bayyinaat

Published time: 05 ,March ,2017      22:43:28
প্রশ্নোত্তর
ইমাম আলী (আ.) অনুপম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয় গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। মহানবী (সা.) এর সাহাবীদের মধ্যে কেউই এ ধরনের ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন না। তাঁর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ও ফযিলত সংক্রান্ত পরিচিতি কেবল মহান আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ই জানেন। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘হে আলী! কেবল আল্লাহ্ এবং আমি ব্যতীত আর কারো পক্ষে তোমার প্রকৃত পরিচয় জানা সম্ভব নয়।’
সংবাদ: 23

প্রশ্ন: মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে কেন খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন?

প্রশ্নটির পর্যালোচনা ও ব্যাখ্যা: মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই ইমাম আলী (আ.)-এর খিলাফত ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি বহুল আলোচিত ছিল। মহানবী (সা.) কখনোই গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় অস্পষ্ট ও অব্যক্ত রাখেন নি। তাঁর ওফাতের পর যখন খিলাফত ও স্থলাভিষিক্তির প্রসঙ্গ ব্যবহারিক পর্যায়ে প্রবেশ করে, তখন এত স্পষ্ট বিষয়টিও কতিপয় কারণবশত মুসলিম উম্মাহ্‌র মাঝে মতপার্থক্যের উদ্ভব ঘটায় এবং এ কারণে এখনও মহানবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত প্রসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে এবং প্রচুর গ্রন্থও লেখা হচ্ছে।

মাসূম ইমাম এবং আলেমগণ পবিত্র কোরআনের আয়াত, মহানবী (সা.)-এর হাদীস এবং নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদির ভিত্তিতে বিরোধী পক্ষের উত্থাপিত যে কোন ধরনের প্রশ্ন, ব্যাখ্যা এবং সৃষ্ট দ্বিধা-সংশয়ের বিষয়টিকে নিরুত্তর রাখেন নি এবং তাঁর খিলাফত ও মহানবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত প্রসঙ্গের যাবতীয় দিক সুস্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। এ কারণেই যে সব প্রশ্ন ও সংশয় এ পর্যন্ত উত্থাপিত হয়েছে সেগুলোর ধারাবাহিকতায়ই উপরিউক্ত প্রশ্নটি উপস্থাপন করা হয়েছে।

উত্তর: উত্থাপিত প্রশ্নের দুটি অংশ রয়েছে। যথা:

প্রথম অংশ: মহানবী (সা.) কি হযরত আলী (আ.)-কে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন?

দ্বিতীয় অংশ: খেলাফতের পদের জন্য হযরত আলী (আ.) একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন কি না?

বাস্তবতা হচ্ছে, মহানবী (সা.) আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-কে তাঁর পরে খলীফা হিসেবে পরিচিত করিয়েছিলেন এবং এ পদের জন্য তিনিই একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। আমরা নিচে প্রথমে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিব তারপর প্রথমোক্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব:

১. যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে ইমাম আলী (আ.)-এর পরিচিতি তুলে ধরা

ইমাম আলী (আ.) অনুপম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয় গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। অথচ অন্যরা এ ধরনের ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলীর অধিকারী ছিল না। তাঁর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ও ফযিলত সংক্রান্ত পরিচিতি কেবল মহান আল্লাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ই জানেন। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘হে আলী! কেবল আল্লাহ্ এবং আমি ব্যতীত আর কারো পক্ষে তোমার প্রকৃত পরিচয় জানা সম্ভব নয়।’ 

ক. আলী (আ.) সর্বোত্তম মানব

ইমাম আলী (আ.)-কে মহানবী (সা.)-এর হাদীসে সর্বোত্তম মানব হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘আলী সর্বোত্তম মানব এবং এ ব্যাপারে যে সন্দেহ পোষণ করে সে কাফির।’

খ. আলী (আ.) সবচেয়ে জ্ঞানী

ইমাম আলী (আ.) এ উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী এবং সর্বোত্তম বিচারক। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘আমার পরে আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি হচ্ছে আলী ইবনে আবি তালিব।’ তিনি আরো বলেছেন: ‘আলী ইবনে আবি তালিব মহান আল্লাহ্ ও মানবজাতি সম্পর্কে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। যারা কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলে তাদেরকে সে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসে এবং সম্মান করে।’  মহানবী (সা.) ইমাম আলী (আ.)-এর বিচারকার্য সম্পর্কে বলেছেন: ‘আমার পর আলী হচ্ছে সর্বোত্তম বিচারক এবং আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি।’

গ. সত্য আলী (আ.)-এর সাথে

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এবং সত্যের মাঝে বিচ্ছিন্নতা নেই। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘আলী সত্যের সাথে এবং সত্য আলীর সাথে এবং কিয়ামত দিবসে আমার কাছে হাউযে কাওসারে উপনীত হওয়া পর্যন্ত এতদুভয় কখনও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।’

ঘ. পবিত্র কোরআন আলী (আ.)-এর সাথে

পবিত্র কোরআন ও আলী (আ.)-এর মাঝে কখনও বিচ্ছেদ হওয়া সম্ভব নয়। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘আলী কোরআনের সাথে এবং কোরআনও আলীর সাথে। আর (কিয়ামত দিবসে) আমার কাছে হাউযে কাওসারে উপনীত হওয়া পর্যন্ত এতদুভয় কখনও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।’

ঙ. আলী (আ.)-এর সাথে বন্ধুত্বই হচ্ছে জ্ঞানের মাপকাঠি

মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টিতে হযরত আলীর সাথে বন্ধুত্বই হচ্ছে মুনাফিক থেকে মুমিনকে শনাক্ত করার মাপকাঠি। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘হে আলী! কেবল মুমিন তোমাকে শত্রু ভাবে না এবং মুনাফিক তোমার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য নিজ হৃদয়কে নিবেদিত করে না।’

চ. আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জ্ঞানের তোরণ

মহানবী (সা.)-এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নগরীতে যে কেউ প্রবেশ করতে চাইবে তার উচিত হবে এর তোরণ দিয়ে অর্থাৎ আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর মাধ্যমে প্রবেশ করা।

মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘আমি জ্ঞানের নগরী এবং আলী তার তোরণ। অতএব, যে কেউ জ্ঞান অর্জন (জ্ঞানের নগরীতে প্রবেশ) করতে চাইবে সে যেন ঐ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে।’  তিনি আরও বলেছেন: ‘আমি প্রজ্ঞালয় এবং আলী তার দরজা।’১০ 

ছ. আলী (আ.) সকল মহৎ ও উত্তম গুণের নির্যাস

হযরত আলী (আ.) হযরত আদম (আ.) থেকে খাতামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত বিশ্বের সকল মনোনীত মনীষীর সকল মহৎ ও উত্তম গুণের নির্যাস ও সারবত্তা। তিনি আল্লাহ্ পাকের ওয়ালীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি মহান নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারী (ওয়ারিস) এবং মহান আল্লাহ্‌র অতুলনীয় সৃষ্টি। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘যে কেউ আদমকে তাঁর জ্ঞানে, নূহ্‌কে তাঁর তাক্ওয়া-পরহেজগারিতায়, ইবরাহীমকে তাঁর ধৈর্যে, মূসাকে তাঁর গাম্ভীর্যে এবং ঈসাকে তাঁর ইবাদত-বন্দেগিতে দেখতে চায় সে যেন আলী ইবনে আবি তালিবের প্রতি দৃষ্টি দেয়।’১১

জ. হযরত আলী (আ.)-এর অগণিত গুণ

ইমাম আলী (আ.)-এর মহৎ গুণাবলী অসংখ্য। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন: ‘যদি সকল বৃক্ষ কলম এবং সমুদ্রসমূহ কালি, সমগ্র জ্বিন জাতি গণনাকারী এবং মানব-জাতি লেখক হয়ে যায় তবুও আলী ইবনে আবি তালিবের সকল ফযিলত তারা গুণে শেষ করতে সক্ষম হবে না।’১২

২. মহানবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইমাম আলী (আ.)-এর মনোনয়ন

মহানবী (সা.) বিভিন্ন উপলক্ষে ইমাম আলীকে তাঁর পরে স্বীয় উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মনোনীত করেন যা সংক্ষেপে নিচে বর্ণিত হলো:

ক. আলী (আ.) উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত

মহানবী (সা.) নবুওয়াতে অভিষেকের তৃতীয় বর্ষে "এবং আপনি (আপনার) নিকটাত্মীয়দের ভয় প্রদর্শন করুন”১৩ এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর নিকটাত্মীয়দেরকে অর্থাৎ বনী আব্দুল মুত্তালিবের ৪০ জনকে দাওয়াত করেন। দ্বিতীয় দিন দুপুরের খাবার পরিবেশন করার পর তিনি তাদেরকে বললেন: ‘তোমাদের মধ্য থেকে কে আমাকে সাহায্য করবে এবং আমার প্রতি ঈমান আনবে যাতে সে আমার পরে আমার ভাই ও স্থলাভিষিক্ত হতে পারে?আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন: ‘হে রাসূলুল্লাহ্! আমি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে প্রস্তুত।’ মহানবী (সা.) বললেন: ‘তুমি বসো।’ এরপর দ্বিতীয়বার তিনি তাঁর কথা পুনারাবৃত্তি করলেন। আলী ব্যতীত আর কেউ মহানবীর আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিল না। মহানবী (সা.) আলী (আ.)-কে বললেন: ‘তুমি বসো।’ তৃতীয় বার মহানবী (সা.) তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। এবারও আলী দাঁড়িয়ে মহানবীকে সাহায্য ও সহায়তা করার প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেন। তখন মহানবী (সা.) বললেন: ‘এই আলী আমার ভাই, ওয়াসী এবং আমার পরে তোমাদের মাঝে আমার উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত।’১৪ 

খ. আলী (আ.) মদীনায় মহানবীর স্থলাভিষিক্ত

তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় মহানবী (সা.) হযরত আলীকে মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করেছিলেন। ইমাম আলী বলেছিলেন: ‘আপনি কি আমাকে শিশু ও নারীদের মাঝে রেখে যাচ্ছেন?মহানবী (সা.) বললেন: ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, মূসার কাছে হারুন যেমন, তেমনি আমার কাছে তোমার অবস্থান হোক? তবে আমার পরে কোন নবী নেই।’১৫

গ. গাদীরে খুমে আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত হন

﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِيناً

"আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে ধর্ম হিসেবে তোমাদের জন্য মনোনীত ও নির্ধারিত করেছি (সূরা মায়েদাহ: ৩)

এ আয়াতটি মুফাস্‌সিরদের অভিমত অনুসারে মহানবীর ওফাতের কয়েক মাস পূর্বে বিদায় হজ্জে মহানবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। ইসলামের ক্ষতিসাধন করার ব্যাপারে কাফিরদের নিরাশ হওয়ার দিকে ঈঙ্গিত করার পর পবিত্র কোরআনে জোর গুরুত্বারোপ করে মহান আল্লাহ্ বলেন: ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ করেছি।’

এ আয়াতের শানে নুযূল প্রসঙ্গে যে প্রচুর রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে সেগুলো বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামের ক্ষতি সাধন করার ব্যাপারে কাফিরদের নিরাশ হওয়াসহ ধর্মের পূর্ণতা বিধান এবং নেয়ামত চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ করা (إکمال و إتمام) মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মহানবীর উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্তের নিযুক্তির মাধ্যমেই কেবল সম্ভব ও বাস্তবায়নযোগ্য। কারণ, ইসলামের শত্রুরা অপেক্ষা করছিল যে, মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর যেহেতু তাঁর কোন পুত্রসন্তান ছিল না সেহেতু ইসলাম ধর্ম তত্ত্বাবধায়কবিহীন হয়ে দুর্বলতার শিকার হবে ও ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে মহানবীর স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করার মাধ্যমে ইসলাম পূর্ণতা লাভ করে এবং ঐশী নেয়ামতসমূহও চূড়ান্ত হয়।

মহানবী (সা.) বিদায় হজ্জ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তনকালে ‘গাদীর-ই খুম’ নামক স্থানে সকল হাজীকে একত্র করেন এবং ভাষণ দেয়ার সময় ইমাম আলীকে উপস্থিত জনতার সামনে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও খলীফা বলে ঘোষণা করেন এবং সবাই হযরত আলীর হাতে বাইয়াত করে।

আল্লামা আমীনী আল-গাদীর গ্রন্থে ‘গাদীরে খুম’ এর হাদীসটি ১১০ জন সাহাবী, ৮৪ জন তাবেয়ী এবং ৩৬০ জন প্রসিদ্ধ আলেম থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এ হাদীসকে ঐতিহাসিকভাবে মুতাওয়াতির বলে গণ্য করেছেন। যার ফলে এ হাদীসের সনদে কোনভাবেই ত্রুটি পাওয়া যাবে না।

অন্যান্য হাদীস

১. হামূয়ানীর মত আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত আলেমদের রেওয়ায়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবু বকর ও হযরত উমর মুসলমানদের নেতা হিসেবে হযরত আলীর নিযুক্ত হওয়ার পর মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন: ‘এ বেলায়াত কি একমাত্র আলীর?মহানবী (সা.) জবাবে বলেছিলেন: ‘এ বেলায়াত কিয়ামত দিবস পর্যন্ত আলী এবং আমার ওয়াসীদের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত।’ তখন তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন: ‘কারা আপনার ওয়াসী?মহানবী (সা.) বললেন:

আলী যে হচ্ছে আমার ভ্রাতা, সহকারী (ওয়াযীর), উত্তরাধিকারী (ওয়ারিস), আমার পরে আমার উম্মতের মাঝে আমার স্থলাভিষিক্ত খলীফা এবং প্রত্যেক মুমিনের ওয়ালী (তত্ত্বাবধায়ক, অভিভাবক ও নেতা), তার পর আমার দৌহিত্র হাসান, তার পর আমার অপর দৌহিত্র হুসাইন এবং তার পর হুসাইনের বংশধরদের মধ্য থেকে জন একের পর এক আমার ওয়াসী। কোরআন তাদের সাথে এবং তারাও কোরআনের সাথে এবং কিয়ামত দিবসে আমার কাছে হাউসে কাওসারে উপনীত হওয়া পর্যন্ত তারা ও কোরআন কখনও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।১৬

 এ হাদীস অনুসারে মহানবী (সা.) প্রথম ও দ্বিতীয় খলীফার প্রশ্নের জবাবে তাঁর পরে হযরত আলী ও ইমামদের খিলাফত ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন।

২. ﴿يَأَيُّها الَّذِينَ ءَامَنُواْ أَطِيعُواْ اللَّهَ وَ أَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَ أُوْلىِ الْأَمْرِ مِنكمُ

"হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা আনুগত্য কর মহান আল্লাহ্‌র এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বশীলদের(সূরা নিসা: ৫৯)

এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলে জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ আল-আনসারী মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন: ‘কর্তৃত্বশীলগণ (أُوْلِي الأَمْرِ) যাদের আনুগত্য আপনার আনুগত্যের সাথে উল্লিখিত হয়েছে তাঁরা কারা?মহানবী (সা.) জবাবে বলেছিলেন: ‘হে জাবির! তারা আমার পরে আমার স্থলাভিষিক্ত এবং মুসলমানদের নেতা। তাদের প্রথম আলী ইবনে আবি তালিব, তারপর হাসান, এরপর হুসাইন, অতঃপর আলী ইবনুল হুসাইন, তারপর মুহাম্মাদ ইবনে আলী যে তাওরাতে ‘বাকির’ বলে পরিচিত। হে জাবির! অদূর ভবিষ্যতে তুমি তাকে দেখতে পাবে; যখন তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন আমার সালাম তার কাছে পৌঁছে দিও। তারপর জাফর ইবনে মুহাম্মাদ, তারপর মূসা ইবনে জাফর, তারপর আলী ইবনে মূসা, তারপর মুহাম্মাদ ইবনে আলী, তারপর আলী ইবনে মুহাম্মাদ, তারপর হাসান ইবনে আলী এবং তারপর তার ছেলে যার নাম হবে আমার নামের অনুরূপ এবং কুনিয়াহ্ (উপনাম) হবে আমার কুনিয়াহ্‌ অনুরূপ। সে পৃথিবীতে মহান আল্লাহ্‌র হুজ্জাত, বান্দাদের মাঝে মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে ঐশী নেতৃত্বধারার অবশিষ্ট (بقية الله) বা বিদ্যমান নেতা...১৭

৩. প্রসিদ্ধ শা’বানীয়া খুতবায় মহানবী (সা.) তাঁর পরে আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর খিলাফত ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলেছেন: ‘মহান আল্লাহ্ আমাকে ও তোমাকে নিজ নূর হতে সৃষ্টি ও মনোনীত করেছেন। এরপর তিনি আমাকে নবুওয়াতের জন্য এবং তোমাকে ইমামতের জন্য মনোনীত করেন। যে ব্যক্তি তোমার ইমামতকে অস্বীকার করে সে আসলে আমার নবুওয়াতকেই অস্বীকার করে। হে আলী! তুমি আমার ওয়াসী, উত্তরাধিকারী (ওয়ারিস), আমার সন্তানদের পিতা এবং আমার কন্যার স্বামী; তোমার আদেশ আমার আদেশ, তোমার নিষেধাজ্ঞা আমারই নিষেধাজ্ঞা। ঐ আল্লাহ্‌র শপথ যিনি আমাকে নবুওয়াতে অভিষিক্ত এবং আমাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সৎকর্মশীল করেছেন। নিশ্চয়ই তুমি মহান আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকুলের ওপর ঐশী হুজ্জাত, ঐশী রহস্যের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ্‌র বিশ্বস্ত বান্দা এবং মহান আল্লাহ্‌র বান্দাদের কাছে আল্লাহ্‌ পাকের খলীফা।’১৮

এ খুতবার ভিত্তিতে মহানবী (সা.)-এর পর আমীরুল মুমিনীনের খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বিষয় অস্বীকার করা হচ্ছে মহানবীর নবুওয়াতই অস্বীকার করা। ইমাম আলীর আদেশ-নিষেধ মহানবী (সা)-এরই আদেশ-নিষেধ। এ হাদীসে মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে হযরত আলীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।

ফলাফল

নির্ভরযোগ্য শিয়া-সুন্নী হাদীস গ্রন্থ ও সূত্র নিয়ে গবেষণা করলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মহানবী (সা.) হযরত আমীরুল মুমিনীনকে তাঁর ওফাতের পরে উম্মতের খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত বলে পরিচিত করিয়েছিলেন। উম্মতের কাছে মহানবী (সা.) কর্তৃক ইমাম আলীর পরিচিতি প্রদান ছিল সম্পূর্ণভাবে সঠিক ও যুক্তিসংগত বিষয়। কারণ, যাঁরা মহানবী (সা.)-এর পরে উম্মতের নেতৃত্ব দানের যোগ্য তাঁরা হচ্ছেন ইমাম আলী (আ.) ও তাঁর বংশধরগণ যাঁদেরকে বিভিন্ন উপলক্ষ ও ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য, মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে তাঁর ওফাতের পরে যোগ্য ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে হযরত আলী (আ.)-কে পরিচিত করানো এবং তাঁর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত গুণাবলী বর্ণনা এতদর্থে নয় যে, জনগণ হযরত আলীর সকল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও অসাধারণ গুণ সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিল। তবে ইমাম আলীর প্রকৃত ব্যক্তিত্ব সংক্রান্ত জ্ঞান কেবল মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলেরই আছে। আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যত সবার কাছে নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। হযরত আলীর খিলাফত ও স্থলাভিষিক্তের ব্যাপারে তাঁর বিরোধীদের আপত্তি করার কোন সুযোগ যেন না থাকে সেজন্য মহানবী (সা.) হযরত আলীকে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবেই তাঁর ওফাতের পরে তাঁর উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত খলীফা হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র



. বিহারুল আনওয়ার, ৩৯তম খ, পৃ. ৮৪।

. মুত্তাকী হিন্দী, কানজুল উম্মাল, ১১তম খ. পৃ. ৬২৫, হাদীস ৩৩০৪৫।

. কানজুল উম্মাল, খ. ১১, পৃ. ৬১৫, হাদীস ৩২৯৭৭।

. প্রাগুক্ত, হাদীস ৩২৯৮০।

. হাকিম নিশাবুরি, আলমুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন, গবেষণা ড. ইউসূফ মারআশালী, বৈরুত থেকে প্রকাশিত, খ. ৩, পৃ. ১৩৫; আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ তাবারী, যাখায়িরুল উকবা, পৃ. ৮৩; ইবনে সা’দ, আততাবাকাতুল কুবরা, খ. ২, পৃ. ৩৩৮।

. ইবনে আসাকির, তারিখু দিমাশক, আলী ইবনে আবি তালিবের জীবনী অধ্যায়, খ. ৩, পৃ. ১১৭; কুন্দুজী হানাফী, ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ, সংস্করণ ও টীকা সংযোজন : আলাউদ্দীন আ’লামী, খ. ১, পৃ. ১০৪।

. আল্লামা সুয়ূতী, আল জামিউস সাগির, খ. ২, পৃ. ১৭৭।

. আহমাদ ইবনে হাম্বাল, আল মুসনাদ, খ. ১, পৃ. ৮৪; আহমাদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ী, সুনান, খ. ২, পৃ. ১১৬; তাবারানী, আল মো’জামুল কাবির, গবেষণা হামদী আব্দুল মাজিদ সালাফি, খ. ২, পৃ. ৩২১; মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা তিরমিজি, সুনানে তিরমিজি, গবেষণা আব্দুল ওয়াহহাব আব্দুল লাতিফ, খ. ৫, পৃ. ৩০৬; ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান, খ. ২, পৃ. ৪৪৬।

. মুত্তাকী হিন্দী, কানজুল উম্মাল, খ. ১১, পৃ. ৬১৫, হাদীস ৩২৯৭৯; তাবারানী, আল মো’জামুল কাবির, খ. ১১, পৃ. ৫৫; ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান, খ. ১, পৃ. ১৯৭; সুয়ূতী, জামিউস সাগির, খ. ১, পৃ. ৪১৫।

১০. মুত্তাকী হিন্দী, কানজুল উম্মাল, খ.১১, পৃ. ৬০০, হাদীস ৩২৮৮৯; হাকিম নিশাবুরি, আল মুসতাদরাক, খ. ৩, পৃ. ১২৬; ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান, খ. ৪, পৃ. ১৪৪; সুয়ূতী, জামিউস সাগির, খ. ১, পৃ. ৪১৫, হাদীস ২৭০৬; তিরমিজি, সুনানুত তিরমিজি, খ. ৫, পৃ. ৩০১।

১১. আলী ইবনে ঈসা আরবিলী, কাশফুল গুম্মাহ, খ. ১, পৃ. ১১১।

১২. কুন্দুজী হানাফী, ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ, খ. ১, পৃ. ১৪৪, ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান, খ. ৫, পৃ. ৬২।

১৩. সূরা শোয়ারা: ২১৪।

১৪. তারিখে তাবারী, খ. ২, পৃ. ৬২-৬৩; ইবনে আসির, আল কামিল ফিত তারিখ, খ. ২, পৃ. ৪১-৪২; মুসনাদে আহমাদ, খ. ১, পৃ. ১১১; ইবনে হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারি শারহি সাহিহ বুখারী, খ. ৮, পৃ. ১১৪; যামাখশারি, আলকাশশাফ, খ. ১, পৃ. ৩৪৭; কানজুল উম্মাল, খ. ১৩, পৃ. ১৩১, হাদীস ৩৬৪১৯; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ, খ. ৮, পৃ. ৩০২; যাখাইরুল উকবা, পৃ. ৭১; ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ, পৃ. ৩১২।

১৫. মুসনাদে আহমাদ, খ. ১, পৃ. ১৭৭; সহীহ বুখারী, খ. ৩, পৃ. ৫৮; সহীহ মুসলিম, খ. ৭, পৃ. ১২০; সীরাতে ইবনে হিশাম, খ. ৪, পৃ. ৯৪৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ, খ. ৯, পৃ. ১০৯; কানজুল উম্মাল, খ. ১৩, পৃ. ১০৯, হাদীস ৩৬৩৪৫; বালাজুরি, আনসাবুল আশরাফ, খ. ১, পৃ. ২১৭; আলমুসতাদরাক, খ. ৩, পৃ.১০৯; জাহাবী, সিয়ারু আলামিল নুবালা, গবেষণা : শুয়াইব আরনাউত ও হুসাইন আলআসাদ, খ. ১, পৃ. ৪২; জামিউস সাগির, খ. ২, পৃ. ১৭৭; যাখাইরুল উকবা, পৃ. ৮৭; তিরমিজি, সুনানে তিরমিজি, খ. ৫, পৃ. ৩০২।

১৬. জুয়াইনী হামূয়ানী, ফারাইদুস সিমতাইন, খ. ১, পৃ. ১৩৯-১৪০।

১৭. কুন্দুজী হানাফী, ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ, খ. ৩, পৃ. ৩৯৯।

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: