bayyinaat

Published time: 12 ,May ,2017      06:57:02
প্রবন্ধ
ইসলামের আগমনের পর থেকে সম্রাট, উজীর, প্রাদেশিক শাসনকর্তা, ধনী, দরিদ্র, আরব, ইরানী, রোমীয়, ভারতীয়, তুর্কী, মিশরীয়, ইহুদী, খ্রিষ্টান, দাইলামী, সুরিয়ানী সকলেই ইসলামী ভূখণ্ডের সকল স্থানে যথা সিরিয়া, মিশর, ইরাক, ইরান, উজবেকিস্তান, সিন্ধু, আফ্রিকা, স্পেন প্রভৃতিতে দিবা-রাত্র গ্রন্থ রচনা ও সংকলনে মনোনিবেশ করলেন। অর্থাৎ যেখানেই ইসলামী শাসন ছিল সেখানেই জ্ঞানের দ্রুত বিস্তার ঘটতে লাগল। এ সকল মূল্যবান রচনাসমগ্র ও সংকলনে পূর্ববর্তী যুগসমূহের সকল গবেষণার সারসংক্ষেপ সংকলিত হয়েছিল। মুসলিম মনীষীদের গবেষণার ফল হিসেবে উপরোক্ত জ্ঞানসমূহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভক্ত হয়।
সংবাদ: 62

জ্ঞান ও সংস্কৃতি এবং ইসলামী সভ্যতা

সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশ, সামগ্রিকতা ও সর্বজনীনতা, সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ, সামষ্টিক ও সুন্দর উদ্যোগসমূহের বিচিত্রতা প্রভৃতি দিকগুলো ইসলামী সভ্যতার তীব্র আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত।

জর্জি যাইদান বলেছেন,

‘আরবগণ (মুসলমানগণ) এক শতাব্দীর কিছু বেশি সময়ের মধ্যে অন্য ভাষা হতে বিভিন্ন জ্ঞানের যে বিপুল সংখ্যক অনুবাদ করে রোমীয়গণ কয়েক শতাব্দীতেও তা পারেনি। হ্যাঁ, মুসলমানগণ সভ্যতা সৃষ্টির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরূপ দ্রুতগতিতেই অগ্রসর হয়েছিল।’

মুসলমানগণ কোরআন ও সুন্নাতকে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানসমূহ, যেমন কিরাআত, তাফসীর, কালামশাস্ত্র, হাদীস, ফিকাহ্, সারফ, নাহু (ব্যাকরণশাস্ত্র), মায়ানী, বাদীই ও বায়ান (ভাষার বর্ণনাভঙ্গী ও অলংকারশাস্ত্র), সীরাতুন্নবী (নবীর জীবন ও ইতিহাস) প্রভৃতি নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে। এ সকল বিষয়ে যদি কিছু অন্যদের হতে নিয়েও থাকে তা অনুল্লেখ্য। যে সকল জ্ঞান তৎকালীন অন্যান্য জাতির নিকট ছিল ও ভিন্ন জাতির প্রচেষ্টার ফল বলে বিবেচিত হতো, যেমন অংকশাস্ত্র, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন ও অন্যান্য জ্ঞান তা আরবীতে ভাষান্তরিত ও অনূদিত হয়েছিল। জর্জি যাইদান বলেছেন,

‘ইসলামী সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠত্ব হলো গ্রীক, পারসিক, ভারতীয় ও ব্যাবিলনীয় ভাষার গ্রন্থগুলোকে আরবীতে অনুবাদ করে সেগুলোর পরিবর্ধন সাধনের মাধ্যমে পূর্ণতা দান।’

মুসলমানগণ বিভিন্ন ভাষায় বিদ্যমান দর্শন, অংকশাস্ত্র, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্রন্থসমূহকে আরবীতে অনুবাদ করে। তৎকালীন প্রসিদ্ধ ভাষাসমূহ যথা গ্রীক, ভারতীয় (হিন্দী), ফার্সী ভাষা হতে গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করা হয়। বলা যায় প্রতিটি জাতিরই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানগুলোকে তারা গ্রহণ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ গ্রীকদের নিকট থেকে দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যামিতিবিজ্ঞান, যুক্তিশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যা; ইরানীদের নিকট থেকে ইতিহাস, সাহিত্য, সংগীত, উপদেশবাণী ও জ্যোতিষ্কবিদ্যা; ভারতীয়দের নিকট থেকে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা, উদ্ভিদবিজ্ঞান, তারকাবিজ্ঞান, হিসাবশাস্ত্র, গল্পকাহিনী রচনা ও সংগীত শিল্প। ব্যাবিলনীয় ও নাবতীদের নিকট থেকে কৃষিকাজ, উদ্ভিদের পরিচর্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, যাদু ও হিপনোটিসম; মিসরীয়দের নিকট থেকে রসায়ন ও বিশ্লেষণবিদ্যা। প্রকৃতপক্ষে আরবগণ (মুসলমানগণ) অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, মিশরীয়, ইরানী, ভারতীয় ও গ্রীক জ্ঞানসম্ভারকে (সাহিত্য, স্থাপত্য ও অন্যান্য জ্ঞান) সমন্বিত করে ও উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে ইসলামী সভ্যতার জন্ম দেয়।

ইসলামের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র

ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি (সার্বিকভাবে ইসলামী সভ্যতা) ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে বিকাশ লাভ করে গৌরবময় স্থানে পৌঁছায়। যেমনভাবে সজীব প্রাণীসমূহ প্রথমদিকে এককোষী হিসেবে উৎপত্তি লাভ করে ও ধীরে ধীরে তার অভ্যন্তরীণ প্রাণসত্তা ও ক্ষমতার বিকাশের মাধ্যমে শাখা-প্রশাখা বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠিত হয় ও সবশেষে পূর্ণাঙ্গ সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তেমনিভাবে ইসলামী সভ্যতাও বিকশিত হয়ে পূর্ণতায় পৌঁছায়।

মুসলমানদের জ্ঞান অন্বেষণের ধারা ও উদ্দীপনা একটি নির্দিষ্ট স্থান হতে বিশেষ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিশেষ ব্যক্তির মাধ্যমে শুরু হয়। এখন আমরা দেখব কোন্ স্থানে এ আন্দোলনের ধারাটি শুরু হয় অর্থাৎ মুসলমানদের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্রটি কোথায় চালু হয়?

মুসলমানদের জ্ঞানার্জন ও বিকাশের ধারা মদীনা হতে শুরু হয়েছিল। প্রথম যে গ্রন্থটি মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও মুসলমানগণ তার অন্বেষায় আত্মনিয়োগ করে তা হলো কোরআন। কোরআনের পর তাদের অধ্যয়নের বিষয় ছিল হাদীসসমূহ। হেজাযের আরবরা প্রথমবারের ন্যায় শিক্ষক-ছাত্রের মুখস্থকরণ, সংকলন প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়। মুসলমানগণ আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে পর্যায়ক্রমে অবতীর্ণ কোরআনের আয়াতসমূহ মুখস্থ করত। যে সকল আয়াত তারা সরাসরি রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে না শুনত তা রাসূলের নির্দেশে কোরআন সংকলনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিকট থেকে শুনত ও মুখস্থ করত। তদুপরি তারা রাসূলের পুনঃপুন নির্দেশের কারণে তাঁর পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণীসমূহকে পরস্পরের নিকট থেকে শ্রবণ করে মুখস্থ করত অথবা লিখে রাখত।

মদীনার মসজিদে নিয়মিত শিক্ষার আসর বসত এবং সেখানে বিভিন্ন শিক্ষণীয় ইসলামী বিষয় নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা হতো। একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন দু’দল লোক ভিন্ন দু’ধরনের কর্মে মশগুল রয়েছে। একদল ইবাদাত ও যিকর-আযকারে মশগুল অপর দল জ্ঞানের আলোচনায়। রাসূল দু’দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন,

«كلاهما على خير و لكن بالتّعليم أُرسلت»

"দু’দলই কল্যাণময় কর্মে লিপ্ত রয়েছে, তবে আমি শিক্ষাদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।” অতঃপর রাসূল জ্ঞানের আলোচনায় লিপ্তদের সঙ্গে গিয়ে বসলেন।

মদীনার পর ইরাক জ্ঞানের কেন্দ্রে পরিণত হয়। সর্বপ্রথম ইরাকের বসরা ও কুফা এই দু’শহর জ্ঞানকেন্দ্র ছিল। পরে বাগদাদ শহর নির্মিত হলে তা জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এখান হতেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে খোরাসান, রেই, বুখারা, সামারকান্দ (বর্তমানের উজবেকিস্তানের দু’শহর), মিশর, সিরিয়া, আন্দালুস ও অন্যান্য স্থান জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয়। জর্জি যাইদান মুসলিম শাসকদের উদ্যোগকে এ বিষয়ে সবচেয়ে কার্যকর প্রভাবশীল বলে মনে করেন। তিনি বলেন,

‘ইসলামী ব্যক্তিত্বসমূহ ও উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিবর্গের জ্ঞানের অনুরাগ ও জ্ঞান চর্চার মনোবৃত্তির ফলে ইসলামী দেশসমূহে গ্রন্থ ও গ্রন্থ রচয়িতার পরিমাণ প্রতিদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে ও গবেষণার পরিধির উত্তরোত্তর বিস্তৃতি ঘটে। সম্রাট, উজীর, প্রাদেশিক শাসনকর্তা, ধনী, দরিদ্র, আরব, ইরানী, রোমীয়, ভারতীয়, তুর্কী, মিশরীয়, ইহুদী, খ্রিষ্টান, দাইলামী, সুরিয়ানী সকলেই ইসলামী ভূখণ্ডের সকল স্থানে যথা সিরিয়া, মিশর, ইরাক, ইরান, খোরাসান, উজবেকিস্তান, সিন্ধু, আফ্রিকা, স্পেন প্রভৃতিতে দিবা-রাত্র গ্রন্থ রচনা ও সংকলনে মনোনিবেশ করলেন। অর্থাৎ যেখানেই ইসলামী শাসন ছিল সেখানেই জ্ঞানের দ্রুত বিস্তার ঘটতে লাগল। এ সকল মূল্যবান রচনাসমগ্র ও সংকলনে পূর্ববর্তী যুগসমূহের সকল গবেষণার সারসংক্ষেপ সংকলিত হয়েছিল। ফলে প্রকৃতিবিজ্ঞান, ঐশী জ্ঞান, ইতিহাস, অংকশাস্ত্র, সাহিত্য, দর্শন, প্রজ্ঞা প্রভৃতি বিষয় এ গ্রন্থসমূহে সমন্বিতভাবে বিদ্যমান ছিল। মুসলিম মনীষীদের গবেষণার ফল হিসেবে উপরোক্ত জ্ঞানসমূহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভক্ত হয়।’

যখন অন্য ভাষার জ্ঞানসমূহ আরবীতে অনূদিত হওয়া শুরু হয় তখন খ্রিষ্টান মনীষীরা বিশেষত সিরীয় খ্রিষ্টানরা এ বিষয়ে অন্যদের হতে অগ্রগামী ছিলেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মুসলমানগণ সে স্থান অধিকার করে।

জর্জি যাইদান বলেন,

"আব্বাসীয় খলীফাগণ জ্ঞান ও সাহিত্যের বীজ বাগদাদের মাটিতে রোপন করেন এবং এর ফল পর্যায়ক্রমে খোরাসান, রেই, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, মিশর, সিরিয়া, আফ্রিকা, স্পেন প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বাগদাদে খেলাফত ও ইসলামী ভূখণ্ডের সম্পদের কেন্দ্র হিসেবে পূর্বের ন্যায় মনীষীদের সম্মিলন কেন্দ্ররূপে এরপরও বিদ্যমান থাকে। আব্বাসীয় খলীফাদের সেবায় নিয়োজিত খ্রিষ্টান চিকিৎসকগণই প্রথমদিকে চিকিৎসা ও অনুবাদের কাজ করতেন। পরবর্তীতে বাগদাদ হতে কিছু মুসলিম পণ্ডিত এ কর্মে নিয়োজিত হন। কিন্তু সার্বিকভাবে বাগদাদের প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চ পর্যায়ের মনীষীদের অধিকাংশই খ্রিষ্টান ছিলেন যাঁরা খলীফাদের দরবারে কর্মের জন্য ইরাক ও অন্যান্য স্থান হতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। মুসলিম মনীষীদের অধিকাংশই বাগদাদের বাইরে আত্মপ্রকাশ করেছেন। বিশেষত যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র ইসলামী রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তখন ঐ ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের শাসকগণ খলীফাদের অনুসরণে জ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া শুরু করেন ও তাঁদের অধীন বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন কায়রো, গাজনীন, দামেস্ক, নিশাবুর, ইসতাখর ও অন্যান্য স্থান হতে পণ্ডিত ও গবেষকদের আহ্বান জানান। ফলে রেই হতে জাকারিয়া রাযী; তুর্কিস্তানের বোখারা হতে ইবনে সিনা; সিন্ধের বিরুন হতে আল বিরুনী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইবনে জালিল, দার্শনিক ইবনে বাজা, চিকিৎসক ইবনে জাহরা, দার্শনিক ইবনে রুশদ; স্পেন হতে উদ্ভিদবিদ ইবনে রুমীয়া ও অন্যান্যদের সৃষ্টি হয়।’

সুতরাং প্রথম জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল মদীনা এবং সেখানেই জ্ঞানের প্রথম বীজ রোপিত হয়।

জ্ঞানের প্রথম বিষয়বস্তু

প্রথম কোন্ বিষয়টি মুসলমানদের আকর্ষণ করে ও তাদের মধ্যে জ্ঞানের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে? মুসলমানদের জ্ঞানের শুরু কোরআন দিয়ে। তারা প্রথম কোরআনের আয়াতের অর্থ ও বিষয়বস্তু অনুধাবন ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করে। অতঃপর হাদীস গবেষণা শুরু করে। তাই যে শহরটিতে সর্বপ্রথম জ্ঞানের জাগরণ শুরু হয় তা হলো মদীনা। মুসলমানদের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মসজিদ। তাদের শিক্ষার বিষয়বস্তু ছিল কোরআন ও সুন্নাহ্ এবং তাদের প্রথম শিক্ষক ছিলেন রাসূল (সা.) ইসলামের প্রথম শিক্ষণীয় বিষয় ছিল পঠন, তাফসীর, কালামশাস্ত্র, হাদীস, রিজালশাস্ত্র, ভাষাজ্ঞান, অভিধান, সারফ ও নাহু (ব্যাকরণশাস্ত্র), বাচনভঙ্গী ও অলংকারশাস্ত্র, ইতিহাস ইত্যাদি। এ সকল জ্ঞান কোরআন ও সুন্নাতের স্বার্থে সৃষ্টি হয়েছিল। এডওয়ার্ড ব্রাউন বলেছেন,

‘বিশিষ্ট আরবী ভাষাবিদ প্রফেসর দাখভিয়া এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকার বাইশতম খণ্ডে তাবারী ও অন্যান্য আরব ঐতিহাসিকদের সম্পর্কে যে প্রবন্ধ লিখেছেন তাতে প্রশংসনীয়ভাবে ইসলামী সমাজে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিকাশকে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত কোরআনের আলোকে ইতিহাসের জ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশের বিষয়টি সেখানে আলোচিত হয়েছে। তিনি এ জ্ঞানসমূহ কিরূপে ঐশী প্রজ্ঞার ভিত্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে তা উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কিত জ্ঞান প্রথমত শব্দ ও ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে শুরু হয়। যখন অন্যান্য ভাষাভাষীরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ শুরু করে তখন আরবী শব্দ ও বাক্যগঠন এবং ব্যাকরণশাস্ত্রের আশু প্রয়োজন অনুভূত হলো। কারণ পবিত্র কোরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কোরআনে বর্ণিত অপ্রচলিত শব্দসমূহের অর্থ বিশ্লেষণের জন্য আরবী প্রাচীন কবিতাসমূহ যথাসম্ভব সংকলনের প্রয়োজন পড়ল... এই কবিতাসমূহের অর্থ অনুধাবনের জন্য আরবদের বংশ পরিচিতিবিদ্যা ও তৎকালীন আরবদের ইতিহাস ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা অপরিহার্য হিসেবে দেখা দিল। কোরআনে অবতীর্ণ বিধিবিধানের পূর্ণতার জন্য জীবনের বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাহাবী ও তাবেয়ীদের নিকট হতে নবীর বাণী ও কর্ম সম্পর্কিত প্রশ্নের ফলশ্রুতিতে হাদীসশাস্ত্রের জন্ম হলো। হাদীসসমূহের নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা যাচাইয়ের জন্য হাদীসের সনদ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জনের বিষয়টি অপরিহার্য বিষয় বলে পরিগণিত হলো।... গবেষণার স্বার্থে সনদের বাস্তবতা, ইতিহাসের জ্ঞান, বর্ণনাকারীদের বৈশিষ্ট্য ও চারিত্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো। এর ফলে হাদীসশাস্ত্রবিদগণের জীবনী, বিভিন্ন সময়ের জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও ঘটনাসমূহ সম্পর্কিত জ্ঞান উদ্ভূত হলো। এ ক্ষেত্রে আরবের ইতিহাস যথেষ্ট ছিল না। তাই প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষত ইরানী, গ্রীক, হামিরী, হাবাশী ও অন্যান্য দেশের ইতিহাস জানাও কোরআনে সন্নিবেশিত জ্ঞান ও প্রাচীন কবিতা বোঝার জন্য অপরিহার্য হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ভূগোলবিদ্যাও এ উদ্দেশ্যে উদ্ভূত হয়েছিল। এরূপ অন্যান্য বিদ্যাও ইসলামী সাম্রাজ্যে দ্রুত বিস্তারের সাথে সাথে অপরিহার্য হিসেবে উদ্ভূত হয়।”

জর্জি যাইদানের মত এটিই যে, অন্যান্য জ্ঞানের প্রতি মুসলমানদের আকর্ষণ কোরআনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। মুসলমানগণ কোরআনের প্রতি অনুরক্ত ছিল এবং এর সঠিক তেলাওয়াত ও উচ্চারণের বিষয়ে গুরুত্ব দিত। কোরআন তাদের দীন ও দুনিয়ার সমস্যার সমাধান দিত এবং তারা কোরআনের বিধান বোঝার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাত। কোরআনের শব্দ ও অর্থ অনুধাবনের প্রচেষ্টা বিভিন্ন জ্ঞানের উদ্ভব ঘটায়। ইসলামী সমাজে যে সজীব কোষটি জন্মের পর বিকাশ ও পূর্ণতার মাধ্যমে বৃহৎ ইসলামী সভ্যতার জন্ম দেয় সে কোষটি হলো কোরআনের প্রতি মুসলমানদের সীমাহীন ভালবাসা ও প্রেম। কোরআনের প্রতি মুসলমানদের অকুণ্ঠ ভালবাসাই যে জ্ঞানের সকল দ্বার উন্মোচনে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে জর্জি যাইদান মনে করেন। তিনি বলেন,

‘মুসলমানগণ কোরআন লিখন ও সংরক্ষণে যথার্থ দৃষ্টি রাখত ও এ বিষয়কে এতটা গুরুত্ব দিত যে, ইতোপূর্বে অন্য কারো ক্ষেত্রে তা লক্ষ্য করা যায়নি। তারা এমনকি স্বর্ণ, রৌপ্য ও হাতির দাঁতের পত্রের ওপরও কোরআন লিখত। কখনও রেশমী কাপড় বা দামী কোন কাপড়ের ওপর স্বর্ণ ও রৌপ্যের কালি দ্বারা কোরআনের আয়াত লিখা হতো। গৃহ, মসজিদ, গ্রন্থাগার, সভাকক্ষের দেয়াল ও দরবারসমূহ এরূপ কাপড় ও কোরআনের আয়াতের দ্বারা অলংকৃত করত। লেখার জন্য সুন্দর হাতের লেখা ব্যবহার করত। বিভিন্ন ধরনের চামড়া ও কাগজ কোরআন লিখনে ব্যবহৃত হতো এবং বিভিন্ন রংয়ের কালির মাধ্যমে লিখে তার চারিপাশের রেখাগুলো স্বর্ণ দিয়ে অলংকৃত করা হতো।... মুসলমানগণ কোরআনের শব্দ ও আয়াত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করত, এমনকি কোরআনের বর্ণসংখ্যা স্বতন্ত্রভাবে তারা গণনা করেছিল।’

তিনি বলেছেন,

‘...তাদের সকল বক্তব্য ও লেখনীতে কোরআনের পথকে তাদের কর্মপদ্ধতির আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা তাদের লেখনীতে কোরআনের আয়াতসমূহ হতে উদাহরণ নিয়ে আসত। কোরআনের শিক্ষা ও আদব তাদের দৈনন্দিন জীবনের চরিত্রে ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব রাখত। অথচ অধিকাংশ মুসলিম জাতির ভাষা কোরআনের ভাষা ছিল না এবং তারা এমন দেশে বাস করত যেখান হতে কোরআন অনেক দূরে অবতীর্ণ হয়েছিল। পূর্ববর্তী মুসলমানগণ শরীয়তের জ্ঞান ছাড়াও আরবী ব্যাকরণের বিষয়েও কোরআনের আয়াত ও অর্থ হতে উদাহরণ উপস্থাপন করত, যেমন আরবী ভাষা ও ব্যাকরণবিদ সিবাভেই তাঁর গ্রন্থে কোরআন হতে তিনশ’ আয়াত উদাহরণ হিসেবে এনেছেন। যে সকল সাহিত্যিক ও লেখক তাঁদের বক্তব্য ও লেখনীকে সুন্দর ও অলংকৃত করতে চাইতেন অবশ্যই কোরআনের আয়াতের সহযোগিতা নিতেন।’১০

জর্জি যাইদান আরো উল্লেখ করেছেন,

‘সালাউদ্দীন আইউবী মিশর অধিকারের পর দ্বিতীয় ফাতেমী খলীফা আল আযিয বিল্লাহ্ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারে স্বর্ণ দ্বারা লিখিত ও অলংকৃত তিন হাজার চারশ’ কোরআন পান। আল আযিয বিল্লার মন্ত্রী ইয়াকুব ইবনে কালাস তাঁকে এরূপ কোরআন লিপিবদ্ধ করার কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।’

ইরানের মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর যাদুঘরে যে প্রাচীন কোরআন সংরক্ষিত আছে সেগুলোর আকর্ষণীয় ও আশ্চর্যজনক সুন্দর লিখনপদ্ধতি ও অলংকৃত পৃষ্ঠাসমূহ এ দেশের মানুষের কোরআনের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসার প্রমাণ।

ইসলামের জ্ঞানগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বর্ণিত পর্যায়ক্রমিক ধারাতেই বিকশিত হয়েছিল। এখন আমরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে আলোচনা করব।

যদিও ইসলামী বিশ্বের বাইরে হতে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বলিত যে সকল গ্রন্থ অনূদিত হয়েছিল তা ইরানী ছিল না, কিন্তু ইসলামী বিশ্বের ধর্মীয় ও অন্যান্য জ্ঞান বিষয়ক অধিকাংশ গ্রন্থ ইরানী মুসলিম মনীষীদের মাধ্যমেই রচিত ও সংকলিত হয়েছিল। এটিই ইসলামী শাসনামলে ইরানীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এডওয়ার্ড ব্রাউন বলেছেন,

‘তাফসীর, হাদীস, কালামশাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অভিধান, জীবনী, ইতিহাস, এমনকি আরবী ব্যাকরণ ও অলংকারশাস্ত্রের বিষয়ে যে সকল গ্রন্থ আরবদের নামে প্রসিদ্ধি ও পরিচিতি লাভ করেছে তার অধিকাংশই ইরানীদের রচনা এবং ইরানীদের অংশ বাদ দিলে এ সকল জ্ঞানের উল্লেখযোগ্য ও উত্তম অংশ আর অবশিষ্ট থাকবে না।’

আমরা এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে অ-ইরানী মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকার করতে চাই না। কারণ ইসলামী সভ্যতা বিশেষ কোন জাতির নয়; বরং সকল মুসলমানের। তাই আরব, ইরানী বা অন্য কোন জাতি তাঁকে নিজস্ব বলে দাবি করতে পারে না। তবে প্রতি জাতিই তার অবদানের অংশটুকু বর্ণনা ও নির্দিষ্ট করার অধিকার রাখে।

এডওয়ার্ড ব্রাউনের মতেও প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও উদ্দীপনা থাকলেও কোন গ্রন্থ সংকলিত হয়নি। তাই জ্ঞান ও তথ্যসমূহ মুখস্থের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং বলতে গেলে একমাত্র কোরআনই লিখিতরূপে গ্রন্থ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। তিনি বলেছেন,

‘প্রথম হিজরী শতাব্দীতে জ্ঞান অর্জন একমাত্র ভ্রমণ ও হিজরতের মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। তারা জ্ঞানান্বেষণে দীর্ঘ সফর করত। প্রথমদিকে পরিস্থিতির কারণেই সফরের বিষয়টি অপরিহার্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সফর নিয়মে পরিণত হয় ও এক রকম উন্মাদনা সৃষ্টি করে। নিম্নোক্ত হাদীসের ন্যায় জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে সফরের মর্যাদা ও গুরুত্ব বর্ণনাকারী হাদীসসমূহ এর সমর্থনে উপস্থাপিত হলো। যেমন নবী (সা.) বলেছেন: "যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে সফর করে আল্লাহ্ তাকে বেহেশতের পথে পরিচালিত করেন।” মিশরের অধিবাসী মাকহুল নামের একজন দাস তার মনিব কর্তৃক মুক্ত ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও ততক্ষণ মিশর ত্যাগ করেনি যতক্ষণ মিশরের প্রচলিত জ্ঞানসমূহ অর্জন সমাপ্ত হয়নি। অতঃপর যখন তার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল তখন সে হেজায, সিরিয়া ও ইরাকে যায় ও গনীমতের মাল বণ্টন সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহ সংকলন করে।’১১

কিন্তু এ মতটি ভিত্তিহীন। ইসলামের প্রাথমিক যুগের নিদর্শনসমূহ হতে বোঝা যায় নবী (সা.)-এর সময় হতেই লিখন ও সংকলন শুরু হয় ও অব্যাহত থাকে। এর সপক্ষে অনেক প্রমাণ উপস্থিত। ব্রাউনের ‘হিস্ট্রি অব লিটারেচার’ গ্রন্থের ফার্সী অনুবাদের প্রথম খণ্ডের টীকা অংশে ব্রাউনের মতো ব্যক্তিদের মতকে খণ্ডন করে আল্লামা শাইখুল ইসলাম যানজানীর ‘মুসন্নাফাতুশ শিয়াতিল ইমামিয়া ফিল উলুমিল ইসলামিয়া’ গ্রন্থ হতে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি এর বিপরীত মতকেই প্রমাণ করেছেন।১২

মরহুম আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ হাসান সাদর (আল্লাহ্ তাঁর মর্যাদাকে সমুন্নত করুন) তাঁর ‘তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম’ নামক মূল্যবান গ্রন্থেও এ মতটির ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করেছেন।

 

তথ্যসূত্র



. উইল ডুরান্ট, তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, (ফার্সী ভাষায় অনূদিত), পৃ. ২৪৭।

. তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, পৃ. ২৪৬-২৪৭।

. ‘কুত্তাবে ওহী’ বলে প্রসিদ্ধ।

. শহীদে সানী প্রণীত ‘মুনিয়াতুল মুরীদ’, পৃ. ৫।

. তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম (ফার্সীতে অনূদিত), পৃ. ২৬৪।

. বর্তমানের উজবেকিস্তান।

. উইল ডুরান্ট, তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, পৃ. ২৫৭।

. তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, ৩৯১-৩৯২।

. তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৯৪-৯৫।

১০. তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৯৩।

১১. তারিখে আদাবিয়াতে ইরান, ণ্ড, পৃ. ৩৯৬-৩৯৭।

১২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯২-৩৯৬।

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: