bayyinaat

Published time: 06 ,March ,2017      00:03:44
প্রবন্ধ
আহলে বাইত (আ.)-এর তাফসীরের মূল ভিত্তি তাঁদের ঐশী জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এধরনের তাফসীরকে বাতেনী তাফসীর বলা হয় যার অর্থ হলো বিষয়বস্তু বা গভীরতর অর্থ সংক্রান্ত তাফসীর। তবে এর অর্থ এ নয় যে, তাঁরা আয়াতের শব্দসমূহের ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে কোন গুরুত্ব দিতেন না; বরং এর অর্থ হলো কুরআনের বিভিন্ন পর্যায় বা স্তর থাকার কারণে এর ‘তাফসীর’ (বাহ্যিক অর্থ) এবং ‘তা-ভীল’ (অন্তর্নিহিত অর্থ) করা সম্ভব। আর এখানেই আহলে যিকর (আহলে কুরআন)-এর বাস্তব উদাহরণ হিসেবে আহলে বাইতের উপস্থিতির আত্মিক এবং জ্ঞানগত দিকটি অর্থবহ হয়।
সংবাদ: 30

সার-সংক্ষেপ

মুফাসসিররা আয়াতের শব্দ এবং এর অর্থ আবিষ্কারের জন্য  যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করেন তাকে তাফসীরের ধরন বা পদ্ধতি বলে। যদিও তাফসীরের গবেষকদের দৃষ্টিতে এর পদ্ধতি বিভিন্ন রকমের হতে পারে। (আত-তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরুন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৬-১৪৯) কিন্তু সাহাবীদের যুগ থেকে এ পর্যন্ত সার্বিকভাবে কুরআনের দুই ধরনের তাফসীর পরিলক্ষিত হয়েছে। একটি হচ্ছে বর্ণনামূলক তাফসীর পদ্ধতি, অপরটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও গবেষণামূলক তাফসীর পদ্ধতি।

বর্ণনামূলক তাফসীর পদ্ধতির অর্থ হলো কুরআনের আয়াতকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও সাহাবী (আহলে সুন্নাত এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী) এবং মাসুম ইমামগণের বর্ণনা অনুযায়ী তাফসীর করা। কোন কোন গবেষকের মতে কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে অন্য আয়াতের তাফসীরের পদ্ধতি এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। (আত-তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরুন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৩; উসুলুত তাফসীর ওয়া কাওয়ায়েদুহু, পৃ. ১১১; আল-মাবাদিউল ’আম্মা লিত-তাফসীর, পৃ. ৫৫)

দ্বিতীয় পদ্ধতিতে মুফাসসির নিজের চেষ্টায় কুরআনের আয়াত তাফসীর করেন। এ ধরনের তাফসীরবিদরা রেওয়ায়াত থেকেও উপকৃত হন, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা তাঁদের তাফসীরের মূল ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ সার্বিক পদ্ধতি থেকে কালামী অর্থাৎ বিশ্বাস সংক্রান্ত, শাব্দিক, দার্শনিক, ইরফানী এবং ফিকাহ্্ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম লাভ করে।

এখন প্রশ্ন হলো আহলে বাইত (আ.)-এর তাফসীর পদ্ধতির সাথে এ পদ্ধতিগুলোর সম্পর্ক কী? যদি সাহাবী এবং তাঁদের ছাত্রদের মাধ্যমে লিখিত অথবা অন্যের আলোচনায় সন্নিবেশিত আহলে বাইতের তাফসীরগুলোর পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাব, তাঁরা এক্ষেত্রে বিশেষ মূলনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ইমামগণ কুরআনকে সামগ্রিক,  পূর্ণাঙ্গ এবং পরিপূর্ণ সূত্র হিসেবে বিশ্বাস করতেন। এ কারণে তাঁদের বর্ণনামূলক তাফসীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। এগুলোর মধ্যে বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়, সামাজিক এবং হুকুম-আহকামের বিষয় উল্লেখযোগ্য। তাঁরা কুরআনের আয়াতের ক্ষেত্রে যাহেরী বা বাহ্যিক দিক এবং বাতেনী বা অন্তর্নিহিত দিকে বিশ্বাসী ছিলেন। (এহইয়াউল উলুমুদ দ্বীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪১; সাফী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৫-৬৬) এ শক্তিশালী মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে ইমামদের তাফসীর পদ্ধতির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা সম্ভব।

কুরআনের মাধ্যমে কুরআনের তাফসীর

বিখ্যাত মুফাসসিরদের বর্ণনামূলক তাফসীরের রেওয়ায়াতগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কুরআনের মাধ্যমে কুরআনের তাফসীর করার পদ্ধতি অনেক পুরাতন যুগ থেকে প্রচলিত ছিল। (আল-মিজান, আল্লামা তাবাতাবাঈ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫) আল্লামা তাবাতাবাঈ বিশ্বাস করতেন যে, রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) এবং আহলে বাইতের ইমামগণ কুরআনের তাফসীরের জন্য তত্ত¡গত জ্ঞান এবং কোন বৈজ্ঞানিক মতের সাহায্য গ্রহণ করতেন না। (প্রাগুক্ত)

কুরআন মানবজাতির হেদায়াতের জন্য সব কিছুর বর্ণনাকারী। প্রশ্ন হলো তাহলে কেন কুরআনের ভেতরে নিজ সম্পর্কে বর্ণনা থাকবে না? ইমামগণ এ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে কুরআনের মাধ্যমে কুরআনের তাফসীর করার পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন।

আলী (আ.) সূরা ফাতিহার ৬ নং আয়াত, ‘আমাদেরকে সরল পথে হেদায়াত কর’-কে সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতের মাধ্যমে তাফসীর করেছেন যেখানে আল্লাহ বলেছেন : ‘আর কোন ব্যক্তি আল্লাহ্্ এবং রাসূলের আনুগত্য করে, সে নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের সঙ্গী হবে যাদেরকে আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন।’ (বিহারুল আনওয়ার, ৬৫তম খণ্ড, পৃ. ৭৮; তাফসীরে ইমাম হাসান আসকারী, পৃ. ৫০)

তিনি সূরা বাকারার ১২৪ নং আয়াতে যেখানে আল্লাহ্্ তা‘আলা বলেছেন : ‘আমার প্রতিশ্রæতি যালিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়’- এ আয়াতে বর্ণিত ‘যালিম’কে সূরা লোকমানের ১৩ নং আয়াতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন যেখানে হযরত লোকমান তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন : ‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোন শরীক কর না, নিশ্চয়ই র্শিক চরম যুল্ম (অত্যাচার)’ অর্থাৎ  যুলুমকে র্শিক হিসেবে তাফসীর করেছেন। (নূরুস সাকালাইন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২১-১২২; ইহতিযায, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫১)

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সূরা বাকারার ৬ নং আয়াতে কুফ্্র এবং এর শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে আলোচনায় নিম্নলিখিত আয়াতসমূহকে দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন :

‘তারা অন্যায়ভাবে এবং উদ্ধতভাবে নিদর্শনসমূহকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল।’ (সূরা নাম্ল : ১৪)

‘এটা আমার প্রতিপালকের দয়া ও অনুগ্রহ, যেন তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, না অকৃতজ্ঞ থাকি?’ (সূরা নাম্ল : ৪০)

‘যখন তোমাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং ‘তূর’-কে তোমাদের ঊর্ধ্বে উত্তোলন করেছিলাম’...‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর, আর কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান কর?’ (সূরা বাকারা : ৬৩ ও ৬৫)

‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের গোত্রকে বলেছিল : তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের অস্বীকার করি এবং চিরকালের জন্য তোমাদের সাথে আমাদের বিদ্বেষ ও শত্রæতা সৃষ্টি হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন।’ (সূরা মুমতাহিনাহ : ৪)

এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর দৃষ্টিতে কুফ্রের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে। এ সকল আয়াত থেকে কুফ্রের তীব্রতা ও ক্ষীণতার বিষয়টির অনুধাবন করা যায়।

ইমাম বাকির (আ.)-এর তাফসীরের মধ্যে কিছু ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যায় যে, যদি কোন আয়াতে কঠিন অথবা বোধগম্য নয় এমন শব্দ থাকে সেক্ষেত্রে তিনি অন্য আয়াতের সাহায্যে সে শব্দটির অর্থ করতেন। উদাহরণ হিসেবে রূহ বা আত্মা কী? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি সূরা ওয়াকি‘আর ৮-১১, বাকারার ২৫৩, মুজাদালার ২২, নাহ্ল এর ৭০ নং আয়াতকে সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এ পদ্ধতিকে ইমামদের তাফসীর পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এ তাফসীরে ইমাম বাকির (আ.) নবীদের পবিত্র আত্মার অধিকারী এবং ডান দিকের দলকে ঈমানী ও শক্তির আত্মার অধিকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাম দিকের দল এ ধরনের আত্মার অধিকারী নয়, কিন্তু এর পরিবর্তে তাদের যৌন আকাক্সক্ষাপূর্ণ এবং দৈহিক শক্তিসম্পন্ন আত্মার কথা উল্লেখ করেছেন। (বাসায়েরুদ দারাজাত, পৃ. ৪৬৮)

ইমামদের কুরআনের মাধ্যমে কুরআনের তাফসীর করার আরেকটি দিক হলো সাদৃশ্যের (মুতাশাবেহ) আয়াতকে সুস্পষ্ট (মুহকাম) আয়াতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) সূরা যুখরুফের ৫৫নং আয়াত, ‘যখন তারা আমাদেরকে ক্রোধান্বিত এবং দুঃখিত করল তখন আমরা তাদের শাস্তি দিলাম এবং তাদের সকলকে নিমজ্জিত করলাম’- এর ব্যাখ্যায় বলেছেন : ‘আল্লাহ্্ তা‘আলা আমাদের মত ক্রোধান্বিত এবং দুঃখিত হন না; বরং আল্লাহর দুঃখ এবং সন্তুষ্টি তাঁর রাসূল (সা.) এবং আউলিয়াদেরই দুঃখ এবং সন্তুষ্টির সাথে সম্পর্কিত। অন্য কথায়, রাসূল (সা.) এবং আউলিয়াদের দুঃখ ও সন্তুষ্টিই হলো আল্লাহর দুঃখ ও সন্তুষ্টি।’  (শেখ সাদুক, তাওহীদ, পৃ. ১১৯-১২০)

এরকম সাদৃশ্যের (মুতাশাবেহ) আয়াতকে সুস্পষ্ট (মুহকাম) আয়াতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার অরেকটি নমুনা হলো সূরা নিসার ৮০ নং আয়াত, ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে নিশ্চয়ই আল্লাহর আনুগত্য করল এবং যদি কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়, তোমাকে তাদের রক্ষাকারী হিসেবে প্রেরণ করিনি’- এ আয়াতকে সূরা ফাত্হের ১০ নং আয়াত, ‘যারা তোমার হাতে বাইআত গ্রহণ করে তারা আল্লাহ্্র হাতে বাইআত গ্রহণ করে’-এর মাধ্যমে তাফসীর করেছেন।

বর্ণনামূলক তাফসীর

মাসুম ইমামদের বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর বক্তব্যের মতই অকাট্য- এটা আহলে বাইতের অনুসারীদের মৌলিক বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে হাদীসের সনদ এবং বিষয়বস্তুর যে সকল মূলনীতি রয়েছে সেগুলো রক্ষা করা হলে ইমামদের হাদীস রাসূল (সা.)-এর হাদীসের সমপর্যায়ের মর্যাদাসম্পন্ন হবে। (তিবইয়ান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৬-৮৭)

ইমাম বাকির (আ.)-এর নিকট থেকে যে হাদীস শেখ মুফিদ (আমালী, পৃ. ৪২) বর্ণনা করেছেন তার বিষয়বস্তু অনুসারে, ইমামদের বক্তব্য রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্্র দিকে ফিরে যায়। ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর বক্তব্য অনুসারে, ইমামগণ জ্ঞানের দিক থেকে রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকারী। (কাফী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯২-২৯৩) শেখ বাহায়ীর মত অনুযায়ী, আহলে বাইতের অনুসারীদের হাদীস বারো ইমামের নিকট প্রত্যাবর্তন করে। তাঁদের নিজেদের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁদের বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর দিকে ফিরে যায় এবং আইলে বাইতের জ্ঞানের উৎপত্তি ওহীর পাত্র থেকেই। (আল-ওয়াজীয, পৃ. ২২)

এ কারণে ইমামগণ কুরআনের মাধ্যমে কুরআন তাফসীরের পদ্ধতি ব্যবহার ছাড়াও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁদের তাফসীরকে রাসূল (সা.) অথবা অন্যান্য ইমামের দিকে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে প্রমাণ উপস্থাপন করতেন। মাসুম ইমামগণ অনেক আয়াতের তাফসীর রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলী (আ.) সূরা ইবরাহীমের ৫ নং আয়াত, ‘তাদেরকে আল্লাহর দিনগুলোর (ইয়াওমুল্লাহ্) দ্বারা উপদেশ দান কর’-এর ‘আল্লাহ্্র দিনগুলো’র তাফসীরে রাসূল (সা.)-এর হাদীসের মাধ্যেমে প্রমাণ করেছেন যে, এ দিনগুলো হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ। (শেখ তূসী, আমালী, ১৭তম মাজলেস; আল-বুরহান, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০৫; বিহারুল আনওয়ার, ৬৭তম খণ্ড, পৃ. ২০) একইভাবে আলী (আ.) সূরা রাহমানের ৬০ নং আয়াত, ‘এহসানের পুরস্কার এহসান ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে কি?’-এর তাফসীরে বলেছেন : ‘যাকে তাওহীদের নেয়ামত দিয়েছি তার পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ (শেখ সাদুক, তাওহীদ, পৃ. ৬; কানযুদ দাকায়েক, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৫৮৭)

ইমাম কাযিম (আ.) সূরা বাকারার ১৯৬ নং আয়াত, ‘কিন্তু কেউ যদি তা (সহজলভ্য কোরবানী) না পায় তাহলে তাকে হজের সময় তিন দিন এবং ঘরে ফেরার পর সাত দিন- এই পূর্ণ দশ দিন রোযা রাখতে হবে’- এ আয়াতের বিষয়ে তাঁর একজন সাহাবীর করা প্রশ্নের উত্তর ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর বক্তব্য থেকে প্রমাণ করেছেন (তাফসীরে আ’ইয়াশী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯৯; বিহারুল আনওয়ার, ৯৯তম খণ্ড, পৃ. ২৯১)

ইমাম রেযা (আ.) সূরা বাকারার ৫৮ নং আয়াত, ‘বল, গুনাহসমূহকে ঝরাও। আমি তোমাদের ক্ষমা করব এবং খুব শীঘ্রই সৎকর্মপরায়ণদের (নেয়ামত) বৃদ্ধি করব’-এর তাফসীরে ইমাম বাকির (আ.)-এর বক্তব্য এনেছেন : ‘আমরা তোমাদের গুনাহ ঝরানোকারী’ (তাফসীরে আ’ইয়াশী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৫; বিহারুল আনওয়ার, ২৩তম খণ্ড, পৃ. ১২২)

বিষয়বস্তু সংক্রান্ত তাফসীর অথবা ‘তা-ভীল’ বা অন্তর্নিহিত ও বাতেনী অর্থে তাফসীর

আহলে বাইত (আ.)-এর তাফসীরের মূল ভিত্তি তাঁদের ঐশী জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এধরনের তাফসীরকে বাতেনী তাফসীর বলা হয় যার অর্থ হলো বিষয়বস্তু বা গভীরতর অর্থ সংক্রান্ত তাফসীর। তবে এর অর্থ এ নয় যে, তাঁরা আয়াতের শব্দসমূহের ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে কোন গুরুত্ব দিতেন না; বরং এর অর্থ হলো কুরআনের বিভিন্ন পর্যায় বা স্তর থাকার কারণে এর ‘তাফসীর’ (বাহ্যিক অর্থ) এবং ‘তা-ভীল’ (অন্তর্নিহিত অর্থ) করা সম্ভব। আর এখানেই আহলে যিকর (আহলে কুরআন)-এর বাস্তব উদাহরণ হিসেবে আহলে বাইতের উপস্থিতির আত্মিক এবং জ্ঞানগত দিকটি অর্থবহ হয়।

এর ওপর ভিত্তি করে আহলে যিক্রের বাস্তব উদাহরণ হিসেবে দৃঢ় জ্ঞানের অধিকারী ইমামগণ কর্তৃক বর্ণনামূলক তাফসীরের মাধ্যমে কুরআনের প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যার সীমানা বৃদ্ধি লাভ করেছে। ‘তা-ভীল’ (অন্তর্নিহিত ও বাতেনী অর্থে ব্যাখ্যা) শব্দটি ক্রিয়ামূল আকারে কুরআনে সাতটি সূরায় সাতবার এসেছে। যেসব আয়াতে এ শব্দটি রয়েছে তা যদি গভীরভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে নিম্নলিখিত অর্থগুলোর একটি হবে :

১. স্বপ্নের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ

২. কোন কাজের পরিণতি

৩. আয়াতের বাতেনী অর্থ উদ্ঘাটন

এ অর্থগুলো ছাড়াও ‘তা-ভীল’ শব্দটি রাসূলের হাদীসে এবং তাঁর সাহাবী ও উত্তরাধিকারদের কথাতেও ব্যবহৃত হয়েছে। ‘তা-ভীল’ শব্দটি রেওয়ায়াতে সার্বিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। (বিস্তারিত জানতে দ্রষ্টব্য : জারইয়ন শেনোসী তাফসীরে এরফানী, অত্র প্রবন্ধকের লেখা , পৃ. ২০-২৮)

অন্যভাবে বলা যায়, এ রেওয়ায়াতগুলো পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ‘তা-ভীল’ বলতে প্রত্যেক যুগের বা সময়ের বাস্তব দৃষ্টান্তের প্রেক্ষিতে কুরআনের অর্থ করাকে বুঝায়। ইমামদের করা কুরআনের আধ্যাত্মিক বা বিষয়বস্তু সংক্রান্ত তাফসীর এবং অন্তর্নিহিত ও বাতেনী অর্থে তাফসীর নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে প্রস্ফুটিত হয়েছে :

ক. কোন কিছুর বাস্তব উদাহরণ দেওয়া বা নির্দিষ্ট কিছুর সাথে তুলনা করা

এ পদ্ধতি অনুসারে আয়াতকে বাস্তবতার সাথে মেলানো এবং ইন্দ্রিয়গাহ্য কোন ঘটনার সাথে অথবা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়। তুলনার মাধ্যমে আয়াতের অর্থগত ভাবার্থ সত্যিকারের রূপে প্রকাশ লাভ করে। এক্ষেত্রে ইমাম সাদিক (আ.)-এর সূরা নিসার ৫ নং আয়াত, ‘তোমাদের সম্পদ- যা আল্লাহ্্ তোমাদের জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে দিয়েছেন- তা নির্বোধদের দিও না’-এর প্রকৃত অর্থে ব্যাখ্যা একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এ আয়াতে ইমাম সাদিক (আ.) রাসূল (সা.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী নির্বোধদের বলতে মদ্যপানকারী ব্যাখ্যা করেছেন। (মাজমাউল বায়ান, ৩য় এবং ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৪)

এ ধরনের ব্যাখ্যার আরেকটি উদাহরণ আলী (আ.)-এর ‘হাসানা’ এবং ‘সাইয়্যেআ’ শব্দের ব্যাখ্যায় প্রকাশ লাভ করেছে। তিনি এ দু’টি শব্দ ধারাবাহিকভাবে সূরা নামলের ৮৯ নং আয়াত, ‘যে কেউ ভাল ও সৎ (কর্ম) নিয়ে আসবে অতঃপর তার জন্য এর থেকে উত্তম (প্রতিদান) রয়েছে’ এবং ৯০ নং আয়াত, ‘যে কেউ খারাপ ও অসৎ (কর্ম) নিয়ে আসবে অতঃপর তাকে চেহারা সহকারে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।’ ‘হাসানা’-কে আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা এবং ‘সাইয়্যেআ’-কে আহলে বাইতের প্রতি ঘৃণা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ইমামদেরকে উল্লিখিত আয়াতের বাস্তব উদাহরণ এবং ব্যাখ্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (ফুরাতে কুফী, পৃ. ৩১৪; মা’আনিউল আখবার, পৃ. ২৯৮) বিশেষ ক্ষেত্রে ইমাম বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত তাফসীরে ইমামত সম্পর্কিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যার বিষয়ে ইশারা রয়েছে। উদাহরণসরূপ সূরা বাকারার ২০৮ নং আয়াত, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা সকলে শান্তিতে প্রবেশ কর’- এই আয়াতে ‘সিল্ম’ অর্থাৎ শান্তি বলতে আহলে বাইত এবং তাঁদের বেলায়াতকে বুঝিয়েছেন। অবশ্য ‘সিল্ম’ এর আরো অর্থ রয়েছে

খ. ভাবার্থের প্রসারণ করা অথবা বাস্তবতার সাথে তুলনা করা

এই পরিভাষা ইমাম বাকির (আ.)-এর নিকট থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন : ‘যদি এমন হয় যে, কোন জাতির প্রতি কোন আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর ঐ জাতির মৃত্যু হয় এবং এর ফলে ঐ আয়াতেরও মৃত্যু ঘটে, তাহলে কুরআনের কোন আয়াত-ই অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু কুরআন তো যতদিন আকাশসমূহ এবং পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে ততদিন অবশিষ্ট থাকবে। প্রত্যেক জাতির জন্য (যা তারা পাঠ করে তাতে) আয়াত বা নির্দশন রয়েছে যার সঠিক ব্যবহার অথবা অপব্যবহার রয়েছে।’ (তাফসীরে আ’ইয়াশী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৫) অন্যদিকে বিশেষ কিছু রেওয়ায়াতে কুরআনের বাতেনী বা অন্তর্নিহিত অর্থকে- যা এর ভাবার্থের প্রসারণ হিসেবে গণ্য করা হয়- বাস্তবতার সাথে তুলনাকরণ বলা হয় (কুরআন দার ইসলাম, পৃ. ৫০) এ কারণে কুরআনের ভাবার্থের প্রসারণ ঘটানো এবং একে যুগোপযোগী তাফসীর করা হচ্ছে ইমামদের বিষয়বস্তুভিত্তিক তাফসীরের আরেক ধরনের পদ্ধতি।

কুরআনের সূরা কাসাসের ৭৭ নং আয়াত, ‘দুনিয়া থেকে তোমার অংশ নিতে ভুল না’- যা কারূন সম্পর্কে এসেছে- এর তাফসীরে ইমাম আলী (আ.) নাসিব (অংশ) শব্দটিকে সুস্থতা, সামর্থ্য, বিশ্রাম ও তারুণ্য অর্থে প্রসারণ করেছেন। (মা’আনিউল আখবার, পৃ. ৩২৫; নূরুস সাকালাইন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৩৯)

ইমাম আলী (আ.) একইভাবে আল্লাহর সাথে নিজের জীবন বিনিময়কারীদের অর্থকে বিস্তৃত অর্থে গ্রহণ করেছেন। যারা সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করতে গিয়ে শহীদ হন তাঁদের সকলকে আল্লাহর সাথে নিজের জীবন বিনিময়কারীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (মাজমাউল বায়ান, ১ম ও ২য় খণ্ড,)

পরিশেষে বলা যায় আহলে বাইত কুরআনের তাফসীর এবং এ থেকে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাঁরা কুরআনের সকল আয়াত তাফসীর করার চেষ্টা করেননি। প্রকৃতপক্ষে সাহাবী এবং ছাত্রদের মাঝে কুরআনের তাফসীরের পদ্ধতি এবং মূলনীতি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। ইমামগণ কুরআনের মাধ্যমে কুরআন তাফসীর করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল ব্যবহার করতেন। কুরআনের আয়াতসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করা স্বয়ং কুরআনের শিক্ষা। ইমামগণ এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ইমামগণ কুরআনের বাক্যের বর্ণনা-নীতি ও প্রকাশভঙ্গি অনুযায়ীও তাফসীর করতেন।

 

মূল: ড. মোহসেন কাসিমপুর

অনুবাদ:

সংকলন:

সম্পাদন:


মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: