bayyinaat

Published time: 19 ,May ,2017      14:53:21
প্রবন্ধ
আমরা বিশ্বাস করি: মহান আল্লাহ্‌কে চিনা ও জানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে আল্লাহ্‌র একত্ববাদ ও তৌওহীদের বিষয়। বস্তুতঃপক্ষে তৌহীদ কেবলমাত্র উসূলে দ্বীন বা দ্বীনের একটি মৌলিক বিষয় নয়, বরং ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের মূল ও কেন্দ্রীয় বিষয় এবং ইসলামের মৌলিক ও শাখা-প্রশাখাগত সমস্ত বিধি-বিধান তৌওহীদ বা একত্ববাদের ভিত্তিতেই গড়ে উঠে।
সংবাদ: 76

একত্ববাদ সমস্ত ইসলামী শিক্ষার প্রাণ

আমরা বিশ্বাস করি: মহান আল্লাহ্‌কে চিনা ও জানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে আল্লাহ্‌র একত্ববাদ ও তৌওহীদের বিষয়। বস্তুতঃপক্ষে তৌহীদ কেবলমাত্র উসূলে দ্বীন বা দ্বীনের একটি মৌলিক বিষয় নয়, বরং ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের মূল ও কেন্দ্রীয় বিষয়।

এ কথা সুস্পষ্ট ভাবে বলা যায়ঃ ইসলামের মৌলিক ও শাখা-প্রশাখাগত সমস্ত বিধি-বিধান তৌহীদ বা একত্ববাদের ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে। সর্ব ক্ষেত্রে –সত্তাগত, বৈশিষ্ট্যগত ও ক্রিয়াগত– একত্ববাদের রূপ থাকতে হবে। অন্য এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ইসলামের সব ক্ষেত্রেই একত্ববাদের উপস্থিতি রয়েছে অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের দাওয়াত, আল্লাহ্‌র দ্বীন ও বিধি-বিধান, কিবলা ও আসমানী কিতাব, বিচার দিবস, মানব জাতি সম্পর্কিত খোদায়ী আইন-কানুন ও বিধি-বিধানসহ মৌলিক বিশ্বাসের বিষয়সমূহে মুসলমানদের মাযহাবগুলোর মধ্যে যে একত্ব রয়েছে তা তৌহিদ ও একত্ববাদের বিশ্বাসের ফলশ্রুতিতেই

এ কারণেই কোরআন মজীদ আল্লাহ্‌র একত্ববাদের বিচ্যুতি ও শির্‌ক প্রবণতাকে ক্ষমাহীন অপরাধ (গুনাহ্‌) বলে ঘোষণা করছে। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا

অর্থাৎঃ "আল্লাহ্‌ কখনো শির্‌ক জনিত অপরাধ ক্ষমা করেব না। আর এ ছাড়া (এর চেয়ে নিন্মের) অন্যান্য সব অপরাধ, যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কাউকে আল্লাহ্‌র সাথে অংশিদার সাব্যস্ত করল সে তো মহা পাপে পাপী হল।” (সূরা নিসা: ৪৮)

আল্লাহ্‌ আরো বলেন:

﴿وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থাৎঃ "তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের প্রতি প্রত্যাদেশ (অহী) পাঠানো হয়েছিল যে, যদি শির্‌ক জনিত অপরাধ কর তাহলে তোমার সমস্ত আমল বিনষ্ট ও বরবাদ হয়ে যাবে। আর তুমি ক্ষতিগ্রস্থ অন্তর্ভূক্ত বলে পরিগণিত হবে।” (সূরা যুমার: ৬৫)

একত্ববাদের শাখা সমূহ

আমরা বিশ্বাস করিঃ একত্ববাদের কিছু শাখা রয়েছে, তন্মধ্যে নিম্ন বর্ণিত চারটি শাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

ক. সত্তাগত বা সহজাত একত্ববাদঃ মহান আল্লাহ্‌র সত্তা এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর সমতুল্য, সমকক্ষ বা সদৃশ কোন কিছুই নেই।

খ. বৈশিষ্ট্য বা গুণগত একত্ববাদঃ আল্লহ্‌র বিজ্ঞতা, শক্তি-ক্ষমতা, অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান থাকা ও অনন্ত-অসীম কাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকা ইত্যাদি সব গুণ-বৈশিষ্ট্যাবলীই তাঁর সত্তাগত ও অবিচ্ছেদ্য সহজাত বৈশিষ্ট্য। আর তাঁর সত্তা এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ্‌র গুণ-বৈশিষ্ট্যাবলী সৃষ্টির গুণ-বৈশিষ্ট্যের মত পরস্পর থেকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন নয় বরং একক ও অবিভাজ্যঅবশ্য আল্লাহ্‌র সত্তার সাথে তাঁর গুণ-বৈশিষ্ট্যাবলী সহজাত হওয়ার বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন

গ. ক্রিয়াগত একত্ববাদঃ প্রত্যেকটি কাজের ভূমিকা (কারণ) ও নিদর্শন (ফলাফল ও প্রভাব) যা কিছু এ পৃথিবীতে দেখা যায়, সবই আল্লাহ্‌র ইচ্ছা (এরাদা) থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে।

মহান আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ

অর্থাৎঃ "মহান আল্লাহ্‌ই সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা এবং তিনিই এগুলোর সংরক্ষণকারী” (সূরা যুমার: ৬২)

আল্লাহ্‌ আরো বলেন:

﴿لَهُ مَقَالِيدُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

অর্থাৎঃ "সমগ্র আকাশ-মণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের চাবিকাঠি তাঁরই নিয়ন্ত্রনাধীন” (সূরা শুরা: ১২)

জী হ্যাঁ! «لَا مُؤَثِرَ فِي الوُجُودِ إلَّا الله» অর্থাৎ অস্তিত্বের জগতে আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন প্রভাবশালীর অস্তিত্ব নেই।

কিন্তু এ কথার অর্থ এ নয় যে, আমরা আমাদের কর্ম-কাণ্ডের ব্যাপারে বাধ্যতাধীন। বরং এর বিপরীতে আমরা আমাদের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا

অর্থাৎঃ "আমরাই তাকে (মানুষকে) পথ দেখিয়েছি (তার পথ তার জন্যে সুগম করে দিয়েছি), চাই সে কৃতজ্ঞতার পথ অবলম্বন করুক অথবা বিদ্রোহ করে অকৃতজ্ঞতার রাস্তা বেছে নিক” (সূরা ইনসান: ৩)

আল্লাহ্‌ আরো বলেন:

﴿وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى

অর্থাৎঃ "আর মানুষ তার চেষ্টা-সাধনা দ্বারা অর্জিত ছাড়া আর কোন কল্যাণ লাভ করবে না।” (সূরা নাজম: ৩৯)

আল কোরআনের এ আয়াতসমূহ স্পষ্ট ঘোষণা করছে যে, মানুষ তার কাজ-কর্ম ও ইচ্ছার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু যেহেতু মহান আল্লাহ্‌ আমাদের কাজ-কর্ম, চিন্ত-চেতনা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দান করেছেন সেহেতু আমাদের কৃতকর্মের পরিণাম এরই উপর ভিত্তি করে হবে। এ পর্যায়ে আমাদের কাজ-কর্মের মোকাবিলায় আমাদদায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা রয়েছে এবং পুরস্কার ও শাস্তি থেকে মোটেও হ্রাস করা হবে না। ব্যাপারটি খুবই প্রণিধান যোগ্য।

জী হ্যাঁ! মহান আল্লাহ্‌ চেয়েছেন যে, আমরা আমাদের কাজ-কর্মগুলো স্বাধীনতার সাথে আঞ্জাম দেই, যাতে করে এ পথে তিনি আমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন এবং আমাদরকে পর্যায়ক্রমে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কেননা, একমাত্র স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমেই এবং স্বাধীভাবে আল্লাহ্‌র আনুগত্যের পথ অতিক্রম করার মাধ্যমেই মানুষ পরিপূর্ণতার শীর্ষে আরোহণ করতে পারে। এ কারণে যে, অস্বাধীন মানুষ থেকে আদায়কৃত বাধ্যতামূলক আমল দ্বারা ভাল-মন্দের বিচার করা যায় না। নীতিগতভাবে আমরা যদি আমল করার ক্ষেত্রে বাধ্য-বাধকতার শিকার হতাম তাহলে নবী-রাসূলগণের প্রেরণ ও আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করার কোনই অর্থ থাকতো না। অনুরূপভাবে, দ্বীনি দায়িত্ব-কর্তব্য, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও শাস্তি ইত্যাদিও অর্থহীন ও অন্তঃসারশূণ্য থেকে যেত।

এ বিষয়টি আমরা রাসূলের আহলে বাইতের ইমামগণের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছি। তাঁরা আমাদেরকে বলেছেন:

«لَا جَبْرَ وَ لَا تَفْوِيْضَ وَلَكِنْ أَمْرٌ بَيْنَ أَمْرَيْن»

অর্থাৎ ‘জাব্‌র’ তথা বাধ্যতা নয় আবার ‘তাফভীয’ তথা কর্মকে বান্দার হাতে পূর্ণরূপে অর্পিত করার বিশ্বাসও সঠিক নয়। বরং প্রকৃত ও সঠিক নীতি হচ্ছে এ দু’য়ের মাঝামাঝি বিষয়ে বিশ্বাসের নীতি। (উসূলে কাফী, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৬০)

ঘ. ইবাদতগত একত্ববাদঃ ইবাদত কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যেই নির্দিষ্ট। তিনি ছাড়া আর কেউই ইবাদতের যোগ্য নেই। একত্ববাদের এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত। আল্লাহ্‌র নবী-রাসূলগণ অধিকাংশ আহ্বানই একত্বকাদে প্রতিই ছিল

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ

অর্থাৎঃ "তাঁদেরকে (নবীগণকে) এ ছাড়া আর কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তাঁরা কেবলমাত্র আল্লাহ্‌রই ইবাদত-বন্দেগী করবেন... আর নিজেদের দ্বীন-ধর্মকে তাঁর (আল্লাহ্‌র) জন্যে নির্ভেজাল করবে এবং শির্‌ক থেকে একত্ববাদে প্রত্যাবর্তন করবে, (আর এটাই হল আল্লাহ্‌র স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় দ্বীন)” (সূরা বাইয়্যেনাহ্‌: ৫)

চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার পর্যায় অতিক্রম করার জন্যে ইবাদতগত একত্ববাদের আরো গভীর ভূমিকা রাখবে যে, মানুষ কেবলমাত্র আল্লাহ্‌র সাথে নিজের অন্তরকে সম্পর্কযুক্ত দেখবে। সব সময় ও স্থানে তাঁকেই স্মরণ করবে আর তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে নিজের চিন্তা-ভাবনার জগতে স্থান দিবে না। আর কোন কিছুই তাকে আল্লাহ্‌র চিন্তা-স্মরণ থেকে সরিয়ে নিজের চিন্তায় লিপ্ত করবে না। «كُلَّمَا شَغَلَكَ عَنِ اللهِ فَهُوَ صَنَمَكَ» অর্থাৎ যে বস্তুই তোমাকে নিজের চিন্তায় লিপ্ত করবে এবং আল্লাহ্‌ থেকে দূরে সরাবে, সেটাই তোমার উপাস্য মূর্তি বলে গণ্য হবে।

আমাদের বিশ্বাসঃ একত্ববাদের শাখাসমূহ কেবল এ উক্ত চারটি শাখাতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং মালিকানার একত্ববাদ অর্থাৎ সব কিছুর আধিপত্য ও অধিকার একমাত্র আল্লাহ্‌র। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ

অর্থাৎঃ "আসমান ও জমিন যা কিছু আছে সব কিছুর উপর আল্লাহ্‌রই আধিপত্য ও সত্তাধিকার রয়েছে।” (সূরা বাকারাহ্‌: ২৮৪)

সার্বভৌমত্বে ক্ষেত্রে একত্ববাদঃ অর্থাৎ কেবলমাত্র আইন-বিধি আল্লাহ্‌রই চলবে। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

অর্থাৎঃ "আর যারা আল্লাহ্‌র প্রেরিত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না, এমন সব লোকেরা কাফের” (মায়েদাহ্‌: ৪৪)

 

তথ্যসূত্র

মূল: আয়াতুল্লা নাসির মাকারিম শিরাযী (‘ইমামিয়্যাহ্‌ শীয়াদের আকিদা-বিশ্বাস’ গ্রন্থ থেকে সঙ্কলিত)

 

মন্তব্য দর্শকরা
নাম:
ই-মেল:
* অভিমত: