের প্রধান সবকিছুর চেয়ে তাঁর নিজ গোষ্ঠী বা জনগণের প্রতি সবচেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী। তাই তাদেরকে অসন্তুষ্ট করা বা তাদের প্রস্তাবসমূহ প্রত্যাখ্যান করা যে কোন গোত্রপ্রধানের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। তবে তিনি এসব আবেদন ও অনুরোধকে হাজার হাজার মুসলমানের কল্যাণ ও স্বার্থের পরিপন্থী বলে চিিহ্নত করেছিলেন। তাই তিনি নিজ গোত্রের লোকদের অসন্তুষ্ট করে হলেও বিবেক ও যুক্তির বিধানকে উপেক্ষা করতে পারেন নি।

সা’দ ইবনে মায়াযের সূক্ষ্মদর্শিতা এবং সঠিক নীতি অবলম্বন করে ইনসাফপূর্ণ রায় প্রদানের সাক্ষ্য এটাই যে, (সা’দের এ রায় প্রদানের পর) যখন বনী কুরাইযার অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তারা তাদের মনের গোপন কথাগুলো ফাঁস করে দিচ্ছিল।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় পরিখা যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলনকারী হুইয়াই ইবনে আখতাবের দৃষ্টি মহানবী (সা.)-এর উপর পড়লে সে বলেছিল :

أما و الله ما لُمت فِى عداوتك و لكن من يخذل الله يُخذل

"আমি আপনার সাথে শত্রুতা পোষণ করার জন্য মোটেই অনুতপ্ত নই; তবে মহান আল্লাহ্ যাকে অপদস্থ করেন কেবল সে-ই অপদস্থ হয়।”

এরপর সে বনী কুরাইযার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছিল : "মহান আল্লাহ্র নির্দেশের ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বনী ইসরাইলের লাঞ্ছনা অবশ্যম্ভাবী।”

বনী কুরাইযার নারীদের মধ্য থেকে একজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। কারণ সে যাঁতাকলের পাথর নিক্ষেপ করে একজন মুসলমানকে হত্যা করেছিল। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ‘যুবাইর বাতা’ নামের এক ব্যক্তি ‘সাবিত ইবনে কাইস’ নামের এক মুসলমানের সুপারিশে মৃত্যু দণ্ডাদেশ থেকে অব্যহতি পেয়েছিল। তার স্ত্রী ও সন্তানরাও বন্দিত্বদশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল এবং তার জব্দকৃত ধন-সম্পদ ও সহায়-সম্পত্তি তার কাছে ফেরত দেয়া হয়েছিল। বনী কুরাইযাহ্ গোত্রের মধ্য থেকে প্রাপ্ত গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ (খুমস)- যা ইসলাম ধর্মের আর্থিক বিষয়াদি পরিচালনা কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট- বের করার পর মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়েছিল। অশ্বারোহী সৈন্যরা তিন ভাগ ও পদাতিক সৈন্যরা এক ভাগ করে গনীমত লাভ করেছিল। মহানবী (সা.) গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ যাইদের হাতে অর্পণ করলেন, যাতে তিনি নাজ্দে গিয়ে তা বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে ঘোড়া, অস্ত্র ও যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন। আর এভাবে হিজরতের পঞ্চম বর্ষের ১৯ যিলহজ্ব বনী কুরাইযা সৃষ্ট ফিতনার অবসান হলো। সূরা আহ্যাবের ২৬-২৭ তম আয়াত বনী কুরাইযার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং সা’দ ইবনে মায়ায, যিনি পরিখার যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন, বনী কুরাইযার ঘটনার পর এ ক্ষতজনিত কারণেই শাহাদাত লাভ করেন।

ট্যাগ: ইহুদী, বনি কুরাইযা গোত্র, সা’দ ইবনে মায়ায, 

মূল: আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী

সংগ্রহে: আবুল কাসেম

 
মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: